হেফাজত অনুসারী আওয়ামী নেতাদের চিহ্নিত করবে কে?
গেল বছর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে নিয়ে শঙ্কিত। লেখালেখির কারণে শঙ্কার পরিমাণ আরও বেড়েছে। ডিজিটাল সুবিধা ব্যবহার করে কেউ কেউ আবার হুমকি-ধামকিও দিলেন। আমার অপরাধ কি ছিল জানেন? মামুনুল হক যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিলেন, তখন আমি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আস্ফালনের বিরুদ্ধে কলাম লিখেছিলাম। দেশবিরোধী আনুগত্যহীন তৃতীয় পক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী মামুনুল হকের হুংকার বন্ধে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কলম ধরেছিলাম। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হুমকির বিপরীতে সমমনাদের নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম।
আমাকে নিয়ে যারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলেন তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ, বিনয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা ক্ষোভ কাজ করলেও মোটেও বিস্ময়ে অবাক হইনি। অবাক বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়েছি তখনই, যখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস আর হাতেগোনা ক’জন আওয়ামী লীগ নেতা ছাড়া সবাইকে নীরব দেখেছি। যখন কোনো এক আওয়ামী লীগ নেতা ফোন করে বলেছিলেন, ‘মামুনুল হুজুর তো তোমার কোনো ক্ষতি করেননি, উনাকে নিয়ে না লিখলেই খুশি হবো’ তখনই আতঙ্কিত হয়েছি। এ আতঙ্ক আমার কোনো ব্যক্তি জীবনের শঙ্কা নয়। অসাম্প্রদায়িক সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলার পথে দ্রুতগতিতে ধাবমান প্রিয় দেশটিকে গুড়িয়ে দেওয়ার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়ার শঙ্কা।
আওয়ামী লীগ নেতা ফোন করে বলেছিলেন, ‘মামুনুল হুজুর তো তোমার কোনো ক্ষতি করেননি, উনাকে নিয়ে না লিখলেই খুশি হবো’ তখনই আতঙ্কিত হয়েছি। এ আতঙ্ক আমার কোনো ব্যক্তি জীবনের শঙ্কা নয়। অসাম্প্রদায়িক সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলার পথে দ্রুতগতিতে ধাবমান প্রিয় দেশটিকে গুড়িয়ে দেওয়ার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়ার শঙ্কা।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি’র বাংলাদেশ সফর মোটেও অপ্রত্যাশিত কোনো বিষয় ছিল না। বাংলাদেশে এটি তার প্রথম সফর নয়। তাহলে হেফাজতের নেতৃত্বে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী হামলার নেপথ্যে কী ছিল? ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হেফাজতের তাণ্ডব মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলো কেন?
অপরাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হয়। পুলিশের অ্যাকশন সাময়িক উত্তেজনাকে প্রশমিত করলেও, এর ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। নিরাময়ের কোনো উপায় নেই। ২০১৩ সালের পর থেকেই হেফাজত সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই এগোতে থাকে। জামায়াত আর আওয়ামী বিরোধী শক্তির সমন্বয়ে তারা দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে।
খেলাফত, শরিয়ত আর ইসলামের নাম ব্যবহার করে শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড ইসলাম বিরোধী সেটি প্রমাণ করতে সারাদেশে ওয়াজ মাহফিলের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েতে সভা সমাবেশ চলতে থাকে। আর এসব সমাবেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নিতে দেখা যায়।
অনেক আওয়ামী লীগ নেতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব সভা সমাবেশের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেন। সুচতুর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী লক্ষ লোকের সমাবেশে একদিকে শেখ হাসিনাকে জননেত্রী বলে সম্বোধন করেন, অন্যদিকে কুরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা করে সরকার ও তার সকল কর্মকাণ্ডকে ইসলাম বিরোধী আখ্যায়িত করে ‘টেনে-হিঁচড়ে’ নামিয়ে ফেলার ঘোষণা দেন। আর এসব সমাবেশে মামুনুল হকদের পাশে বসা আওয়ামী লীগ নেতারা তা হজম করেন। বিগত কয়েক বছর এভাবেই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মাঠে ঘাটে জনতাকে সংঘটিত করতে থাকে। ২৬ মার্চ পরবর্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জে আওয়ামী দৈন্যদশার দিকে তাকালে এই অপশক্তির সফলতা সম্পর্কে আর কোনো সংশয় থাকার কথা নয়।
মামুনুল হকের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সুনামগঞ্জের শাল্লায় ক্ষুব্ধ ঝুমন দাশ নাকি মামুনুল হককে নিয়ে কটূক্তি করেছিলেন! পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপে গ্রামবাসীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ঝুমন দাশকে আইনের হাতে সোপর্দ করা হয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছিল। তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানা না থাকলেও, আজকের পরিস্থিতিতে এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান ঝুমন দাশ দেশবিরোধী আনুগত্যহীন একজন লেবাসধারী উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কোনো অন্যায় করেননি।
সুচতুর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী লক্ষ লোকের সমাবেশে একদিকে শেখ হাসিনাকে জননেত্রী বলে সম্বোধন করেন, অন্যদিকে কুরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা করে সরকার ও তার সকল কর্মকাণ্ডকে ইসলাম বিরোধী আখ্যায়িত করে ‘টেনে-হিঁচড়ে’ নামিয়ে ফেলার ঘোষণা দেন। আর এসব সমাবেশে মামুনুল হকদের পাশে বসা আওয়ামী লীগ নেতারা তা হজম করেন।
শাল্লার ন্যক্কারজনক সাম্প্রদায়িক হামলার পর একাত্তর টিভিতে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট স্পষ্ট করেই তথ্য প্রমাণ দিয়ে বলেছিলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভা চেয়ারম্যান সহ আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মামুনুল হক দিরাইয়ের জনসভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন।
মামুনুল হককে নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতি আগ্রহী আওয়ামী নেতাদের খুঁজে বের করা সময়েরই দাবি। মামুনুল হক সহ এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া আওয়ামী নেতাদের চিহ্নিত করা মোটেও অসাধ্য কোনো বিষয় নয়।
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। ওলি, আউলিয়া, গাউস, কুতুব আর পীর মাশায়েখদের উত্তরাধিকারের এই ভূখণ্ডে ইসলামের শান্তিপ্রিয় রূপটিই শাশ্বত সত্য। কিন্তু কিছু অতি উৎসাহী একাত্তরের পরাজিত শক্তির দোসর তালেবানি কায়দায় ধর্মকে ব্যবহার করে এই বাংলাকে অশান্ত করেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যদি তাই না হতো, তবে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি তাদের এতো গাত্র দাহ হবে কেন?
শেখ হাসিনা কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন, আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সারা দেশের প্রতিটি উপজেলায় মডেল মসজিদ সহ ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করছেন, যুগোপযোগী কারিকুলাম নিয়ে ১৮০০ আধুনিক মাদ্রাসা নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। ইসলামের সেবায় উন্নয়নের এমন দৃষ্টান্ত তো সারা মুসলিম বিশ্বেই বিরল। তবুও এতো বিদ্রোহ কেন?
৭২-৭৫ সময়কালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে অতি বিপ্লবী গোষ্ঠী জাসদ-গণবাহিনী গঠন করে গুম, খুন লুটতরাজের মাধ্যমে যেভাবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল হেফাজত-খেলাফতকে সামনে রেখে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এভাবেই আর একটি বিয়োগান্তক ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায়। প্রশাসনের বর্তমান দৃশ্যমান ভূমিকা হয়তো পরিস্থিতি উত্তরণে সাময়িক সহায়ক হবে কিন্তু স্থায়ী সমাধানে রাজনৈতিক উদ্যোগের বিকল্প নেই।
মো. মাহমুদ হাসান ।। কলামিস্ট ও গবেষক