অবন্তিকার মৃত্যুর দায় আমি কীভাবে এড়াই
ফাইরুজ অবন্তিকা আমার কন্যাসম। তার মৃত্যু আমাকে ভয়াবহ আঘাত দেয়। মেয়েটা ১৫ মার্চ ২০২৪ রাত ১০টার দিকে কুমিল্লা শহরের বাগিচাগাঁও ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন এলাকার বাসায় আত্মহত্যা করে। তার মৃত্যুর পরদিন, ১৬ মার্চ আমরা জানতে পারি কাজী ফারজানা মীম নামের আরেক শিক্ষার্থীর উপর ঘটে যাওয়া হৃদয় বিদারক যৌন হয়রানির ঘটনা।
আমরা জানলাম সেও একজন পোটেনশিয়াল অবন্তিকা। তাকে বাঁচাতে হলেও তার উপর নির্যাতনকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়ানো উচিত। অথচ আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিশাল অংশেরই কোনো প্রতিবাদ দেখি না। শুধু মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রতিবাদ নজরে এসেছে।
বিশেষ করে যেই শিক্ষকরা রাজনীতি করে শিক্ষকদের নেতা হয়েছেন সেই শিক্ষক নেতাদের কোনো প্রতিবাদ দেখেছেন? সরকারি দল করা কোনো শিক্ষক নেতাদের প্রতিবাদ করতে দেখেছেন? সামান্য ইস্যুতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বিবৃতি দেয়, প্রতিবাদ করে। অথচ আজকে তারা নীরব। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনগুলোও বোবায় ধরা রোগে আক্রান্ত।
আরও পড়ুন
অথচ আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন এইরকম কোনো ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হতো। তাহলে রাজনীতি কি কেবল ফায়দা লোটা আর স্বার্থের জন্য? রাজনীতির গতি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখন আর মানুষের জন্য কেউ রাজনীতি করে না। রাজনীতি এখন পেশা, সেবা নয়।
সবচেয়ে অবাক লাগে, যখন কোনো ঘটনা ঘটে তখনই ভিকটিম ব্লেইমিং শুরু হয়ে যায়। যেন সব দোষ ভিকটিমের। আর অবন্তিকা যেহেতু বাবাহীন ক্ষমতাহীন নারী এটা করাও অনেক সহজ হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে, সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের চেতনা বর্তমান প্রেক্ষাপটে একদম ঠিকঠাক। দ্বীন ইসলাম ১/১১-এর বিখ্যাত ছবি (যা অন্তর্জালে ঘুরছে) ফেরি করে উপরে ওঠার সিঁড়ি বানিয়েছে।
আবার তার পক্ষে দাঁড়িয়েছে একাত্তর টেলিভিশন। একটি সাক্ষাৎকার তারা এমনভাবে প্রচার করছে যেন সব দোষ অবন্তিকার আর দ্বীন ইসলাম একদমই নির্দোষ। কিছুই জানে না। আর আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির ভয়াবহ অভিযোগ এনেছে কাজী ফারজানা মীম। আবু শাহেদ ইমনও চ্যানেল আইয়ের একজন কর্মকর্তা। সবকিছুই কি পচে গেল? এই পচা গলা সমাজ কি সংস্কার যোগ্য?
...কোনোদিন তো গেস্টরুমে নিয়ে টর্চারের কথা শুনিনি। আমাকে তো আমার কন্যাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় না। বাংলাদেশের হাজার হাজার বাবা-মায়ের সন্তান এখন ইউরোপ-আমেরিকায় লেখাপড়া করে। ওদের লেখাপড়া করতে পাঠিয়ে সবাই নিশ্চিন্তে থাকে।
আমি ভাবি, আমার কন্যাও যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছে। আবাসিক হোস্টেলে থাকছে। সেই হোস্টেলের প্রতি ফ্লোরের এক পাশে ছাত্ররা আরেক পাশে ছাত্রীরা থাকছে। আমার কন্যা অনেক রাত পর্যন্ত লাইব্রেরিতে পড়ে। রুমে আসে শুধু ঘুমাতে। ল্যাবে কাজ করে যখন তখন। ওর শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন কনফারেন্স বা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা রিসার্চ ল্যাবে নিয়ে গিয়েছে এবং সেইখানে হোটেলে থাকতে হয়েছে।
এই গল্প শুধু আমার কন্যার ক্ষেত্রেই না। দেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যাচ্ছে তাদের সবারই গল্প। অনেকেই ক্যাম্পাসের বাহিরে আলাদা বাসা ভাড়া করে প্রতিটা ছেলেমেয়ে আলাদা রুমে মিলেমিশে একসাথে থাকে। আমরা বিগব্যাং সিরিজ কিংবা ফ্রেন্ডস সিরিজেও এমন দেখি।
কত আনন্দের সাথে ছেলেমেয়ে একসাথে থাকে। সবার আড্ডা দেওয়ার জন্য কমন স্পেস আছে। সেইখানে একসাথে হয়ে আড্ডা দেয়। কোনো মারামারি নেই। কোনো রাজনীতি নেই। কেবলই লেখাপড়া অথবা নানা সামাজিক ইস্যু নিয়ে আড্ডা।
আরও পড়ুন
এই যে এত এত বিশ্ববিদ্যালয়ে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে মিলেমিশে থাকছে কোনোদিন তো মারামারি হয়েছে শুনিনি। কোনোদিন তো গেস্টরুমে নিয়ে টর্চারের কথা শুনিনি। আমাকে তো আমার কন্যাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় না। বাংলাদেশের হাজার হাজার বাবা-মায়ের সন্তান এখন ইউরোপ-আমেরিকায় লেখাপড়া করে। ওদের লেখাপড়া করতে পাঠিয়ে সবাই নিশ্চিন্তে থাকে।
এই দেশের ক্ষমতাবানদের সন্তানদেরও সেই নিরাপদ স্থানে লেখাপড়া করায়। আর দেশের গরিব পিতামাতার সন্তানদের রাজনীতির নামে মাস্তানি, গুণ্ডাগিরি, ছিনতাই ইত্যাদি নানা অপকর্ম শেখায়। প্রকাশ্যে এক ক্ষমতা প্রত্যাশী দল আরেক ক্ষমতা প্রত্যাশী দলকে বলে ‘তোমাদের শায়েস্তা করার জন্য আমার ছাত্র ...-ই যথেষ্ট’।
পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতা এমন বলতে পারে? কেউ যদি বলে তাহলে জনগণই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ঐদিনই শেষ করে দিতো। অথচ আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো।
বাংলাদেশের মাদ্রাসা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য মৃত্যুকূপ। সেই মৃত্যু হতে পারে শারীরিক মৃত্যু বা মেধার মৃত্যু যার দায় ভার শিক্ষকদের ওপর বর্তায়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমাদের ক্যাম্পাসে যা ঘটে তা কোনো সভ্য দেশে ঘটা অকল্পনীয়।
আগে অরাজনৈতিক এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিখ্যাত অধ্যাপকদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো। সেই সময় উপাচার্যের অনেক ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতা তারা ধারণও করতে পারতেন এবং তা যথাযথ ব্যবহারও করতে পারতেন। যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তার সুনাম পৃথিবী বিখ্যাত। তিনি যখন যাকে যোগ্য মনে করতেন তাকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতেন এবং তার যোগ্যতা নিয়ে কখনো প্রশ্ন উঠতো না। কখনোই তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। প্রতিষ্ঠানের ভালোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন।
এখন আমরা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেই মানের শিক্ষকদের ভিসির দায়িত্ব দেই তাদের অনেকেরই শিক্ষক হওয়ারই যোগ্যতা নেই, ভিসি তো আরও দূরের কথা।
আমি তো চারপাশে শিক্ষক দেখি না। অধিকাংশই দলান্ধ মুর্খ। অনেক পুরুষ শিক্ষকের কাছে ছাত্রী মানে একটা সেক্স অর্গান! মাদ্রাসার শিক্ষকরা মেয়ে শিক্ষার্থীদের যেই দৃষ্টিতে দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকও একই দৃষ্টিতে দেখে। কোনো উন্নতি নেই।
...অনেক ছাত্রী রিপোর্ট করতে ভয় পায়। যদি তার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যায়। যদি সে আর কখনো পড়াশোনা করতে না পারে। এই ভয় সবসময় তার পেছনে ঘোরে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যাদের উপর নম্বর দেওয়ার ক্ষমতা থাকে সেই ক্ষমতা তারা যৌন নির্যাতনের মাধ্যমে প্রয়োগ করে। এই পর্যন্ত যতগুলো যৌন নির্যাতনের রিপোর্ট হয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশি ঘটনা ঘটলেও সেই পরিমাণ রিপোর্ট হয় না। অনেক ছাত্রী রিপোর্ট করতে ভয় পায়। যদি তার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যায়। যদি সে আর কখনো পড়াশোনা করতে না পারে। এই ভয় সবসময় তার পেছনে ঘোরে।
আসলে আমাদের শিক্ষক প্রক্রিয়াটাই পচা গলা। কেবল মাত্র একটি মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগ হয়। ১৫/২০ মিনিটের একটা ইন্টারভিউই শিক্ষক নিয়োগের একমাত্র প্রক্রিয়া হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে পারে বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য অযোগ্য, দলান্ধ মুর্খ, সেক্স ফ্রিক শিক্ষক শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে পড়েছে। সারা বিশ্বে শিক্ষক নিয়োগের নানা স্তর থাকে যার প্রতিটি স্তরেই ফিল্টারিং হয়। একাধিক স্তরের কোনো একটিতে বিভাগের সব শিক্ষক এমনকি ছাত্রদের মতামতও নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
আমাদের এখানে শিক্ষক নিয়োগ এখন মাফিয়া তন্ত্রের হাতে বন্দি। প্রতিটা বিভাগে মাফিয়াদের প্রতিনিধি আছে। ছাত্ররাও জানে সেই প্রতিনিধি কে। তারা তার সাথেই থিসিস করতে চায়, তার সাথেই সম্পর্ক উষ্ণ রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে, সে যাকে অপছন্দ করে ছাত্ররাও সেই শিক্ষকের ধারেকাছেও যায় না।
সমাজের কোনো পক্ষ কি এইসব অনিয়ম নিয়ে কথা বলে? ছাত্ররা কি প্রতিবাদ করে? একজন সত্যিকারের শিক্ষক কতজন শিক্ষার্থীর জীবন বদলে দিতে পারে আমাদের কি ধারণা আছে? তবে মিথ্যার আবেশে থাকা একজন শিক্ষক অনেক ছাত্রের জীবন ধ্বংস করতে পারে সেই উদাহরণ বাংলাদেশে অসংখ্য। তারপরেও কেউ প্রতিবাদ করে না। বলে না যে, এইভাবে চলতে পারে না, এইভাবে চলতে দেওয়া যায় না।
ফাইরুজ অবন্তিকা আর কাজী ফারজানা মীমদের জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে। একজন তো আত্মহত্যা করেছে, আরেকজন টিকে থাকতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে। এই দেশে নারীদের এত এত গল্প শুনি, কাজী ফারজানা মীমের যে অভিযোগ, সেই অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি দিয়ে নতুন দৃষ্টান্তের গল্প তৈরি করতে পারি।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়