ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর দায় কার?
কিছুদিন যাবৎ হাসপাতালে কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু দেশবাসীকে ভালোমতোই নাড়া দিয়েছে; মামলা মোকদ্দমা, হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া, নিবন্ধন বাতিল, চিকিৎসক গ্রেফতারসহ নানাবিধ কার্যক্রম চলছে। যারা সন্তানহারা হয়েছেন, স্বজন হারিয়েছেন তাদের দুঃখ পরিতাপের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
পেশাগতভাবে চিকিৎসক সমাজ এই ধরনের মৃত্যুকে সমর্থন করছেন না, আবার কোনো তদন্ত ছাড়াই ঢালাওভাবে চিকিৎসককে দায়ী করে তাদের গ্রেফতারও সাধারণভাবে সমর্থন করছেন না।
চিকিৎসা সেবায় অবহেলাজনিত অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা। মেডিকেল অবহেলা বলতে অসঙ্গত বা অদক্ষ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা বুঝায়, যা হতে পারে সার্জন, অন্যান্য চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট, ল্যাব টেকনোলজিস্ট বা অন্যান্য স্টাফদের কারণে হতে পারে।
আরও পড়ুন
চিকিৎসা বিজ্ঞান অসুখ সারাতে এবং জীবন বাঁচাতে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের অঙ্গন হলেও এখানে ভুল চিকিৎসায়, সেবাদানকারীদের অবহেলা এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যু ঘটানোর মতো ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিককালে যুক্তরাজ্যের একজন নার্স ইচ্ছাকৃতভাবে বেশকিছু নবজাতক হত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল খাটছে। এমন ঘটনা অন্যান্য দেশেও ঘটছে।
স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অবহেলাজনিত মৃত্যু মানে হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবীদের মান সম্পন্ন চিকিৎসা দিতে না পারার ব্যর্থতা। এই অবহেলার ফলে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, স্থায়ী পঙ্গুত্ববরণ করে এমনকি মৃত্যুমুখেও পতিত হয়। তবে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, হাসপাতালের প্রত্যেকটি মৃত্যু কিন্তু অবহেলার কারণে হয় না। যেমন সার্জনের কোনো ভুল ছাড়াই একটি সার্জারি ব্যর্থ হতে পারে, একজনের মৃত্যু হতে পারে। তা নির্ভর করে রোগীর অবস্থার ওপর।
আমাদের দেশে কত যে ভুল চিকিৎসা হচ্ছে, অবহেলা হচ্ছে, রোগী আরোগ্য লাভ করছে না, তার সীমা-পরিসীমা নেই....
বছর চল্লিশেক আগের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুটো ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। রোড ট্রাফিক দুর্ঘটনায় আহত বিশ্ববিদ্যালয় এক শিক্ষার্থীর ইন্টারনাল অর্গান রাপচারের পর ২৪ ব্যাগ রক্ত দিয়ে অপারেশন করিয়েও বাঁচানো যায়নি। আরেক ঘটনায় একজন মহিলার এক্টোপিক প্রেগন্যান্সিতে টিউব রাপচার হওয়ার পর ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত দিয়েও যখন বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র ৫ শতাংশ ছিল এমন রোগীকেও অপারেশন করে সার্জন তার জীবন রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
আরও পড়ুন
ভারতের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের মতে ভারতে প্রতি বছর ৫২ লাখ মেডিকেল অবহেলা হয়ে থাকে। এবং কোনো কোনো বছরে এই সংখ্যা মারাত্মক আকারে বেড়ে থাকে। এছাড়া বেশিরভাগ মেডিকেল অবহেলা নথিভুক্ত না হওয়ায় অনেক বোদ্ধা এই সংখ্যাকে হিমবাহের চূড়া হিসেবে গণ্য করে থাকেন।
লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন এক পর্যালোচনায় দেখিয়েছে যে, ২০১৫ সালে এক বছরে ৭৫০টি মৃত্যু ঘটেছে যুক্তরাজ্যে যেগুলো এড়ানো যেত। অন্য হিসাবে ২৮টির মধ্যে একটি করে মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। ইন্সটিটিউট অফ মেডিসিন ১৯৯৯ সালে এক প্রতিবেদনে দাবি করে যে যুক্তরাষ্ট্রে এক বছরে ৯৮,০০০ রোগী হাসপাতালের ভুলে মারা যায়। এতে হইচই পড়ে যায় চিকিৎসক সমাজে এবং তারা এই সংখ্যা সঠিক নয় বলে মতামত ব্যক্ত করে।
তবে এতগুলো মৃত্যু যে হাসপাতালের ভুলের কারণে হয়েছে তা অতিরঞ্জিত নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে যখন ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানবিক সেবাসমূহের ইন্সপেক্টর জেনারেল বলেন যে, খারাপ হাসপাতাল সেবার কারণে ১,৮০,০০০ রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়াতেও অসংখ্য চিকিৎসা অবহেলার ঘটনা জানা যায়। বছরে প্রায় ১,৪০,০০০ ভুল রোগ শনাক্তের ঘটনা ঘটে থাকে যার মধ্যে ২১,০০০ মারাত্মক ধরনের যাতে ২০০০-৪০০০ মৃত্যু ঘটে থাকে। আরেকটি প্রতিবেদন ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন শঙ্কা প্রকাশ করে যে, ১৮,০০০ পর্যন্ত মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।
নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি, নিবন্ধন ছাড়া হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালন, তত্ত্বাবধান-পরীবিক্ষণের অভাব এরূপ অসংখ্য কারণে আমাদের দেশে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া যাচ্ছে না...
এছাড়া ৫০ হাজারের ওপর রোগী পঙ্গুত্ব বরণ করে থাকে। এছাড়া আরেকটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয় যে, প্রতি ৭ টার মধ্যে একটি ভুল রোগ শনাক্তকরণ করে থাকে অস্ট্রেলিয়ার হাসপাতালগুলো।
এই যদি হয় এসব অতীব উন্নত দেশের চিকিৎসা অবহেলার অবস্থা তা হলে আমাদের দেশে কত যে ভুল চিকিৎসা হচ্ছে, অবহেলা হচ্ছে, রোগী আরোগ্য লাভ করছে না, তার সীমা-পরিসীমা নেই।
মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের পদে পদে ঘাটতি; হাসপাতালগুলোয় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবীর স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ঘাটতি, যন্ত্রপাতির অভাব, কমিশনসহ নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি, নিবন্ধন ছাড়া হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালন, তত্ত্বাবধান-পরীবিক্ষণের অভাব এরূপ অসংখ্য কারণে আমাদের দেশে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া যাচ্ছে না, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে এমনকি মৃত্যুও ঘটছে।
আরও পড়ুন
চিকিৎসা ক্ষেত্রে অবহেলা নিরসনে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো নেওয়া যেতে পারে।
১। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মান বৃদ্ধি করা;
২। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা;
৩। চিকিৎসাসেবীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে প্রশিক্ষণ প্রদান;
৪। অধিকার সম্বন্ধে রোগীদের সচেতন করা;
৫। সেবাদান অবহেলায় যথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ;
৬। ক্ষতিগ্রস্ত রোগীদের ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা;
বিশেষজ্ঞগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, মারাত্মক অসুস্থ রোগীদের শুশ্রূষার ওপর চিকিৎসক এবং নার্সদের প্রশিক্ষণ দানের মধ্যে ৫০ শতাংশ অবহেলিত মৃত্যু ঠেকানো যেতে পারে।
অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; প্রাক্তন পরিচালক, রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর