শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংস হলো কেন?
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের জনগণ বেশকয়েকদিন ধরেই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে পার করেছে। যদিও সরকার ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে সব কোটা বাতিল করে দেয়, তবে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের দায়ের করা একটি মামলার রায়ে ৫ জুন মাননীয় হাইকোর্ট সেই প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করে কোটা পুনর্বহাল করার আদেশ দেন।
তারপর থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে দেশের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন ছিল অহিংস আন্দোলন।
শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৫ জুলাই ২০২৪ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তবে, ১৬ জুলাই ২০২৪ আন্দোলনটি ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় যখন শিক্ষার্থীরা দেশ জুড়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছিল।
আরও পড়ুন
রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত তৃতীয় শক্তি ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে এবং সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে, আইন প্রয়োগকারী বাহিনী শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অকালে ঝরে গেল বেশ কিছু প্রাণ। এই সংঘর্ষে আমরা অনেক তরুণকে হারিয়েছি, যার ফলে তাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অন্যদিকে, শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্যসহ আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যরা নিহত হয়েছে। এই রক্তপাত কোনো মূল্যে প্রত্যাশিত ছিল না। ফলে, বাংলাদেশের জনগণ এই অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষে নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছে।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, উচ্চ আদালতের রায়ের পরেই অতি অল্প সময়ের মাধ্যমেই সেই রায় বাতিল চেয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়েছিল যার অর্থ সরকারের পক্ষ থেকেও শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছিল।
ইতিমধ্যেই, সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বের বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্ট্যাটাস কো (মানে হলো স্থিতাবস্থা) জারি করে ৪ সপ্তাহ পরে শুনানির দিন ধার্য করেন। তবে, শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চাওয়া হয়। পরিস্থিতিতে খারাপ হতে থাকলে সরকারের তরফ থেকে আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।
একদিকে যেমন আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয় ঠিক তেমনিভাবে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নেতৃত্বের বেঞ্চে শুনানির দিন এগিয়ে নিয়ে আসার আবেদন করা হয়।
তাদের ঘোষণার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়েছিল, যে দলগুলো সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছিল, তারা ছাত্র আন্দোলনের সুযোগে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করেছিল।
সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে ২১ জুলাই ২০২৪ শুনানির দিন ধার্য হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে দেশে কারফিউ জারি করা হয়। তবে ২১ জুলাই ২০২৪ বিভিন্ন পক্ষের শুনানির পর সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের বেঞ্চ এক ঐতিহাসিক রায় প্রদানের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান দেন।
পরবর্তীতে সরকার সেই রায়ের আলোকে প্রজ্ঞাপন জারি করে। একইসাথে শিক্ষার্থীদের দাবির কথা মাথায় রেখে সরকার সংঘর্ষের সময় মৃত্যুর ঘটনা তদন্তের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছে। দেশবাসী প্রত্যাশা করে যে প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
আরও পড়ুন
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ঘটনায় সরকার প্রতিক্রিয়া জানাতে বেশি সময় নিয়েছে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন কোণ থেকে প্রশ্ন উঠেছে। এ কথা ঠিক কয়েক দিন আগেই এই উদ্যোগ নেওয়া যেত। তবে, সরকার হয়তো বুঝতে পারেনি যে, তৃতীয় পক্ষ যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি খারাপ করবে।
সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, তারা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার মাধ্যমে উদ্যোগ নিয়েছে। যেহেতু আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ে স্থিতাবস্থা দিয়েছিল, যার অর্থ ছিল যে সরকারের আগের প্রজ্ঞাপন কার্যকর ছিল।
তাছাড়া, আপিল বিভাগ ৪ সপ্তাহ পর সব পক্ষের কথা শুনতে চেয়েছিলেন। তাই শুনানির আগে তারা কোনো ব্যবস্থা নেইনি। আইনানুগ দিক থেকে এই যুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। তবে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ কয়েক দিন আগে ব্যবস্থা নিতে পারত।
এদিকে, তৃতীয় পক্ষটি অর্থাৎ যারা পনেরো বছর ধরেই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করছে তারা ঘোলা পানিতে মাছ ধরার জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করার চেষ্টা শুরু করে। এর আগে বাংলাদেশের জনগণ বহুবার এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে।
১৮ ও ১৯ জুলাই ঢাকায় সরকারি স্থাপনায় যে ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে, তা সব ধরনের নৃশংসতাকে হার মানিয়েছে। যখন নৃশংসতা চলছিল সেই সময় আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয় যে, চলমান ভাঙচুরের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই, কারণ তারা সরকারি স্থাপনার ওপর এই ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ কখনোই প্রত্যাশা করে না।
তাদের ঘোষণার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়েছিল, যে দলগুলো সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছিল, তারা ছাত্র আন্দোলনের সুযোগে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করেছিল। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেছে যে, একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সেই সময় সরকার পতনের ডাক দিয়ে দেশবাসীকে আন্দোলনে নামার আহ্বান জানানো হয়েছিল।
সরকার উৎখাতের আহ্বান স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, সেই দলটি তাদের মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে সরকার উৎখাতের জন্য ভাঙচুর চালিয়েছে। এর আগেও তারা বেশ কয়েকবার এই ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলেও লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।
খুব সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়া এই ধরনের সংগঠিত অপরাধ করা সহজ কাজ ছিল না। যদি গোয়েন্দাদের দুর্বলতা থেকে থাকে তাহলে এই ঘটনা থেকে সরকারের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
এবার যে ধরনের ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে তা একেবারেই আলাদা ছিল কারণ তারা সরকারি সব কাঠামো, স্থাপনা এবং অফিসগুলো লক্ষ্যবস্তু করেছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল ঢাকাকে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা করে সরকার পতনের। ফলে, তারা কৌশলে তাদের সমর্থকদের ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকায় নিয়ে আসে।
দেশব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞের দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাব যে, দেশের অন্যান্য জেলায় খুব কম ঘটনা ঘটেছে, যার অর্থ তারা ঢাকা ও সংলগ্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিল। এখন একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো, কেন সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিরোধীদের পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য পেতে ব্যর্থ হয়েছে?
খুব সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়া এই ধরনের সংগঠিত অপরাধ করা সহজ কাজ ছিল না। যদি গোয়েন্দাদের দুর্বলতা থেকে থাকে তাহলে এই ঘটনা থেকে সরকারের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
স্বাভাবিকভাবেই, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অধিকার রয়েছে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার। কিন্তু সরকারি কাঠামোগুলোর ওপর এই ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানো উচিত নয় কারণ এগুলো জনগণের সম্পত্তি।
আরও পড়ুন
মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো আইকনিক কাঠামোগুলো ভাঙচুরের উদ্দেশ্য ছিল দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা যা কোনো রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। সুতরাং, এই কাঠামোগুলোর পাশাপাশি নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সরকারের দায়িত্ব। তবে, আশার কথা হলো কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনীর অবস্থানের কারণে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
ইতিমধ্যেই, প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দাবি অর্জিত হয়েছে। তাদের আন্দোলনকে ঘিরে দেশে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে তা প্রত্যাশিত ছিল না। এই ধরনের ঘটনার সাথে শিক্ষার্থীরা জড়িত নয়-একথা শিক্ষার্থীরা যেমন দাবি করেছে, তেমনি সরকারি পর্যায় থেকে একই কথা বলা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের বেশকিছু দাবির ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে, উভয় পক্ষের উচিত আলোচনার মাধ্যমে এই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটানো। কয়েক দিনে ঘটে যাওয়ার ঘটনায় একদিকে যেমন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, ঠিক তেমনি দেশের জনগণের সম্পদ নষ্ট হয়েছে। একই সাথে দেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে, সময় ক্ষেপণ না করে, দেশের জনগণের স্বার্থে সকলকে এক সাথে কাজ কাজ করা উচিত।
ড. প্রণব কুমার পান্ডে ।। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক