দাবদাহে করণীয় কী?
২০২৪ সালের মার্চ থেকে তীব্র দাবদাহের আগমন ঘটে। দুই বছরের মতো দাবদাহ এবারও অসহনীয় হয়ে উঠেছে। দিনে কড়া রোদ আর কদাচিৎ কালবৈশাখী ঝড়-শিলাবৃষ্টি কিন্তু গরম কমছে না। মনে হয় বলি—‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’।
জনজীবন এখন অতিষ্ঠ। ঢাকায় গরম বেশি। অনেকেই বলছেন, ছয় দশকে ঢাকায় অসহনীয় গরম বেড়েছে তিনগুন। তাই ঢাকার বাইরে বড় শহরগুলোয় দুঃসহ গরমের কাল আরও অনেক বেড়েছে। আবহাওয়াবিদরা গ্রীষ্মকালে দুঃসহ গরমের কাল আর অপেক্ষাকৃত আরামের সময় এই দুটো ভাগে চিহ্নিত করেছেন তাপমাত্রার ভিত্তিতে।
যে এলাকায় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ৭০ থেকে ৯০ একে বলা হচ্ছে দুঃসহ গরমের কাল আর যে এলাকায় তাপমান ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি আর আর্দ্রতা ৫০ শতাংশের কম একে বলা হয় আরামদায়ক দিন। বাংলাদেশে ৬০ বছরে তাপমান, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল ক্রমেই হচ্ছে উত্তপ্ত। রাজধানীসহ দেশের মধ্যাঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকা দক্ষিণাঞ্চলে ঝড় জলোচ্ছ্বাসের ওপর বাড়ছে উষ্ণতা। বছরে দশমিক ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে তাপমাত্রা বাড়ছে আর আর্দ্রতা বাড়ছে দশমিক ৩ শতাংশ। আর কষ্টের তীব্রতা বেড়েছে দশমিক ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
২৯ মার্চ ২০২৪ বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, মিশর, ইরাকের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল আরবান ক্লাইমেট-এ। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ৪০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
ঢাকার কথায় যদি ধরি কী কারণে এত তাপ এই নগরীতে? ২ কোটির বেশি লোকের বাস মহানগরীতে। মানুষ তাই এমন তাপমাত্রা অনুভব করছে। আর ক্রমেই বাড়ছে নগরায়ন। বহুতল ভবনও বাড়ছে। এসব কাঠামো তাপ শোষণ আর বিকিরণ করে, একে বলে আরবান হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট।
নগরে বাড়ছে ট্রাফিক আর শিল্প কারখানা তার থেকেও আসছে উত্তাপ। কমে আসছে সবুজ বনানী। ঢাকায় এর প্রভাব বেশি, ঢাকায় বৃক্ষ শোভিত এলাকা কম, গাছপালা বেশি থাকলে তা দেয় ছায়া আর প্রস্বেদনের মাধ্যমে আর্দ্রতা আনে। বৃক্ষ রাজি কমে যাওয়ায় তাপমাত্রা তাই বেশি বেড়েছে।
বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল ক্রমেই হচ্ছে উত্তপ্ত। বছরে দশমিক ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে তাপমাত্রা বাড়ছে আর আর্দ্রতা বাড়ছে দশমিক ৩ শতাংশ...
দরিদ্র বসতিতে প্রায় থাকে ঢেউতোলা টিনের ছাদ যা তাপ শোষণ করে আর তাপ ধারণ করে এতে সেইসব আবাসস্থল হয় আরও উত্তপ্ত আর সঠিকভাবে এর অন্তরণ বা ইন্সুলেশন না থাকায় তাপমাত্রা আরও বাড়ে, উষ্ণতাপ স্রোত আর জলবায়ু পরিবর্তন। বাংলাদেশও অন্যান্য দেশের মতো শিকার হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের।
২০১৮-২২ এই সময়ের মধ্যে তাপমান বেড়েছে দশমিক ৯ করে। ১৬ এপ্রিল ২০২৪ চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০.৬ ডিগ্রি উঠেছে। বাংলাদেশ এমন সব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আর পরিণতি সম্বন্ধে অবহিত। বিরূপ পরিবেশ, ঝড়, ঝঞ্ঝা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, প্লাবনের সাথে লড়াই করছে বাংলাদেশের জনগণ। লড়াকু মানুষ এরপর টিকে থাকে, বাঁধে নতুন ঘর। গড়ে নতুন জীবন।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ সরকার একে প্রতিহত করার জন্য নিয়েছে পদক্ষেপ। তৈরি করা হয়েছে সাইক্লোন শেল্টার আর আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা। এতে ভঙ্গুর জনগোষ্ঠী বাঁচাতে পারবে প্রাণ আর আগাম জেনে নিতে পারবে ব্যবস্থা প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে।
উপকুল করা হচ্ছে আরও নিরাপদ। তীব্র দাবদাহ আর হাঁসফাঁস গরমে জনজীবন নানাভাবে বিপর্যস্ত আর সেই সাথে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। তীব্র দাবদাহে হঠাৎ ক্লান্তি, অতিরিক্ত ঘাম আর জ্ঞানশূন্য হওয়ার মতো পরিস্থিতি হতে পারে। ঘামের সাথে শরীর থেকে বেরিয়ে যায় অনেকটা নুন। কেবল পানি পান করে হয় না।
শরীর থেকে ইলেট্রলাইটও বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই কারও কারও পেশিতে পড়ে টান। কেউ হন খুব দুর্বল। খুব ক্লান্তি লাগে। তাই সেইসময় লবণ চিনির জল বা ওরস্যালাইন খেলে অনেকটা সামাল দেওয়া যায়।
হাই প্রোটিন, তেলে ভাজা এবং যেকোনো রঙিন পানি এড়িয়ে চলুন। রাস্তার ধারের কাটা ফল, আচার, জাঙ্ক ফুড এসব খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
আবার প্রচণ্ড গরমে কাজ করতে করতে অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তা কেবল তাপ নিঃশেষন বা Heat exhaustion নয়। বাইরের আবহাওয়ার সঙ্গে সমতা বজায় রাখার জন্য আমাদের মগজে একটি থার্মোস্ট্যাট (Thermostat) আছে অবকক্ষ বা হাইপোথ্যালামাস (Hypothalamus) নামে মগজের এক এলাকায়।
যেমন ধরা যাক, কেউ তীব্র গরম থেকে এসেই ঢুকে পড়লেন শীতল কক্ষে বা পান করলেন ফ্রিজের ঠান্ডা জল। তাহলে কী হবে? শরীরের তাপমাত্রার যে হেরফের হলো এতে মগজের থার্মোস্ট্যাট তাল মেলাতে পারে না। হঠাৎ করেই দেহের সব কলকব্জা বন্ধ হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। একে বলে হিট স্ট্রোক। এই সময় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া জরুরি।
বিপর্যয় এড়াতে কী করা যাবে?
দুপুরের চড়া রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। কিন্তু বাড়িতে তো বসে থাকা যাবে না, তাই কী করা যাবে? দুপুর ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত যতটা সম্ভব ছায়ায় নয়তো অফিস বা বাসায় অবস্থায় করতে হবে।
আরও পড়ুন
দুপুরে বাড়িতে পর্দা দিয়ে রোদ আটকাতে হবে। আর রাতে জানালা খুলে ঘুমাতে হবে। যদি বোঝা যায় হিট স্ট্রোক হয়েছে তাহলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। আর ইতিমধ্যে যতক্ষণ না চিকিৎসা হচ্ছে ততক্ষণ তাকে ছায়ায় শুয়ে রাখা বা ভেজা রুমাল দিয়ে গা, হাত-পা মুছে দিতে হবে। শরীর আর মাথায় জল দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
চড়া রোদে শরীর ঠিক রাখতে কিছু নিয়ম পালন করা উচিত—
দিনে কমপক্ষে তিন লিটার জল পান করতে হবে। বাইরে বের হলে ডাবের জল ও আর স্যালাইন খেতে হবে। বারবার ঠোঁট, মুখ শুকিয়ে আসা, মাথা যন্ত্রণা ক্লান্তি এসব হলো ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ। এমন লক্ষণ দেখলে হতে হবে সতর্ক।
দুপুর ১২ টা থেকে তিনটা রোদ এড়িয়ে ছায়ায় থাকুন। যদি বের হতেই হয় তাহলে সঙ্গে ছাতা নিন। হলকা ঢোলা সুতির জামা পরুন, চোখে পরুন রোদ চশমা।
বাইরে থাকলে মাথা, ঘাড়, মুখে ভেজা রুমাল ব্যবহার করুন তা না থাকলে সঙ্গে নিন ওয়েট ওয়াইপস। গরমের সময় তিন থেকে চারবার স্নান করুন।
শরীরে যেন ঘাম না বসে সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। চড়া রোদ থেকে এসেই এসি চালানো ঠিক না। অনেকে ১৬, ১৮ বা ২০ টেমপারেচারে এসি চালান তা ঠিক না বরং ২৪ টেমপারেচারের উপরে চালান ২৭ ডিগ্রির উপর থাকলে আরও ভালো।
হাল্কা সুতি জামা পরবেন। কালো গাঢ় নীল, সবুজ রঙ এড়িয়ে চলুন।
হাই প্রোটিন, তেলে ভাজা এবং যেকোনো রঙিন পানি এড়িয়ে চলুন। রাস্তার ধারের কাটা ফল, আচার, জাঙ্ক ফুড এসব খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
এই সময় পেটের অসুখ বেশি হয়। তাই ঘরের রান্না করা খাবারই খান।
মৌসুমি ফল, টক দই, মাঠা, ডাবের জল, মাছের তেল, মশলা কম ঝাল সবজি খাবেন। তেল চর্বিযুক্ত খাবার বর্জন করুন।
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ