উৎসবে শিশু-কিশোরদের বরাদ্দ কতটুকু?
চারিদিকে ঘুরি ফিরি, দেখি আর ভাবি খুব বেশি কি অলীক প্রত্যাশী হয়ে উঠেছি আমি! ভেবে পেলাম না, মন ভরে কিছু একটা করে যেতে পারলাম না। এই ভাবনাগুলো কি নিজের চরিত্রের দুর্বলতা? জানি না। এখন একটু চিন্তা করা যাক কী পেলাম না?
বাংলাদেশ যখন শিশু রাষ্ট্র ছিল তখন আমরাও শিশু। একটি রাষ্ট্র যখন বহু ঝড়-ঝাপটা, উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে একটুখানি থিতু হয় তখন রাষ্ট্র অধিনায়কসহ সহযোগী নির্মাতারা রাষ্ট্রের সার্বিক অবকাঠামো তৈরি করেন।
প্রথমেই এর শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়ে যায়। আমাদের সেইক্ষেত্রে কিছু সমস্যা ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে বহু রকম বৈশ্বিক চাপ নিতে হয়। বাংলাদেশকেও নিতে হয়েছে। তাই সামাজিক পারিবারিক আনন্দ এবং মূল্যবোধগুলো তৈরি হয়েছে পরিবার নামের প্রতিষ্ঠান থেকে। কেটে গেছে আমাদের শিশু বেলা।
আরও পড়ুন
রাষ্ট্রীয় চিন্তা থেকে আমরা উপেক্ষিত থেকে গেলাম। উৎসব মানে ঈদ, পূজা, পার্বণ কিংবা এসব ছাড়াও শিশু-কিশোরদের জন্য বরাদ্দ কতটুকু? বরাদ্দ মানে অর্থের এবং চিন্তার। শিশু-কিশোররা সবসময় বঞ্চিতই থেকে গেল। বঞ্চিত থেকে যাবে আগামী প্রজন্মের শিশুরাও।
খুব সম্প্রতি আবিষ্কার করলাম খাওয়া ছাড়া বাংলাদেশে মানুষের আসলে কোনো বিনোদন নেই, বিনোদনের ব্যবস্থাও নেই। আমাদের শিশু-কিশোরদের সারাক্ষণ খাইয়ে দাইয়ে ছেড়ে দিচ্ছি আমরা। সবাই দয়া করে ভাববেন যে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার পর্যাপ্ত আয়োজন নেই বলে সম্প্রতি শিশুরা অনেক বেশি ডাক্তার এবং হাসপাতালমুখী।
খুব সম্প্রতি আবিষ্কার করলাম খাওয়া ছাড়া বাংলাদেশে মানুষের আসলে কোনো বিনোদন নেই, বিনোদনের ব্যবস্থাও নেই...
ঈদের দিন, পূজা, পার্বণ, বড়দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা সব উৎসব এখন গিয়ে ঠেকেছে ফাস্ট ফুডের দোকান কিংবা খাবারের অন্যান্য দোকানে। বিকেল হতে না হতেই মানুষের ঢল নামে সেইসব দোকানে।
উৎসবের দিন মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে বাসায় আয়োজন না করে বাইরে খান! কিংবা এর বাড়ি ওর বাড়ি না গিয়ে শুধুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন কাটায়। ব্যবসা ভালো হয় বটে। কিন্তু মনটা দমে যায়। কিছু নীতি, কিছু মূল্যবোধ তো রয়ে গেছে বুকের গহীন ভেতরে।
আরও পড়ুন
যুগ বদলে যাবে, বদলে যাবে যুগের চাহিদা। তবে আমরা যখন সংস্কৃতির মূল ধরে টান দেব তখন কিন্তু বিপদ। বিপদ এবং ভয়াবহতা ঢুকে গেছে ইতিমধ্যেই আমাদের সব প্রাতিষ্ঠানিক যন্ত্রে। আমাদের সময় মানে ৭০-৮০'র দশকে মোটামুটি টেলিভিশন ঘরে ঘরে ঢুকে গেছে।
উৎসবের দিনগুলোয় এই বাড়ি ওই বাড়ি ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতাম আমরা। সন্ধ্যার পর বাসায় মামা, খালা, চাচা, ফুফুদের আসা-যাওয়া। সেই সঙ্গে তুমুল হাসির গান, আড্ডা আর খাওয়া। একসাথে সবাই বসে টেলিভিশনের বিশেষ বিশেষ আয়োজনগুলো মিস করতাম না।
উৎসবের পরের দিন এই বাড়ি ওই বাড়িতে খাবারের আয়োজন। সব মামাতো-খালাতো ভাইবোনদের নিয়ে সিনেমা দেখা, ঈদে বড়দের জন্য সিনেমা রিলিজ হলেও কখনো ছোটদের জন্য সিনেমা রিলিজ হতো না। তারপর ৯০ পেরিয়ে ২০০০ মানে মিলেনিয়াম। এই সময়টায় সংস্কৃতি, আচার আচরণ, সামাজিকতা, সামাজিক, পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং ভয়ংকর মূল্যবোধের টানাপোড়েন।
আমাদের শিশু-কিশোররা করবে কী? কী করেছি আমরা ওদের জন্য? এমন কোনো একটি কেন্দ্র কি করতে পেরেছি যেখানে শিশু-কিশোররা যেকোনো উৎসব কিংবা ছুটির দিনগুলোয় গিয়ে অনাবিল আনন্দ সঞ্চয় করে আসবে? এমন কোনো কেন্দ্র কি তৈরি করতে পেরেছি আমরা, যেখানে ওরা ওদের চিন্তাগুলো নিয়ে কাজ করবে?
একটি রাষ্ট্রের জন্ম, নির্মাণ এবং এর কৈশোর যৌবনকালে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি না করে পার পেয়ে যেতে থাকলো এমপি, সচিব, মন্ত্রী আমলারা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কীভাবে তৈরি হবে, কীভাবে দেশপ্রেমের একটা মজবুত ভিত্তি তৈরি হবে এগুলো ভাবনার বাইরে থেকে গেল। অনেকেই আমার লেখা পড়ে ভাববেন আমি শুধু সোনালি অতীত নিয়েই ভাবি। আসলে তা নয়।
আমি ক্রমবর্ধমান সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে ভীষণ দুর্ভাবনায় থাকি, আতঙ্কে থাকি। আমাদের দেশের সব প্রতিষ্ঠানগুলো এর শিকার। আমাদের বিনোদন মাধ্যমগুলোও তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। বদলে গেছে বিনোদনের ভাষা।
সুস্থ বিনোদন বিতরণের জন্যও চাই সুস্থ মস্তিষ্ক। আমাদের দেশটাকে আমরা সবসময়ই শিশু রাষ্ট্র করে বানিয়ে রেখেছি। যদি তাই হয় তবে শুরু করা যাক না এখন থেকেই। তাহলে আসুন এর নির্মাণকালে আমরা 'আমার' ব্যক্তিগত জীবনের প্রলেপগুলো থেকে মুক্ত হই।
আরও পড়ুন
‘আমার' দৈনন্দিন কাজের বাইরে গোটা বিশ্ব সত্তারও অংশ আমি। লক্ষ্য রাখতে হবে প্রতিটি শিশুর ভেতরকার মনের জায়গাটুকু। বুঝতে হবে যে সবার ভেতরেই একটা সৎ ক্ষুধা আছে। নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বড়দের বিবেচনা মেলাতে পারছে না আজকের শিশু-কিশোর এবং ক্রমাগত অদ্ভুতুড়ে বৈশ্বিক চাপে আমাদের শিশুরা সংকটে।
পৃথিবীজোড়া শিশু পাঠ, শিশুর মনস্তত্ত্ব চর্চার বহু রকমের বদল ঘটে গেছে। পৃথিবী জুড়ে তার দৃষ্টান্তও কম নেই। আমরাই কেন যেন খাঁচাটা ভাঙতে পারছি না। আবার বলা যায় কোথাও কোথাও খাঁচা ভেঙে গেছে কিন্তু আবার ভুল নির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। কোনো উৎসবকেই আমরা জীবন সংলগ্ন করতে পারছি না।
মনে হয় সজীব মানুষ নেই। আছে হয়তোবা। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরিশ্রম ছাড়াই রাষ্ট্রের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে পড়া যাচ্ছে। ভারী ভারী উপাধিগুলো নামের আশেপাশে জুটিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। সবই খুব বেশি নিষ্প্রাণ। আসল কর্তব্য কাজ হাওয়ায় মিলিয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটি বড় বেশি অবসাদময় ক্লান্তিকর।
আসল প্রশ্ন হলো, আমাদের শিশু-কিশোররা করবে কী? কী করেছি আমরা ওদের জন্য? এমন কোনো একটি কেন্দ্র কি করতে পেরেছি যেখানে শিশু-কিশোররা যেকোনো উৎসব কিংবা ছুটির দিনগুলোয় গিয়ে অনাবিল আনন্দ সঞ্চয় করে আসবে? এমন কোনো কেন্দ্র কি তৈরি করতে পেরেছি আমরা, যেখানে ওরা ওদের চিন্তাগুলো নিয়ে কাজ করবে? পারিনি।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমরা আমাদের শিশু-কিশোরদের হাতে ড্রাগ এবং মোবাইলের মতো মারণাস্ত্র সার্বক্ষণিকভাবে তুলে দিয়েছি। আমাদের সন্তানেরা সেইদিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না। দায় আমাদের, উত্তরণের পথও খুঁজতে হবে আমাদেরই।
অর্থ এবং চিন্তার সুসম বরাদ্দ চাই বিনোদন মাধ্যমে, পরিকল্পনার সাথে বিজ্ঞানের যোগসূত্র এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। দলীয় এবং ব্যক্তি স্বার্থ থেকে বেরিয়ে নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানানোর উদার মানুষ প্রয়োজন। ধর্মের নামে যে জুজুভূত আমাদের কাঁধে চেপে বসে আছে তাকে নামিয়ে মুক্তচিন্তা করা প্রয়োজন।
কাকলী প্রধান ।। আলোকচিত্রী