দেশের ‘ফুসফুস’ সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগে কেন?
৪ মে ২০২৪। পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আমোরবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে। ১৯৭০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এই ৫৪ বছরে অন্তত ৪০ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবারই বন বিভাগের কর্মী ও স্থানীয় জনগণ মিলে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে থাকেন। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও এই আগুন নিয়ন্ত্রণে সাধ্যমতো কাজ করেছেন। প্রশ্ন হলো, কেন আগুন লাগে? কারা আগুন লাগায়? এর পেছনে থাকা সেই ষড়যন্ত্রকারীদের কেন ধরা যায় না? এর উত্তর অজানাই থেকে যাবে হয়তো।
৪ মে, শনিবার দুপুরে চাঁদপাই রেঞ্জে আমোরবুনিয়া এলাকায় বনে আগুনের কুণ্ডলী থেকে ধোয়া উঠতে দেখে কর্মীরা। তবে কীভাবে আগুন লেগেছে তার তথ্য কেউই দিতে পারেনি। সুন্দরবনের জেলে ও মৌয়ালদের কারণে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে অনেকেরই ধারণা।
তবে বনজীবীদের এই বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় হেলিকপ্টার থেকে পানি ছিটানো হয়েছে। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড এবং নৌবাহিনীর সদস্যরাও আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে।
আরও পড়ুন
আগুন কেমন করে লেগেছে, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর। সুন্দরবনে দুই দশকে আগুন লাগার ঘটনায় করা ২৪টি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর বেশিরভাগেই বলা হয়েছে, বনজীবীদের ফেলে আসা আগুন থেকে আগুনের সূত্রপাত।
পূর্বের তদন্ত প্রতিবেদনে বনজীবীদের ফেলে দেওয়া আগুন থেকে সুন্দরবনে আগুনের সূত্রপাত—এমন সম্ভাবনার কথা ১৫ বার উল্লেখ করা হয়েছে। জেলে ও মৌয়ালদের বিড়ি-সিগারেট বা মৌমাছি তাড়াতে জ্বালানো মশাল থেকে আগুনের সূত্রপাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ২৪ বছরে সুন্দরবনে যে ২৬ বার আগুন লাগে তাতে প্রায় ৭৫ একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে।
৪ মে ২০২৪। পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আমোরবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে। ১৯৭০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এই ৫৪ বছরে অন্তত ৪০ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
প্রতিবারই সুন্দরবনে আগুন নেভাতে ২-৩ দিন সময় লাগে আর এতে প্রতিবারই জীববৈচিত্র্য চরমভাবে হুমকিতে পড়ে এবং বিঘ্নিত হয়। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত খবরে পাঁচ একর বনভূমির জায়গা পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্থানীয়দের মতে, সুন্দরবনের এলাকাটি দিন দিন উঁচু হওয়া, নদী-খাল মরে যাওয়ার কারণে নিয়মিত জোয়ার ভাটা হয় না। সারা বছর গাছের পাতা পড়ে প্রচুর হিউমাস (Humus) তৈরি হয়, যার ফলে চৈত্র-বৈশাখ মাসে শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
হিউমাস হলো কলয়েডধর্মী জটিল জৈব যৌগ। মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ মৃত্তিকায় অবস্থিত অতি সূক্ষ্ম জীবগোষ্ঠী দ্বারা বিয়োজনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যে কালো রঙের জটিল কলয়েডধর্মী পদার্থ সৃষ্টি করে তাকে হিউমাস বলে। এর কারণে আগুন লাগার ঘটনা বাড়ে।
আরও পড়ুন
সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এই বনের ৬২ শতাংশ বাংলাদেশে এবং বাকি ৩৮ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। বর্তমানে সুন্দরবনের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের অপর নাম গুলো হলো—বাদাবন, গরান বন। এখানে প্রাণী প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫টি সরীসৃপ এবং ৮টি উভচর প্রাণী রয়েছে। সুন্দরী বৃক্ষের নামানুসারে এই বনের নাম সুন্দরবন রাখা হয়।
এখানে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল রয়েছে। জরিপ মোতাবেক ১০৬ বাঘ ও ১০০০০০ থেকে ১৫০০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়।
১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। রামসার স্থান হলো একটি জলাভূমি যা রামসার কনভেনশনের অধীনে আন্তর্জাতিক গুরুত্বের জন্য মনোনীত করা হয়েছে, যা ‘দ্য কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস’ নামেও পরিচিত।
সুন্দরবন থাকার কারণে ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের সময় উপকূলীয় অঞ্চলের জীবন ও সম্পদ বড় ধরনের ক্ষতি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। এই বনের কারণে বছরে তিন হাজার ৮৮১ কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা পায়। জীবিকার মাধ্যমে বছরে এক হাজার ১৬১ কোটি টাকার সমপরিমাণ আর্থিক সম্পদ পাওয়া যায়।
মধু, মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা, ঔষধি গাছ ইত্যাদি সুবিধাও আমরা পাই যা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখে। গাছ মানুষের যে উপকারগুলো করে তা হলো, অক্সিজেন, জ্বালানি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ, পানির ভারসাম্য রক্ষা করে, যা সুন্দরবন থেকে পাই।
২০১৪ সালে তেলবাহী একটি জাহাজ সুন্দরবনের নদীতে ডুবে গেলে অনেক এলাকা জুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়েছিল, ফলে জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। ভাসমান তেলের কারণে শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদগুলোর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হয়েছিল।
এখনো বনের ভেতর অবাধে চলছে তেল, কয়লা, রাসায়নিক সারবাহী জাহাজ চলাচল।
এই জাহাজগুলো যায় অধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের জন্য। কখনো আবার রাস্তা, রেললাইন, ব্রিজ, বাঁধ, জলাধার, খাল নির্মাণ, খনি, অরণ্য নিধন, কৃষিজমির সম্প্রসারণ, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের জন্য জাহাজ বনের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে। এতে পরিবেশ দূষিত হয়। প্রাকৃতিক বাসভূমি বা স্বাভাবিক বাসস্থান (Habitat) নষ্ট হয়।
২০১৪ সালে তেলবাহী একটি জাহাজ সুন্দরবনের নদীতে ডুবে গেলে অনেক এলাকা জুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়েছিল, ফলে জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল।
বিশ্বের সব থেকে বড় ম্যানগ্ৰোভ বন সুন্দরবন। পুরো বাংলাদেশের অস্তিত্ব বহন না করলেও বৃহত্তর খুলনা অঞ্চল হুমকির মুখে পড়বে যদি বন না থাকে, তাছাড়া ঐ এলাকার জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস নিয়মিত হওয়ার ফলে মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। খুলনা অঞ্চলের ফসল উৎপাদন বাধাগ্ৰস্ত হবে লোনা জলের কারণে।
সবদিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশের বিশাল অঙ্কের ক্ষতি হবে। জীববৈচিত্র্যের হুমকির কারণগুলো হলো, অবাধে গাছ কেটে ফেলা , পশুপাখি শিকার করা, ফসলে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা। এরই সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সুন্দরবনের বনভূমিতে ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ড।
আরও পড়ুন
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক রাজধানী সংরক্ষণ ও বর্ধিত করা এইসব বিপদ মোকাবিলা করার জন্য এবং সম্প্রদায়ের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধির জন্য একটি অসাধারণ প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান। ম্যানগ্রোভ বন ৫০-৬০ কিমি জুড়ে বাফার প্রদান করে, যা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বাতাস এবং ঝড়বৃষ্টির বিরুদ্ধে বাধা হিসেবে কাজ করে।
সুন্দরবন আমাদের শব্দ দূষণ থেকে বাঁচায়, খাবারের জোগান দেয়, কর্মক্ষেত্র তৈরি করে, ভূমিক্ষয় রোধ করে, ওষুধ তৈরিতে উপাদানে জোগান দেয়, অসংখ্য প্রজাতির আবাসস্থল বাড়ায়, বাতাস পরিষ্কার রাখে, বনকে ঘিরে কয়েক কোটি মানুষ বসবাস করে, আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে, আমাদের শীতল রাখে, অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সংরক্ষণাগারের কাজ করে।
সুন্দরবনে আগুনের ঘটনায় দেশের বিশিষ্ট ১১ নাগরিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ৮ মে এক বিবৃতিতে তারা এই উদ্বেগ জানান। শুধু দেশের বিশিষ্ট নাগরিক কেন, সাধারণ মানুষও সুন্দরবনের গুরুত্ব বোঝে, বোঝে না শুধু সরকার। না হয় এতবার আগুন লাগার ঘটনায় কেন দোষীদের খুঁজে বের করা গেল না? কেন সুন্দরবনের ওপর দিয়ে সব উন্নয়ন প্রকল্প নিতে হয়? কেন সুন্দরবন ধ্বংসের ছক কাটা হয়? এইসব প্রশ্নের উত্তর জরুরি। আরও জরুরি ৫৪ বছরে যতবার, যাদের কারণে আগুন লেগেছে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া। তবেই এর সমাধান মিলবে।
সমীরণ বিশ্বাস ।। কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
[email protected]