বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা
৩০ এপ্রিল ২০২৪ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ২৬ বছর পূর্ণ করে ২৭তম বছরে পদার্পণ করেছে। বিগত কয়েক দশক ধরে দেশ-বিদেশে চিকিৎসা সেবা ও গবেষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এক অনন্য নাম। উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষাতেও রেখেছে বড় অবদান।
এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসটি এমন এক সময়ে উদযাপিত হচ্ছে যখন প্রখ্যাত চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এই গুণী শিক্ষক ও চিকিৎসককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দানের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নব জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে।
উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা ও স্বাস্থ্য গবেষণা কার্যক্রম আরও জোরদার ও উন্নত করার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করার বিষয়ে নবনিযুক্ত উপাচার্য সফল হবেন বলে বিশ্বাস করি। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অনুষ্ঠান যা-ই পালন করা হোক না কেন তা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো উন্নত সেবা ও গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। আর সেইটাই ২৭তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অঙ্গীকার।
আইপিজিএমএন্ডআর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার জন্য স্বাধীনতা পূর্ব ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন আইপিজিএমএন্ডআর-কে গবেষণা করার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
আরও পড়ুন
স্মাতকোত্তর শিক্ষার ক্ষেত্রে আইপিজিএমএন্ডআর-কে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে শাহবাগে স্থানান্তর করা হয় তখন শয্যা সংখ্যা ছিল ৩০০। বঙ্গবন্ধু শয্যা সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন আইপিজিএমএন্ডআর-এ কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের উদ্বোধন করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’। বাস্তবেই বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা সেবার আশা-ভরসা ও আস্থার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়।
চিকিৎসা শিক্ষা
তৎকালীন আইপিজিএমএন্ডআর এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ৭টি কোর্স দিয়ে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমডি, এমএস, এমপিএইচ, এমফিল, ডিপ্লোমাসহ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিষয়ের সংখ্যা ১০৬টি। রেসিডেন্সি কোর্সের সংখ্যা ৭০টি। অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজ ও ইন্সটিটিউটের সংখ্যা ৫৪টি। অনুষদের সংখ্যা ৭টি। বিভাগের সংখ্যা ৫৭টি। রয়েছে ইনস্টিটিউট অফ পেডিয়াট্রিক নিউরোডিসঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)।
বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিবছর ৮ শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন এবং প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত থাকছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। দেশের শিক্ষার্থী ছাড়াও নেপাল, ভারত, বতসোয়ানা, সোমালিয়া, ইরান, কানাডা, মালদ্বীপ, অস্ট্রেলিয়া, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীগণ লেখাপড়া করছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। চালু করা হয়েছে বহুল প্রত্যাশিত পিএইচডি প্রোগ্রাম।
স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা দিবস নিয়মিত পালিত হচ্ছে। প্রতি বছর শিক্ষক, শিক্ষার্থীকে গবেষণা মঞ্জুরি প্রদান করা হচ্ছে। গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ইম্পিরিয়াল কলেজ অব লন্ডন, ভারতের মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল সেন্টার, সুইজারল্যান্ডের জুরিখ ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড হসপিস অ্যান্ড প্যালিয়েটিভ কেয়ার এলায়েন্স, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রকফেলার ফাউন্ডেশন, জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
আরও পড়ুন
করোনা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টে নির্ধারণে ও টিকার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বিশ্বমানের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এই বিষয়ে একাধিক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। খাদ্যে ক্ষতিকারক উপাদানের উপস্থিতি (ফুড হ্যাজার্ড) নিয়ে, পুষ্টি বিষয়ে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমানের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কার্যকর উপায় ও ভ্যাকসিনসহ ওষুধ আবিষ্কারের সুযোগ রয়েছে। এটা করা সম্ভব হলে বিশ্বব্যাপী শতকোটি মানুষ ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে।
বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণসহ বিভিন্ন কারণে নিত্যনতুন ভাইরাস ও বহু দিনের পুরাতন প্রাণঘাতী ভাইরাস সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। তাই স্বাস্থ্যসেবায় গবেষণার বিকল্প নেই। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরাট উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গবেষণায় বরাদ্দ আরও বৃদ্ধি পেলে এক্ষেত্রে গবেষণার মানোন্নয়নে আরও অগ্রগতি হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে গড়ে ২০ লক্ষাধিক রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকেন। প্রতি বছর মেজর ও মাইনর অপারেশনসহ কমপক্ষে ৫০ হাজার রোগীর অপারেশন করা হয়। বহির্বিভাগে প্রতিদিন নতুন পুরাতন মিলিয়ে ৮০০০ রোগী চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। বৈকালিক স্পেশালাইজড আউটডোরে প্রতিদিন ১০০০ রোগী সেবা গ্রহণ করছেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা প্রায় ২০০০টি, এরমধ্যে অর্ধেকই দরিদ্র রোগীদের জন্য বিনা ভাড়ার শয্যা। এইসব শয্যাতে ভর্তিকৃত রোগীদের ২৪ ঘণ্টাই সেবা দেওয়া হচ্ছে। এখানে রয়েছে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা।
আরও পড়ুন
রেডিওথেরাপি, পেট স্ক্যান, এমআরআই, সিটিস্ক্যান ও টিস্যু বায়োপসি’র মতো ব্যয়বহুল পরীক্ষাও এখানে তুলনামূলকভাবে কম খরচে আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ মেশিনের মাধ্যমে করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালসহ ৫ সহস্রাধিক জনবল নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়।
উল্লেখযোগ্য সাফল্য
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য ও উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে; ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) প্রতিষ্ঠা, শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের শিশুদের জন্য কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট কার্যক্রম, শিশু হৃদরোগীদের জন্য চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষা কার্যক্রম, অত্যাধুনিক আইসিইউ, এনআইসিইউ ও ওটি কমপ্লেক্স চালু, সর্বাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলেরেটর মেশিন চালু, বীর মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা সেল গঠন, সেন্টার অব এক্সিলেন্স প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন ইত্যাদি।
চ্যালেঞ্জ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামীদিনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল স্থাপনের উদ্দেশ্য সফলভাবে বাস্তবায়ন করা। দক্ষ লোক নিয়োগের মাধ্যমে বেতার ভবনে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল-২ নির্মাণ সফলভাবে বাস্তবায়ন করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা ও গবেষণাকে গতিশীল করতে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস কার্যক্রম চালু করা, রেসিডেন্ট চিকিৎসক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীদের আবাসিক সমস্যার সমাধান করা, সাধারণ জরুরি বিভাগকে পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করা, বহির্বিভাগে আসা রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তি সহজতর করা, রোগীদের বিভিন্ন ধরনের টেস্ট বা পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।
চিকিৎসা শিক্ষার পাশাপাশি বিশ্বমানের প্রশিক্ষক দিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করাও প্রয়োজন। এক্ষেত্রে দেশি বিদেশি স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের যুক্ত করতে পারলে বিশ্বমানের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির পথটা অনেক সহজ হবে।
ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ।। অধ্যাপক রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও উপ-উপাচার্য (একাডেমিক), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়