২০২৪ সালের ডেঙ্গু মোকাবিলায় সক্ষমতা কতখানি?
ছোট্ট একটি পতঙ্গ মশা কিন্তু সে মাঝে মাঝে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীদের মধ্যে প্রথম অবস্থানে আছে মশা। মশাই একমাত্র প্রাণী যে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। বিবিসি নিউজের তথ্যমতে প্রতিবছর পৃথিবীতে ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় মশা।
মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, জিকা ইয়েলো ফিভার, ওয়েস্টনাইল ফিভার অন্যতম। তবে এই মুহূর্তে মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যে এই বিষয়ে সতর্ক বার্তা জারি করেছে।
তারা হুঁশিয়ারি করেছে যে, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২৩ সালে পৃথিবীর প্রায় ১৩০টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্রাজিল, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, ফিলিপিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন
উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং বজ্র ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না করতে পারার কারণে ধীরে ধীরে মশার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। কয়েকদিন ধরে মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ দেশের মানুষ। তবে বর্তমানে যে মশাগুলো আমরা দেখছি তার প্রায় ৯৮ শতাংশ কিউলেক্স মশা। এই মশাটি ডেঙ্গু রোগের বাহক নয়।
ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা প্রজনন বেড়ে যায় বর্ষা মৌসুমে। তবে এখন যে এডিস মশা নেই তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গবেষণা করতে গিয়ে শীতকালেও আমরা ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা পাচ্ছি। শীতকালে যখন বৃষ্টিপাত থাকে না তখনো নির্মাণাধীন ভবনের নিচে, বহুতল ভবনের বেজমেন্টে জমা পানি এবং মানুষের বাসাবাড়ির ড্রাম-বালতিতে জমিয়ে রাখা পানিতে শীতকালেও আমরা এডিস মশার সফল প্রজনন লক্ষ্য করছি।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত ১৬০০-এর বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ২০২৩ সালে। সেই বছর সরকারি হিসাব মতে, ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।
ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ২০২৩ সালে হলেও ঐ বছর এই সময়ে আক্রান্ত ছিল ৮০০ এর কম। বাংলাদেশের ইতিহাস ভেঙে দেওয়া আক্রান্তের বছরের হিসাব ছাড়িয়ে ২০২৪ সালের শুরু থেকে আগ্রাসী ভূমিকায় আছে ডেঙ্গু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টারের তথ্যমতে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলা শহরে ডেঙ্গুর রোগী পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের গবেষণায়ও আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলায় ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব পাচ্ছি।
পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২৩ সালে পৃথিবীর প্রায় ১৩০টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্রাজিল, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, ফিলিপিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ।
দীর্ঘদিন মশা নিয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি যে ফোরকাস্টিং মডেলটি তৈরি করি তাতে দেখা যাচ্ছে যে, ২০২৪ সালে ডেঙ্গু বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করবে বাংলাদেশকে। ঢাকা ছাড়াও ঢাকার বাইরের কিছু জেলায় বিগত বছরগুলোর সব হিসাব অতিক্রম করে ডেঙ্গু আঘাত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা,কক্সবাজার, চাঁদপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ ও খুলনায় ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণ হতে পারে। এই জেলাগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটবে ২০২৪ সালে।
এপ্রিল মাসের পর থেকে যখন বৃষ্টিপাত শুরু হবে তখন থেকেই এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধি পেতে থাকবে। বৃষ্টি হলে বাড়ি, বাড়ির আঙিনা অথবা বিভিন্ন জায়গায় আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা পাত্রে পানি জমা হবে এবং সেই পানিতে এডিস মশা ডিম পেড়ে তার বংশবিস্তার করবে।
আরও পড়ুন
কোনো একটি জায়গায় এডিস মশার ঘনত্বের ইনডেক্স বা ব্রোটো ইনডেক্স যখন ২০ অতিক্রম করবে তখনই সেই এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। মৌসুমের শুরুতে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা; বিশেষ করে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের কার্যক্রম সঠিকভাবে করতে পারলে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
সারাদেশে মশা নিয়ন্ত্রণের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান; সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মৌসুমের শুরুতেই ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা প্রয়োজন।
যেসব সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার মশা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রশিক্ষিত জনবল নেই তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। সঙ্গে সঙ্গে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক কীটনাশক বাছাই করে তা সরবরাহ করা গুরুত্বপূর্ণ। কোন কীটনাশক কোন ধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে সঠিক মাত্রায় সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় প্রয়োগ করতে হবে তার প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া দরকার। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জনসাধারণেরও সতর্ক অবস্থায় থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মরত ডাক্তার এবং নার্সদের ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। আমরা ২০২৩ সালের ভয়ংকর ডেঙ্গু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাই না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখনই ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করুক স্থানীয় সরকারের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো।
এই মুহূর্তে ডেঙ্গু ছোট ছোট বিভিন্ন পকেট স্থানে রয়েছে। বর্তমান সময়ে যেসব বাড়িতে ডেঙ্গু হচ্ছে সেই বাড়িকে কেন্দ্র করে ৫০০ মিটারের মধ্যে এডিস মশা নিশ্চিতভাবে মেরে দিতে হবে। কারণ এরা বেঁচে থাকলে বৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওই জায়গাগুলো থেকে বিস্তৃত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে।
বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার পূর্বেই সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ ঘটাতে পারলে ডেঙ্গুকে এই বছর নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখা সম্ভব। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা সফলভাবে করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মরত ডাক্তার এবং নার্সদের ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
আরও পড়ুন
আমরা ২০২৩ সালের ভয়ংকর ডেঙ্গু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাই না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখনই ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করুক স্থানীয় সরকারের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কার্যক্রম শুরু করতে পারে। জনগণকেও যে যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ বাড়ি ও বাড়ির আঙিনায় এডিস মশার প্রজনন যেন না হয় তাও নিশ্চিত করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারলে নিয়ন্ত্রণে থাকবে ডেঙ্গু।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]