চৈত্রের পরে এলো বৈশাখ
চৈত্র মাস মানেই বছর শেষ, বৈশাখের প্রথম দিন নতুন বর্ষকে আনন্দময় করার এক ঝুড়ি উচ্ছলতা নিয়ে নতুন বছরের অপেক্ষা। বৈশাখ বরণ করার যত আয়োজন তার সবগুলোর প্রক্রিয়াই রঙিন। চৈত্র সংক্রান্তি আসার দিনটি এখনো আমার কাছে ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা’র সময়। ঘরদোরের ঝুল ঝেড়ে মুছে এক নিরামিষ দিন।
চৈত্র সংক্রান্তি মানেই বছরের অসুখ বিসুখ ঝেড়ে ফেলে নতুন বছর বরণ করার আয়োজন। চৈত্র মাসের শেষ দিকে, ঝাঁ চকচকে রোদের দিনগুলোয় আম-বরই টক খাওয়ার অভ্যাস সেই ছেলেবেলার।
এই সময়ে চারুকলায় ঘুরে ঘুরে মঙ্গলযাত্রার যত কারুকাজ, মুখোশ, ফেস্টুন, মাটির সরায় গাজীর পট দেখার শ্রেষ্ঠ সময়। চৈত্র সংক্রান্তির রাতের আগেই চারুকলা, বিশ্ববিদ্যালয়, সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন মহল্লার রাস্তাগুলো রঙিন আলপনায় সাজসজ্জা, এক অভাবনীয় দৃশ্যপট।
আরও পড়ুন
নববর্ষ, অসাম্প্রদায়িক বাংলার অনন্য এক অপূর্ব উৎসব। স্বাধীন বাংলাদেশে সব সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে নতুন বছরকে স্বাগতম জানানোর প্রথা যুগ যুগ ধরেই চলে এসেছে। কারও সাথে কটু কথা বলা বা ঝগড়া বিবাদ করা যাবে না এই দিন।
রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু বছরের প্রথম দিন। এরপর চারুকলা থেকে মঙ্গলযাত্রা শেষে বৈশাখী মেলায় ভরপুর দেশীয় জিনিসের কেনাকাটা। সত্য বলতে, কোনটা ছেড়ে কোন আয়োজনে যোগ দেবো, তা ভাবতেই সময় যায় চলে।
নববর্ষ, অসাম্প্রদায়িক বাংলার অনন্য এক অপূর্ব উৎসব। স্বাধীন বাংলাদেশে সব সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে নতুন বছরকে স্বাগতম জানানোর প্রথা যুগ যুগ ধরেই চলে এসেছে।
এই দিনে যা ভালো কাজ করবো, শুনবো বা দেখবো তাই ফিরে ফিরে পুরো বছর জুড়ে আসবে, দিদা বলতেন সবসময়। নতুন বছর, বৈশাখের প্রথম দিন নতুন করে পথ চলার শুরু। সকালে নতুন জামা কাপড়, খাবারে সব ভালো পদ, সবাই মিলে একসাথে খাবার খাওয়া, ফুল দিয়ে ঘর সাজানো, বই পড়ার মতো রঙিন আয়োজন।
বৈশাখ আসবার আগেই বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন হালখাতা খুলবার আয়োজনের কার্ড আসতো, দুলাল চন্দ্র মামার স্বর্ণালংকার দোকান থেকে। বিকেলে মামি-খালাদের সাথে লাল সাদা কাপড় আর শাড়িতে সাজগোজ করে আমরা সেইখানে যেতাম।
আরও পড়ুন
কখনো কখনো গত বছরের বকেয়া মিটিয়ে দিতেন আবার মামি বা খালা গহনার অর্ডার করতেন। নতুন হালখাতায় সে হিসাব তোলা হতো আর দোকান থেকে আমাদের খেতে দিতেন বড় বড় রসগোল্লা। আমার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল সেই মিষ্টি খাওয়ার লোভ।
নববর্ষের বিশেষ আকর্ষণ ছিল দিদার হাতে রান্না করা সকালবেলার নাস্তায় গুড়ের পায়েস। দুপুরে থাকতো বড় মাছের দুই তিন রকমের পদ। আর রাতে মামা-খালাদের বন্ধুরা আসতো, একসাথে গানবাজনা আর পোলাও রোস্ট খাওয়ার ধুম।
দুই যুগের বেশি ধরে আমাদের এই উৎসবগুলোয় নানা বিধিনিষেধ এসেছে। চিরচেনা সেই উৎসবগুলো বড্ড বেমানান দেখায় তাই। সবচেয়ে বেশি বাঁধা এসেছে বাংলা নববর্ষ বরণের উৎসবে।
আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এই বিশেষ দিনটিতে তাদের সর্বোচ্চ খরচ করতেন। সকালের সেই পায়েস দিয়ে শেষ হতো আমাদের বর্ষবরণ উৎসব।
দুই যুগের বেশি ধরে আমাদের এই উৎসবগুলোয় নানা বিধিনিষেধ এসেছে। চিরচেনা সেই উৎসবগুলো বড্ড বেমানান দেখায় তাই। সবচেয়ে বেশি বাঁধা এসেছে বাংলা নববর্ষ বরণের উৎসবে। ধর্মীয় বেড়াজালে আটকে ফেলা হয়েছে এর গতি।
আরও পড়ুন
মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ বা প্রাণীর প্রতিকৃতি ইসলামী শরীয়তবিরোধী বলা হয়েছে বারবার। উগ্রবাদী ধর্মীয় সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধে এই মিছিলের সময় বেঁধে দেওয়া এবং বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ে পালনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণি নির্বিশেষে বর্ষবরণ উৎসবকে উগ্র ধর্মীয় মতবাদের কারাগারে ঢুকানো হয়েছে। বর্ষবরণ কোনোদিনই নির্দিষ্ট কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর উৎসব নয়। এটা সর্বজনীন এবং দেশীয় ঐতিহ্যময় এক কৃষ্টি।
সময় ধরে খুব সূক্ষ্মভাবে সব নাগরিকের আনন্দ উৎসবের দিনটিকে নেতিবাচক ভাবনার বাক্সতে বন্দি করা হয়েছে। এখান থেকে বের হতে হলে খুব শক্ত ভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকা অপরিহার্য।
যুগ যুগ ধরে প্রজন্ম হতে প্রজন্মে দেশীয় কৃষ্টি সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য ধরে রাখার হাল আমাদের সবার উপরে বর্তায়। নিজস্ব অস্তিত্ব, পরিচয়, গৌরব রক্ষা করার জন্য নিজেকে এগিয়ে আসতে হবে। চৈত্র সংক্রান্তি এবং নববর্ষ উদযাপন আবারও নিজস্ব ধারায় ফিরে আসুক, এই কামনায় অপেক্ষা রইলো।
শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা