রথযাত্রা মহোৎসব : জগন্নাথদেবের করুণা
এক ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বর জীবের প্রতি করুণাবশত বিভিন্ন রূপে ধরাধামে আবির্ভূত হন। ভগবানের অত্যন্ত করুণাঘন রূপ হলো ‘জগন্নাথ’। তাঁর অপার করুণা সম্পর্কে কিছু দিক এখানে আলোচনা করা হলো।
জগতের নাথ: ‘জগন্নাথ’ নামটি আমাদের বুঝিয়ে দেয়, তিনি সমগ্র জগতের নাথ। ‘জগৎ’ অর্থ ব্রহ্মাণ্ড এবং ‘নাথ’ অর্থ প্রভু বা মালিক। সুতরাং, তিনি কেবল কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্র, জাতি বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রভু নন, বরং তিনি নিরপেক্ষভাবে সমগ্র বিশ্বের প্রভু, যা জাতি, বর্ণ, গোষ্ঠী এমনকি দেশের সীমাকেও অতিক্রম করে। কেউ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান যেকোনো ধর্মেরই হোন, সংগতিপূর্ণভাবেই জগন্নাথের ভগবত্তা সবার জন্যই স্বীকার্য, যেহেতু আমরা সবাই এই জগতে বসবাস করি।
জগদ্বাসীকে দর্শনদান: ভারতবর্ষে হাজার হাজার মন্দির রয়েছে, যেখানে ভগবানের বিভিন্ন অর্চাবিগ্রহ বিদ্যমান। অধিকাংশ মন্দিরগুলোয় দেখা যায় যে, ভগবানের বিগ্রহের শোভাযাত্রাকালে ভগবান ‘উৎসব বিগ্রহ’‘ বা ‘বিজয় বিগ্রহ’ (উৎসবের বিগ্রহ) পরিগ্রহ করে তাতে অংশ নেন।
আরও পড়ুন
অর্থাৎ, মূল বিগ্রহ মন্দির থেকে বের না হয়ে, তাঁর প্রতিনিধিরূপে অন্য বিগ্রহ শোভাযাত্রায় বের হন। কিন্তু জগন্নাথদেব এতই করুণাঘন যে, শুধু তাঁর ভক্তদের দর্শন দানের জন্য, তিনি যে বিগ্রহে গর্ভমন্দিরে নিত্য পূজিত হন, সেই বিগ্রহেই শোভাযাত্রায় বেরিয়ে আসেন।
এইক্ষেত্রে তিনি কোনো প্রতিনিধি বা উৎসব বিগ্রহকে পরিগ্রহ করেন না। যদিও ভগবান জগন্নাথের মূল সেবিত বিগ্রহ বিশালাকার এবং অনেক ভারি, তবুও প্রথা অনুসারে প্রভু জগন্নাথ রথযাত্রা উৎসবে মূল মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন জগদ্বাসীকে দর্শন দানের জন্য।
সবার সেবা গ্রহণ: সব মন্দিরেই ভগবান ব্রাহ্মণ দ্বারা পূজিত হন। শ্রীক্ষেত্র পুরীতেও পরমেশ্বর ভগবান জগন্নাথ উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ পুরোহিত দ্বারা পূজিত হন। কিন্তু কখনো কখনো ভগবান শবর অথবা উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর থেকেও সেবা গ্রহণ করেন, যারা কি না সমাজে অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত।
ভগবান জগন্নাথ এতই দয়ার সাগর এবং সমদৃষ্টি সম্পন্ন যে, বিশেষ সময়ে তিনি এই শবরদের সেবা সরাসরি গ্রহণ করেন। আমরা অসুস্থ হলে সাধারণত পরিবারের নিকটজনেরাই কিন্তু আমাদের সেবা করে থাকে, পাশের বাড়ির প্রতিবেশীরা নয়।
তেমনই, প্রভু জগন্নাথ সারা বছর ধরে ব্রাহ্মণদের সেবা গ্রহণ করেন; কিন্তু যখন তিনি লীলায় থাকেন, তখন তিনি এই শবরদের সেবাই গ্রহণ করেন, যারা দয়িতাপতি নামেও পরিচিত।
দয়িতা মানে ‘প্রিয়’। আর ভগবান জগন্নাথ সমাজের তথাকথিত অস্পৃশ্যদেরই নিজের প্রিয়জন হিসেবে গণ্য করেন, তাদের সেবা সরাসরি গ্রহণ করেন। এটা জগন্নাথের উদারতা আর করুণাদৃষ্টিরই নিদর্শন।
আরও পড়ুন
ভক্তদের নৈকট্য প্রদান: পুরুষোত্তমক্ষেত্র শ্রীধাম পুরীতে পরমপুরুষ ভগবান জগন্নাথের পূজা-অর্চনা পদ্ধতি খুবই রক্ষণশীল এবং সাবধানতার সাথে করা হয়ে থাকে। ভগবান যখন গর্ভগৃহে অবস্থান করেন, তখন কঠোর নিয়মকানুন অনুসৃত হয়।
এমনকি ভগবানকে কেউ স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারেন না, এই কঠোর বিধিনিষেধ এবং পবিত্র নিয়মকানুনের কারণে। কিন্তু প্রভু জগন্নাথ যখন রথযাত্রা মহোৎসবে মন্দিরবেদী থেকে বাইরে আসেন, তখন সেইখানে কোনো প্রকার নিয়মকানুন বা বিধিনিষেধের বেড়াজাল থাকে না।
এই ক্ষেত্রে তিনি খুবই সাধারণ এবং ভক্তদের নৈকট্য প্রদানের জন্য শান্তভাবে অবস্থান করেন। এভাবে যে কেউ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে, তাঁকে ভালোবেসে আলিঙ্গন করতে পারে। ভগবান নিজেকে পূর্ণরূপে তাঁর ভক্তদের মাঝে বিলিয়ে দেন।
অপ্রাকৃত রূপ: জগৎপতি শ্রী জগন্নাথদেবের এই অপ্রাকৃত রূপ বা কাঠামোই এমন যে, তিনি তাঁর দুই বাহু সম্মুখ দিকে প্রসারিত করে আছেন এবং এটিই প্রদর্শন করছেন যে, তিনি জগতের সবাইকে কতটা ভালোবাসেন এবং তাঁর দিব্য আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতে চান।
নিষ্পলক নেত্রদ্বয়: প্রভু জগন্নাথের চক্ষুদ্বয় এক বিশেষ এবং ভিন্নরকমের গুণপূর্ণ। তাঁর বৃহদাকার বিস্তৃত গোলাকৃতি আঁখিদ্বয় সর্বদা প্রশস্তভাবে খোলা থাকে, কারণ সেই চক্ষুদ্বয়ের কোনো পাপড়ি নেই।
ভগবান তাঁর করুণাঘন চোখ দুটিকে নিষ্পলকভাবে খুলে রেখে সবার উদ্দেশ্যে করুণা বর্ষণ করতে থাকেন। এমনকি তিনি এক মুহূর্তের জন্যও আঁখিদ্বয় বন্ধ করেন না। জগন্নাথ কতটা দয়ালু, আমাদের প্রতি এটা তারই বহিঃপ্রকাশ।
একসময় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ভগবান জগন্নাথের কাছে একটি বর প্রার্থনা করেন যে, ‘প্রভু কৃপাপূর্বক আপনি আপনার এই অদ্ভুত দিব্য দর্শন অনবরতভাবে আমাদের দান করুন, আপনি কেবল এক প্রহর সময়কাল (তিন ঘণ্টা) পর্যন্ত বিশ্রাম নিন।’
সেই থেকে ভগবানের গর্ভগৃহের দরজা কেবল তিন ঘণ্টার জন্যই বন্ধ হয়। আর বাকি সময় দর্শনার্থীরা ভগবানকে দর্শন করতে থাকেন। ভগবানের মূল মন্দিরের দরজা বন্ধ হলেই যে তিনি বিশ্রাম নেবেন তা কিন্তু নয়।
এই সময় সব দেবদেবী ভগবানের সেবা করতে সেইখানে উপস্থিত হন। কাজেই, এটা স্পষ্ট যে, ভগবান ২৪ ঘণ্টাই নিষ্পলক এবং বিশ্রামরহিত হয়ে তার এই দিব্য দর্শন দিতে থাকেন।
রক্তিম করুণনেত্র: ভগবান জগন্নাথের চোখ দুটো বৃত্তাকারে লাল রঙে আবৃত। সাধারণত যখন কারও অনেক দয়া হয় বা করুণাবশে তাদের চোখ থেকে জল নির্গত হয়, তখন চোখগুলো লাল বর্ণ ধারণ করে। হয়তো তা খুব স্বল্প পরিমাণে করুণার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
প্রভু জগন্নাথ সর্বতোভাবেই করুণার সাগর, যে কারণে তাঁর প্রশস্ত আঁখিদ্বয় সর্বদাই লালবর্ণের হয়। এভাবে ভগবান জগন্নাথের চোখের গঠনই বলে দেয় যে তিনি কতটা দয়াপূর্ণ এবং করুণাঘন।
আরও পড়ুন
ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু: ভগবান জগন্নাথ, বলদেব এবং সুভদ্রা মহারানী সুদর্শন চক্রসহ যে রং বা বর্ণ ধারণ করে আছেন, তাও অনেক মাহাত্ম্যপূর্ণ। কেউ কেউ মনে করেন, বিগ্রহগণের এই অনেক রঙের বৈচিত্র্য বা তারতম্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রজাতি এবং বিভিন্ন রং বা বর্ণের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে।
কেউ মনে করেন, প্রভু জগন্নাথের কৃষ্ণবর্ণ বা কালো রং পৃথিবীর সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। ভগবান বলদেব যে সাদা রং পরিগ্রহ করেছেন, তা সব সাদা চামড়ার মানুষদের প্রতিনিধি স্বরূপ এবং শুভদ্রা মহারাণী যে হলুদ বর্ণে বিভুষিতা, তা প্রতিনিধিত্ব করে হলুদাভ বর্ণের মানুষদের।
আর সুদর্শন চক্র তুলে ধরেন লাল বর্ণীয় লোকেদের। এভাবে বলদেব, সুভদ্রা ও সুদর্শনসহ জগন্নাথদেবের চার রকমের কাঠামো যা কি না ‘চতুর্ধামূর্তি’ রূপে খ্যাত, যা গোটা পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করে।
তাছাড়া, জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসবে সমাজের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বেশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ এক সম্প্রীতির মেলবন্ধন তৈরি করে; গড়ে তোলে প্রকৃত বিশ্বভ্রাতৃত্ব। তাই ভগবান জগন্নাথদেব আমাদের ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু, করুণার মূর্ত বিগ্রহ।
চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী ।। সাধারণ সম্পাদক, ইস্কন, বাংলাদেশ