মানুষ বেশি, তাই জীবনের মূল্য কম!
১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল টাইটানিক। ১৯০৭ সালে শুরু হয়েছিল টাইটানিকের নির্মাণকাজ। পাঁচ বছর একটানা কাজ শেষে ১৯১২ সালে জাহাজটি সমুদ্রে ভাসার উপযোগী হয়। ৬০ হাজার টন ওজন এবং ২৭৫ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট জাহাজটি নির্মাণ করতে সেই সময়ই খরচ হয়েছিল ৭৫ লাখ ডলার।
নির্মাণ বিস্ময় টাইটানিক নিয়ে গর্ব ছিল নির্মাতাদের। বলা হচ্ছিল, টাইটানিক কখনো ডুববে না। কিন্তু প্রথম যাত্রা শুরুর মাত্র ৫ দিনের মাথায় ১৫ এপ্রিল আইসবার্গের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে যায় টাইটানিক।
২২০০ এর বেশি যাত্রীর মধ্যে মাত্র ৭০০ জন উদ্ধার করা যায়। যুক্তরাজ্য থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার টাইটানিকের এই রোমাঞ্চকর যাত্রায় সঙ্গী হতে টিকিট কাটতে হয়েছিল চড়া দামে। প্রথম শ্রেণির ভাড়া ছিল ৩ হাজার ১০০ ডলার।
আরও পড়ুন
বলা ভালো, বিশ্বের তখনকার ধনকুবেররাই চড়েছিলেন টাইটানিকে। অনেকের কাছেই নগদ অর্থ ছাড়াও মূল্যবান সামগ্রী ছিল। কিন্তু জাহাজডুবির সময় সেই ধনসম্পদের কোনোই মূল্য ছিল না। মূল্য ছিল শুধু একটি লাইফবোটের।
আসলে আমরা সারাজীবন যে অর্থ উপার্জন করি, কখনো কখনো তার কানাকড়ি মূল্যও থাকে না। টাইটানিক পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই। কোভিডের সময়ও বারবার প্রমাণিত হয়েছে, জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছুই নেই। হাজার কোটি টাকার মালিক এস আলম পরিবারের দুই ভাই একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার ভাগাভাগি করে বাঁচার চেষ্টা করেছেন।
হাজার কোটি টাকার মালিক যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল বাঁচতে পারেননি। তখন হাসপাতালে একটি সিট পাওয়াই লটারি পাওয়ার চেয়ে বেশি কঠিন ছিল। অথচ আস্ত একটি হাসপাতাল, মানে পপুলার হাসপাতালের মালিক তার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেননি।
ঘরে থেকে বেরুলেই মৃত্যুর ঝুঁকি। আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবেন, ওপর থেকে ইট পড়ে মারা যেতে পারেন আপনি। গাড়ি এসে আপনাকে চাপা দিয়ে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তো ষোলোআনা।
আসলে পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান মানুষের জীবন। কারণ বিজ্ঞান অনেককিছু আবিষ্কার করেছে। রোগ নিরাময়ের, দীর্ঘজীবী হওয়ার অনেক কৌশল আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান, ধর্ম কেউই মানুষকে জীবন দিতে পারে না। আসলে জীবন মূল্যবান নয়, জীবন অমূল্য। কোনো কিছুর বিনিময়েই আপনি জীবন ফিরে পাবেন না।
বিশ্বের সব দেশেই তাই সবকিছুর প্রাথমিক শর্ত হলো নিরাপত্তা। সেফটি ফার্স্ট। সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। যেখানে নিরাপত্তার ধারণাই নেই। আমরা শত কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প নেই। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখি না।
২৬ মার্চ ২০২৪, স্বাধীনতা দিবস পালনে ব্যস্ত গোটা দেশ, সেইদিন মৌলভীবাজারের জুড়ীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যুর খবর আমাদের বিহ্বল করে দিয়েছে। সেই পরিবারের একমাত্র সদস্য সোনিয়া আক্তার। তার বয়স ছিল ১২। সেও ২৭ মার্চ সকালে মারা গেল। শেষ হয়ে গেল পুরো পরিবার।
আরও পড়ুন
বিশ্বের আর কোনো দেশেই মানুষের বসত ঘরের ওপর দিয়ে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের লাইন টানানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। ঝড়ে সেই বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে একটি পরিবার। মানুষের জীবনের কী নিদারুণ অপচয়।
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বেইলি রোডে এক রেস্টুরেন্ট ভবনে আগুন লেগে মারা গেছেন ৪৬ জন। ভবনটি বাণিজ্যিক হলেও রেস্টুরেন্ট করার অনুমতি ছিল না। অথচ ভবনটিতে যথাযথ ফায়ার এক্সিট থাকলে আগুন লাগলেও মানুষগুলোর বেঁচে যাওয়ার সুযোগ ছিল। সেই ভবনের মতো আরও কত মৃত্যুকূপ আছে এই রাজধানীতে, আমাদের চোখের সামনে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমরা জানিই না।
বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর বেপরোয়া অভিযানে অনেক রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সবাইকে দেখানোর জন্য নিরীহ রেস্টুরেন্ট কর্মচারীদের ঢালাও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি নিশ্চিত, অভিযানের ঢেউ কমে গেলেই আবার সেই রেস্টুরেন্টগুলো চালু হবে, কিছু হয়তো চালু হয়েও গেছে। কিন্তু নিরাপত্তা ঝুঁকি কিন্তু রয়েই গেছে।
ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা আছে সরকারের কাছে। মাঝে মধ্যে হয়তো নোটিশ পাঠানো হয়। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ বলে কোনো ভবন ভাঙার কথা শুনেছেন কখনো। আমরা বসে থাকি, আরেকটা দুর্ঘটনার জন্য। আবার আহা-উহু। তারপর সবাই ভুলে যাবে।
এই শহরে, এই দেশে আগুন লেগে মানুষ মরে, ভবন ধসে মানুষ মরে, জাহাজ ডুবে মানুষ মরে, দুর্ঘটনায় মানুষ মরে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মানুষ মরে। মৃত্যুটাই যেন সবচেয়ে সহজ। চারপাশে শুধু মৃত্যুর হাতছানি।
এখন গাড়িতে সিএনজি বা এলপিজির সিলিন্ডার থাকে। ঘরে রান্নার কাজেও সিলিন্ডারের ব্যবহার বাড়ছে। ব্যবহার করতে না জানলে একেকটি সিলিন্ডার কিন্তু একেকটি বোমা। ১৩ মার্চ ২০২৪ গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় মারা গেছেন ১৬ জন। অমূল্য জীবনের কী নিদারুণ অপচয়।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা ‘নন্দলাল’ কবিতাটি আপনাদের সবারই পড়া। দেশের জন্য কাজ করার খুব ইচ্ছা তার। তাই বেঁচে থাকতে চায়। আর বেঁচে থাকতে হলে তাকে ঘরেই বসে থাকতে হবে। কারণ চারদিকে ওৎ পেতে আছে মৃত্যুদূত।
“নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি,
চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি।
নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিসন’ হয়,
হাঁটতে সর্প, কুকুর আর গাড়ি-চাপা পড়া ভয়।
তাই শুয়ে শুয়ে কষ্টে বাঁচিয়া রহিল নন্দলাল,
সকলে বলিল—‘ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল।”
আরও পড়ুন
আমাদের সবার দশা হয়েছে এখন সেই নন্দলালের মতো। ঘরে থেকে বেরুলেই মৃত্যুর ঝুঁকি। আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবেন, ওপর থেকে ইট পড়ে মারা যেতে পারেন আপনি। গাড়ি এসে আপনাকে চাপা দিয়ে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তো ষোলোআনা। এমনকি বেপরোয়া গাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। জুড়ীর পরিবারটি ঝড়ের সময় ঘরেই ছিল। বাঁচতে তো পারেনি।
ছেলেবেলায় দেখেছি গ্রামের হাজাম এসে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কেটে খৎসা করাতো। কখনো কারও মৃত্যুর খবর পাইনি। এখন প্রায়ই শুনি খৎনা করাতে গিয়ে মৃত্যু। ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর খবরে প্রায়ই তোলপাড় ওঠে। হাজামের কারণে মৃত্যুর ঘটনাও এখন জানা যাচ্ছে।
আমাদের দেশে মানুষ বেশি। তাই মানুষের জীবনের দাম বোধহয় সবচেয়ে কম। সবকিছু করি আমরা, খালি নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা ঠিকমতো করি না। এই শহরে, এই দেশে আগুন লেগে মানুষ মরে, ভবন ধসে মানুষ মরে, জাহাজ ডুবে মানুষ মরে, দুর্ঘটনায় মানুষ মরে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মানুষ মরে। মৃত্যুটাই যেন সবচেয়ে সহজ। চারপাশে শুধু মৃত্যুর হাতছানি।
নবারুণ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’। কবির এই হাহাকারের সাথে আমি একমত। কিন্তু আমরা তারচেয়েও অসহায়। বাস্তবতা হলো এই মৃত্যু উপত্যকাই আমাদের দেশ। এখানে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। আমরা অপেক্ষা অপমৃত্যুর।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ