ধর্ষণ বন্ধে সরকার আন্তরিক ছিল কবে?
কয়েকজন নারী বসে আছেন একটি ঘরে। এনারা কেউ কারও পরিচিত নন। এখানে আছেন মুসলিম, মারাঠি, গুজরাটি, বয়স্ক, পেশাজীবী বা ছাত্রী, গৃহিণী, কিশোরী এবং তরুণী। হঠাৎ দেখে মনে হবে বিভিন্ন বয়স, চেহারা ও কালচারের এই নারীরা এখানে কী করছেন? এরপর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, মেয়েগুলোর মধ্যে মিল একটাই, তা হলো, এরা প্রত্যেকেই জীবিত অবস্থায় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আজ সবাই তারা মৃত। ধর্ষণের আঘাত, লজ্জা, ক্রোধ বুকে নিয়ে এরা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
যে জায়গাটায় এরা গা ঘেঁষে বসে কাঁদছেন, গল্প করছেন, কুঁকড়ে আছেন সেই জায়গাটি খুব ছোট। সেইখানে এই মেয়েগুলো প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জীবনের গল্প বলছেন। বর্ণনা করছেন কে, কীভাবে, কার দ্বারা যৌন নৃশংসতার শিকার হয়েছেন। তারা তাদের অপরাধীদের পরিচয় দিচ্ছেন, তুলে ধরছেন সেইসব সত্য যা ঢাকা পড়ে গেছে। তারা জানেন নারীর পোশাক, বয়স, পেশা, চেহারা ও সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, তিনি ধর্ষণের শিকার হতে পারেন।
গল্পের শুরু থেকেই দরজায় কলিংবেলের শব্দ শোনা যাচ্ছিল অর্থাৎ নতুন কেউ এখানে ঢোকার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু এখানে অবস্থানরত নারীরা চাইছেন না এখানে মানে এই ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ আর কেউ আসুক। কারণ এদের জায়গা দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। এতে করে প্রমাণিত হয় যে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ ক্রমাগত বাড়ছে ও স্বাভাবিক হয়ে উঠছে এবং এতে করে মৃত্যুর পরের নিরাপদ আশ্রয়েও স্থান সংকুলান হচ্ছে না।
আরও পড়ুন
‘দেবী’ নামের ১৩ মিনিটের একটি শর্ট ফিল্মে যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের দেখানো হয়েছে। দেশ, কাল, পাত্র, বয়স, সামাজিক অবস্থান সব ভেদেই যৌন নিপীড়নের শিকার নারীরা এইভাবেই এক ঘরে হয়ে থাকেন। এখানে অবস্থানরত মানুষগুলো টিভিতে খবর শুনে বুঝতে পারছেন, আরও অনেক নারী ও শিশুকে এখানে আসতেই থাকবে।
শেষে এসে পরিচালক সমাজকে একটা ধাক্কা দিয়েছেন এভাবে যে, ওই ঘরের দরজা খুলে দেওয়ার পর দেখা গেল এখানে ঢোকার জন্য এতক্ষণ দরজায় বেল বাজাচ্ছিল একজন শিশু, কারণ সেও একজন যৌন নিপীড়িত। ‘দেবী’ সিনেমার সেই ঘরবন্দি মৃত নারী ও শিশুরা আর কেউ নয় আমার মা, আমার বোন, আমার সন্তান।
সত্যিই চারপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির হাত থেকে মেয়েশিশু ও নারী কেউ রক্ষা পাচ্ছেন না। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৫ মাসে ২০১ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে গণধর্ষণের ভিকটিম ৫০ জন। ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছেন ৯ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ২ জন। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে আরও ৪৪ জনকে। একই সময়ে ১৭ জন ছেলে শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
আজকাল অপরাধীরা ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করে, সেই ছবি নিজেরাই ভাইরাল করে দেয়। কারণ তারা জানে যে তাদের বিচার হবে না। তাও আমরা চুপ, আজ আমরা এতটাই নীরব হয়ে আছি যে, প্রতিরোধ করাই ভুলে গেছি।
এইতো সেইদিন স্বামীর সাথে বেড়াতে গিয়ে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় গৃহবধূ গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। গাজীপুরের শ্রীপুরে কিশোরী গৃহপরিচারিকাকে (১৪) একাধিকবার ধর্ষণ ও ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে সুফী চেহারার ফিজিওথেরাপিস্ট ফরহাদ উজ্জামানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় ১২ বছর বয়সী এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে সাদিকুল ইসলাম (১৯) নামের এক বাদাম বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনে এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে রেলওয়ে পুলিশ।
এইরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা নারীর মনোজগতকে এমন করে কব্জা করে রেখেছে যে নারী তার নিপীড়িত হওয়াকে মেনে নিতে বাধ্য হন। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েও বুঝতে পারেন না যে নির্যাতিত হচ্ছেন। যেমন আমাদের পোশাক শিল্পে কর্মরত নারীদের মধ্যে অধিকাংশই বুঝতে পারেন না তারা কীভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কারণ শুধু ধর্ষণকেই মনে করেন যৌন সহিংসতা।
আরও পড়ুন
এর বাইরে নারীর শরীরে হাত দেওয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, বাজে কথা বলা ও পর্নোছবি দেখানোকেও তারা যৌন হয়রানি মনে করে না। সমাজে পুরুষদের অধিকাংশই নারী বিদ্বেষী এবং তারা নারীর প্রতি যৌন হয়রানির জন্য নারীকেই দায়ী করেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন নারীর ছবি ভাইরাল হতে দেখেছি যে গণধর্ষণের শিকার কিশোরী মেয়েটিকে বাবা মা ধরে নিয়ে যাচ্ছেন, আর তার পরনের কাপড় রক্তে ভেসে যাচ্ছে। নয়জন ধর্ষক পুরুষ একটি আদিবাসী চাকমা পরিবারের ঘরে ঢুকে বাবা আর মা’কে আটকে রেখে সারারাত ধর্ষণ করেছে বাড়ির প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে।
আজকাল অপরাধীরা ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করে, সেই ছবি নিজেরাই ভাইরাল করে দেয়। কারণ তারা জানে যে তাদের বিচার হবে না। তাও আমরা চুপ, আজ আমরা এতটাই নীরব হয়ে আছি যে, প্রতিরোধ করাই ভুলে গেছি।
কোনো বয়সের মেয়েরাই ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির হাত থেকে নিরাপদ নন। অনেকগুলো ধর্ষণ ঘটনার পর নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন, যোগ করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড, দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে পরিবর্তন আসেনি। কারণ আইন থাকলেও নানা কারণে আইনের প্রয়োগ খুব কম।
যে মেয়েটি বা ছেলেটি যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, সে বা তার পরিবার ছাড়া আর কেউ বিষয়টা নিয়ে উদ্বিগ্ন হন না। উদ্বিগ্ন হলেও, যতটা হওয়া উচিত, ততটা হন না। কথা বলেন না, আওয়াজ তোলেন না, বিচার দাবি করেন না। নারী বা মানবাধিকার সংগঠনগুলো কিছু কথা বললেও এতে তেমন কোনো লাভ হয় না।
সরকার এবং সাধারণ জনতা মনে করে নারী বা শিশুর অব্যাহতভাবে যৌন হামলা ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার বিষয়টি নিয়ে শুধু গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোই মাতামাতি করে। এটা তেমন বড় কোনো অপরাধ নয়।
নারী আক্রান্ত হলে যেনতেন প্রকারে নারীকেই দায়ী করা হয়। নারীর আচরণ, পোশাক, চলাফেরা এইসব কিছু দায়ী করা হয়। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দেয় না যে, ৮৪ বছরের বৃদ্ধা অথবা ৪ মাসের শিশু কেন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বা মাদ্রাসায় প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে কেন শিক্ষার্থীরা? তাদের দোষ কোথায়?
সরকার মনে করে, আমরা তো ধর্ষণ, গণধর্ষণের জন্য আইন করেই দিয়েছি, এখন আর কী করতে পারি। কিন্তু আমরা দেখছি ধর্ষণের জন্য এই প্রথাগত ও আইনি শাস্তি কোনো কাজেই আসছে না। কারণ লম্বা পথ পার হয়ে, বহু প্রতিকূল পরিস্থিতিকে পাস কাটিয়ে, রক্ত চোখ উপেক্ষা করে এবং সমাজের কুৎসিত মতামতকে অগ্রাহ্য করে একজন ভিকটিম ও তার পবিবারকে বিচারকের দরজায় পৌঁছাতে হয়, যা অধিকাংশ পরিবার বা ব্যক্তির পক্ষে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।
মাঝপথে এসে বন্ধ হয়ে যায় অনেক মামলা, সালিশ করে বা ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে নিষ্পত্তি করা হয় আরও বেশি মামলার। অথচ একথা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যে ধর্ষণের মামলায় সালিশ হয় না। কিন্তু কে শোনে কার কথা? শহরে, গ্রামে এই রেওয়াজ চলছেই। এমনকি মাঝেমাঝে স্থানীয় আদালত স্থানীয় মতমোড়ল ও পুলিশও এই বিচারের পক্ষে থাকে।
আমরা মনে করি, আইন করার পাশাপাশি সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত নারী ও শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া। আইনের প্রয়োগ এমনই কঠিন হওয়া উচিত, যেন অপরাধী এই অপরাধ করার আগে ১০ বার চিন্তা করে। ‘জিরো টলারেন্স’ কথাটা শুধু কথার কথা হয়ে আছে বলেই চারিদিকে ধর্ষণকারীদের এত প্রতাপ।
আরও পড়ুন
পরিবারে, সমাজে, দেশে বড় পরিবর্তন দরকার। নারী আক্রান্ত হলে যেনতেন প্রকারে নারীকেই দায়ী করা হয়। নারীর আচরণ, পোশাক, চলাফেরা এইসব কিছু দায়ী করা হয়। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দেয় না যে, ৮৪ বছরের বৃদ্ধা অথবা ৪ মাসের শিশু কেন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বা মাদ্রাসায় প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে কেন শিক্ষার্থীরা? তাদের দোষ কোথায়?
একজন নারী যখন ধর্ষণের শিকার হয়ে থানাতে যান বা আইনের দ্বারস্থ হন, তখন তাকে ভয়াবহ রকম ট্রমার মধ্য দিয়ে যেত হয়, হেনস্থার কোনো শেষ থাকে না। এই পুরো ব্যবস্থার মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। আর তা শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। আমাদের পরিবারগুলোয় সবসময় মেয়েকে ভালো হয়ে চলতে শেখানো হয়, অথচ ছেলে শিশুকে এর ১০ শতাংশও শেখানো হয় না।
ছেলেদের শেখানো উচিত নারীকে সম্মান করবে, যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ করবে না। কারণ অন্য নারীকে কটূক্তি যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ করা মানে নিজের মা ও বোনকেই আঘাত করা। আমি তো মনে করি, পড়াশোনা শেখানোর চাইতেও এই শিক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
একটা শিশু চোখ মেলে পৃথিবীকে দেখার আগেই যৌন পাশবিকতার শিকার হচ্ছে পরিবারে, স্বজনদের দ্বারা, পরিবারের বন্ধুদের দ্বারা, পাড়া-প্রতিবেশী, শিক্ষক, মৌলভি, অচেনা লোকের দ্বারা। এরপর যখন মেয়েটি বড় হতে থাকে, তার জন্য বেঁচে থাকার লড়াই আরও কঠিন হতে থাকে। অম্লানবদনে এখন যে আগুনকে আমরা জ্বলতে দিচ্ছি, সেই আগুন যে একদিন আমাদের সন্তানকেই পুড়িয়ে মারবে না, এর নিশ্চয়তা কোথায়।
শাহানা হুদা রঞ্জনা ।। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক