পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন : মুসলিম ভোটের উপাখ্যান
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বরাবরের মতোই মুসলিম ভোট ব্যাংকই ফলাফলের ক্ষেত্রে আবারও মূল কারণ হতে পারে। বিগত কয়েক দশক ধরে মুসলমানদেরকে বামফ্রন্টের একটি বড় ভোট ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হতো, যা নিয়ে টানা ৩৪ বছর ধরে সিপিএম বাংলায় শাসন করেছিল।
কংগ্রেস দেশের বাকি অংশে মুসলিম পন্থী বিভিন্ন ধরনের প্রচারণার পরেও মুসলিমদের বাম-আনুগত্য ভাঙতে পারেনি। তবে পশ্চিমবঙ্গে এবারের ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন ঐতিহাসিক হতে চলেছে কারণ সিপিএম নয় ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
কয়েক বছর আগে, রাজ্যটিতে বিজেপির শক্তি একদম তলানিতে ছিল, তবে ২০১২ সালের লোকসভা নির্বাচনে হিন্দুরা ৪০ শতাংশের বেশি ভোট দিয়েছে। বিজেপির উত্থানের সাথে হিন্দুত্ববাদ জড়িয়ে আছে তাই পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের মধ্যেও যে একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে তা সহজেই লক্ষ্য করা যায়।
১৯৯৪ সাল থেকে এখানে থাকার সুবাদে একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে খুব কাছ থেকে ভারতের সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবারতন্ত্র, সংস্কৃতি, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক এবং আরও নানান বিষয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ করে আসছি। আমি খুব আশ্চর্যের সাথে দেখছি যে, কীভাবে রাজনৈতিক কারণে সামাজিক সম্পর্কগুলো বদলে যাচ্ছে।
আমি অন্তত চার থেকে পাঁচটি লোকসভা ও রাজ্যসভার নির্বাচন দেখেছি। আমি যখন প্রথম পশ্চিমবঙ্গে আসি তখন সিপিএম সরকার রাজ্য ক্ষমতায়। দেখে ভালো লাগতো বিজেপির মতো একটি প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্ববাদী দল রাজ্যে একটি বা দুটি মাত্র আসন পায়। আর হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক সুন্দর স্বপ্নের মতো এক ভিন্ন মাত্রায় অবস্থান করতো। সময়ের সাথে সাথে সব বদলে গেছে।
মোদি সরকার আসার পর যে বিষয়গুলো মুসলিমদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তুললো তা হলো, সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন সৃষ্টি করার নানান কৌশল গ্রহণ করা। নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন, জাতীয় নাগরিক নিবন্ধক এবং জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধক (সিএএ-এনআরসি-এনপিআর) এর এজেন্ডার মতো বিষয়কে সামনে এনে মুসলমানদের এক ধরনের হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। আর এর ভিত্তিতে ভর করে বিজেপি বাংলাদেশ থেকে এই রাজ্যে অবৈধ অভিবাসীদের প্রচুর আগমন হয়েছে তার একটা পাকা দলিল দেশের হিন্দুদের কাছে তুলে ধরতে চাইছে।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় ২৭ শতাংশ মুসলমান ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে, রাজ্যে মুসলিম ভোটগুলো টিএমসির পেছনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে, যদিও আগে এমনটি ছিল না।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ গলা উঁচু করে বলছেন যে, পশ্চিমবঙ্গে এক কোটিরও বেশি অবৈধ মুসলিম অভিবাসী রয়েছেন, যেটা এমন একটি রাজ্য যেখানে মোট জনসংখ্যা ১০ কোটিরও কম। তিনি জোর দিয়ে বলছেন, তার দল এনআরসি মহড়া শেষ হলে তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বিজেপি আরও জঘন্যতর ও ভিন্ন ধরনের কৌশলগত প্রচারে বলছে যে, মুসলমানদের প্রচুর সন্তান রয়েছে এবং শিগগিরই তারা রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার যে সুবিধাগুলো সরবরাহ করে তার একটি বৃহৎ অংশ পায় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক যাতে তাদের তুষ্টি রয়েছে এবং এটাই বিজেপি সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র হিসেবে এবারের নির্বাচনে ব্যবহার করছে।
কয়েকটি সংস্থার প্রাথমিক জরিপের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসকে পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরুদ্ধে অনেকটা এগিয়ে আছে দেখাচ্ছে ঠিকই, তবে আগামী কয়েক দিনই ভারতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় যা রয়েছে সেই মোতাবেক এখনকার অনেক কিছুই হয়তো বদলে যেতেও পারে।
টিএমসির ধারণা, এটি দ্বি-পথের লড়াই, কারণ রাজ্যে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন ছিল খুব বেশি নাটকীয়। টিএমসি ও বিজেপির মধ্যে ভোট ভাগের পার্থক্য ছিল মাত্র ৩.১ শতাংশ, বিজেপি ১৮টি আসনে জয় লাভ করেছিল। অথচ এই বিজেপিই ২০১৪ সালে জিতেছিল মাত্র দুটি আসন।
বিজেপিকে ঠেকানোর জন্য অবশ্য এবার কিছু চমকও দেখা যাচ্ছে। যে কংগ্রেস এবং বাম দলগুলো স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছিল জাত শত্রু তারা এবার কিছু মুসলিমদের নিয়ে নতুন গজিয়ে ওঠা ইন্ডিয়ান সেকুলার পার্টির (আইএসপি) সাথে জোট বেঁধেছে। কলকাতার ব্রিগেড মাঠে ঐতিহাসিক জনসভার মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শনও করেছে এই জোট।
কংগ্রেস এবং সিপিএম এক হয়ে যাওয়া নিয়ে গত ৭ই ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড মাঠের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্যঙ্গ করে আধা বাংলায় বলেন, সিপিএম ক্ষমতায় থাকার সময় বলতো কংগ্রেসের কালো হাত ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও। কোথায় গেলো সেই কালো হাত? এখন সব সাদা হয়ে গেছে।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় ২৭ শতাংশ মুসলমান ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে, রাজ্যে মুসলিম ভোটগুলো টিএমসির পেছনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে, যদিও আগে এমনটি ছিল না। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মুসলিম ভোটের ৪৫ শতাংশ বাম দলগুলো, ২৫ শতাংশ কংগ্রেস এবং ২২ শতাংশ ভোট টিএমসির পক্ষে পড়েছিল।
বাম এবং টিএমসির মধ্যে মুসলিম ভোটের পার্থক্য ২০১১ সালে বামদের পক্ষে ৭ শতাংশে নেমেছিল এবং ২০১৪ সাল থেকে এই সংখ্যার তরঙ্গটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে ঘুরে গিয়েছিল। সে বছর লোকসভা নির্বাচনে, টিএমসি পশ্চিমবঙ্গে ৩৪টি আসন জিতেছিল, যা মোট মুসলিম ভোটের প্রায় ৪০ শতাংশের মতো ছিল, যদিও বাম এবং কংগ্রেস মিলে (তারা পৃথকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল) ভোট পেয়েছিল ৫৫ শতাংশ।
পশ্চিমবঙ্গে কোনো দলের পক্ষে মুসলমানদের উপেক্ষা করা এবং নির্বাচনী লড়াইয়ে জয়লাভ করা সহজ নয়। বিজেপি ২০১৩ সালের বেঙ্গল পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৩০ শতাংশ শক্তিশালী মুসলিম ভোটের জন্য মুসলিম সম্মেলনও করেছে।
২০১৬ সালে যখন পশ্চিমবঙ্গে বাম ও কংগ্রেস আনুষ্ঠানিক জোট বেঁধে ছিল, তখন তাদের মুসলিম ভোটের সম্মিলিত সংখ্যা ৩৮ শতাংশে নেমে যায় এবং টিএমসির মুসলিম ভোট সংখ্যা ৫১ শতাংশে উন্নীত হয়। ২০১২ সালের লোকসভা নির্বাচনে টিএমসির পক্ষে মুসলিম ভোটের এই অংশটি আরও বেড়ে প্রায় ৭০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাম এবং কংগ্রেস যথাক্রমে ১০ শতাংশ এবং ১২ শতাংশ মুসলিম ভোট পেয়েছিল। অন্যান্য কিছু মুসলিম দল বা বিজেপির কাছে ছিল মাত্র ৮ শতাংশ ভোট।
তবে বিজেপির উত্থানের সাথে, টিএমসিকে একটি সমস্যার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তা হলো, বিজেপি যেভাবে রাজ্য জুড়ে তার নিজস্ব হিন্দু ভোটের ভিত্তিকে একীভূত করেছে তা কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস করতে পারছে না। হাওড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা সহ পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা যদি ১২৫ আসনের মধ্যে অন্তত ৯০টিতে শক্তিশালী উপস্থিতি নিয়ে একটি ব্লকের মতো করে টিএমসিকে ভোট দিতো তাহলেও বিজেপির এই উত্থানটা এত সহজ হতো না। বিজেপি যতই সফলভাবে ওবিসি, তফশিলি জাতি এবং তফশিলি উপজাতি সহ হিন্দুদের কাছাকাছি একটি বৃহৎ পরিমণ্ডল তৈরি করতে সক্ষম হোক না কেন।
এবারের তথ্যমতে, বাংলার প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটার রাজ্যের ২৯৪টি আসনের মধ্যে প্রায় ১০০টিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভূমিকায় রয়েছেন। ২০১০ সাল থেকে বাংলায় মুসলিম ভোটাররা টিএমসির মূল ভোট ব্যাংক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে বাম এবং কংগ্রেসের পাশাপাশি, বিজেপিও এখন মুসলিম সম্প্রদায়কে তার ভাগে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
পশ্চিমবঙ্গে কোনো দলের পক্ষে মুসলমানদের উপেক্ষা করা এবং নির্বাচনী লড়াইয়ে জয়লাভ করা সহজ নয়। বিজেপি ২০১৩ সালের বেঙ্গল পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৩০ শতাংশ শক্তিশালী মুসলিম ভোটের জন্য মুসলিম সম্মেলনও করেছে। বিজেপি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের ৮৫০টিরও বেশি লোককে টিকিট দিয়েছে, যেখানে ২৭ জন জিতেছিল।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ছয়জন মুসলিম প্রার্থীকে মাঠেও নামিয়েছিল। তাই তো বিজেপি সংখ্যালঘু ফ্রন্টের রাজ্য সভাপতি আলী হোসেন বলেছেন, কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোটারদের সমর্থন নিয়ে শাসন করেছে এবং টিএমসি দশ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। তা সত্ত্বেও, রাজ্যে মুসলমানদের অবস্থা একই রয়েছে।
টিএমসি নিজেই রাজ্যের সংখ্যালঘুদের একমাত্র অভিভাবক হিসেবে দাবি করতে পারে না। তিনি বলেছিলেন যে, গত দশ বছর ধরে টিএমসি মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য কোনো কাজই করেনি এবং কেবল ইমামদের অনুগত হওয়া এই সম্প্রদায়ের লোকের কোনো সহায়ক হতে পারে না।
বিজেপি কেবল স্লোগান দেয় না বরং সবার সাথে এবং সবার বিকাশের প্রাথমিক মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে যায়। বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ও এই সত্যটি বোঝে এবং আগামী বছরের নির্বাচনে বিজেপি তাদের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠবে। তাইতো ভোটের আগের এই নাটকীয় কথাগুলো বিজেপিকেও বাধ্য করছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম ভোটারদের মন গলাতে কিন্তু আমার বিশ্বাস মুসলিম ভোটাররা তাদের ভালোটা নিশ্চয়ই বোঝে।
নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক ও গবেষক