নারী ফুটবলারদের পুরস্কার নয়, আগে পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি
গল্পগুলো মোটামুটি একই রকম। দূরের কোনো মফস্বল শহর কিংবা অজ পাড়া গাঁ, যেখানে থাকেন কোনো একজন ফুটবল পাগল। গাঁটের পয়সা খরচ করে বাচ্চাদের তিনি ফুটবল শেখান। মেয়েদের ফুটবল শিখতে উৎসাহী করার জন্য বাড়ি, বাড়ি ঘোরেন। বাবা-মা'কে বোঝান।
সমাজের একটা শ্রেণির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নীরবে, নিভৃতে কাজ করে যান। তারপর সাফল্য পেলে মিডিয়ার নজরে আসেন, প্রশাসন থেকেও টুকটাক সহযোগিতা পান। সাফল্য না পেলে একসময় হাল ছেড়ে দেন। সবার চোখের আড়ালেই ঝরে যায় সব স্বপ্ন।
কয়েক বছর এভাবেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল। এগিয়ে যাওয়ার এই গল্পগুলো কখনো মনে হয় রূপকথা। কখনোবা আবার এসব গল্প থেকেই দেখা মেলে রূঢ় বাস্তব। তবে রূপকথা হোক আর বাস্তবই হোক, গল্প কিন্তু থেমে নেই। ফুটবল মাঠে এখন নিয়মিতই নিত্যনতুন কাব্যগাঁথার জন্ম দিচ্ছেন বাংলাদেশের মেয়েরা।
আরও পড়ুন
এই তো ক'দিন আগে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। তারও মাসখানেক আগে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ ফুটবলে। জাতীয় দলও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বছর দেড়েক আগে। সবগুলো সাফল্য এক সুতোয় গাঁথলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়, এই তিনটি সাফল্যের কোনোটিই পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় মেয়েদের ফুটবলে সব পর্যায়েই এখন অবিসংবাদিত সেরা দল বাংলাদেশ।
খেলাধুলা তো বটেই, সমাজের আর কোনো ক্ষেত্রেই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের এই রকম একচ্ছত্র আধিপত্য নেই এই মুহূর্তে। এজন্য কিছুটা অভিনন্দন মেয়েরা অবশ্যই প্রাপ্য। অভিনন্দন প্রাপ্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনেরও। যদিও অভিযোগ আছে মেয়েদের এই সাফল্যকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অন্য সব ব্যর্থতাকে আড়াল করে রেখেছে ফেডারেশন।
কিন্তু যেখানে সাফল্য আছে সেইখানে কিছু কৃতিত্ব তো তাদের দিতেই হবে। ফেডারেশনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব সম্ভবত একসাথে মেয়েদের অনেকগুলো দল খেলার মধ্যে ধরে রাখা। মেয়েদের ঘরোয়া ফুটবল কাঠামো এখনো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। হাতে গোনা যে দুই একটি টুর্নামেন্ট হয় তাতে নতুন খেলোয়াড় খুঁজে বের করা কিংবা বর্তমান খেলোয়াড়দের খেলার মান ও ফিটনেস ধরে রাখা কঠিন। ফেডারেশন পরিচালিত আবাসিক ক্যাম্পই তাই এই মেয়েদের মূল ভরসা।
কেবল মাত্র নিয়মিত আবাসিক ক্যাম্প চালু রেখে খেলায় মান ধরে রাখা যায় না। এজন্য প্রয়োজন টেকসই কাঠামো যা বাংলাদেশের ফুটবলে মেয়েদের জন্য নেই।
নিজেদের তত্ত্বাবধানে এই মুহূর্তে ৫৬ জন খেলোয়াড় আবাসিক ক্যাম্পে রেখেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। তাদের খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে পড়াশোনা সব দায়িত্বই ফেডারেশনের। এটি খরচের বিশাল যজ্ঞ। একটি বেসরকারি ব্যাংক কয়েক বছর ধরে খরচের একটা বড় অংশ বহন করে যাচ্ছে। বছরখানেক আগে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি কর্পোরেট গ্রুপ।
এই দুই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সাহায্যে জাতীয় দল কিংবা বয়স ভিত্তিক ক্যাম্প চালানো গেলেও তাতে কিছুটা ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। খেলাধুলা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখেন এমন যে কেউই মানবেন এটা মোটেও যথেষ্ট নয়। কেবল মাত্র নিয়মিত আবাসিক ক্যাম্প চালু রেখে খেলায় মান ধরে রাখা যায় না। এজন্য প্রয়োজন টেকসই কাঠামো যা বাংলাদেশের ফুটবলে মেয়েদের জন্য নেই।
প্রাথমিক স্কুলের বাচ্চাদের জন্য বঙ্গমাতা ফুটবল ভালো উদ্যোগ। দেশব্যাপী নিয়মিত আয়োজন হয় বলে এই টুর্নামেন্ট থেকে প্রতি বছর নতুন কিছু প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এসব প্রতিভা যেখানে বিকশিত হবে সেই টুর্নামেন্টগুলো অনিয়মিত। বঙ্গমাতা ফুটবল ছাড়া মেয়েদের ফুটবলে সরকারের সরাসরি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতাও যৎসামান্য।
ক্রিকেটের ক্ষেত্রে যেমন শোনা যায়, মেয়েদের ফুটবলে কোনো স্বতন্ত্র একাডেমিকে কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে তেমনটা শোনা যায় না। অথচ সাফল্য যখন আসে তার ভাগীদার হতে সবাই সোৎসাহে নেমে পড়ে। বছর দেড়েক আগে বাংলাদেশের মেয়েরা যখন সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় অনেককেই দেখা যায় তাদের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করতে। কারও কারও ঘোষিত পুরস্কারের টাকা পেতে অনেক কাঠ খড় পোহাতে হয়েছে।
অনেক ফুটবলারের জীবনেই আর্থিক কষ্ট আছে। এই ধরনের পুরস্কার সেইসব কষ্ট লাঘবে সাময়িক ভূমিকা পালন করে। তবে এগুলো দীর্ঘমেয়াদে খেলোয়াড়দের সেইভাবে সাহায্য করে না বললেই চলে।
সবাই যদিও একরকম করেনি, তবে পুরষ্কারের ঘোষণা দিয়ে যারা পরে টাকা দিতে টালবাহানা করেছে তাদের উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। জাতির আবেগকে পুঁজি করে এরা ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। অনেক ফুটবলারের জীবনেই আর্থিক কষ্ট আছে। এই ধরনের পুরস্কার সেইসব কষ্ট লাঘবে সাময়িক ভূমিকা পালন করে। তবে এগুলো দীর্ঘমেয়াদে খেলোয়াড়দের সেইভাবে সাহায্য করে না বললেই চলে।
মেয়েদের যারা সত্যিকার অর্থে পুরস্কৃত করতে চান, তাদের উচিত পৃষ্ঠপোষক হওয়া। কোনো একাডেমিকে সাহায্য করা, কিংবা যেসব ক্লাব খেলোয়াড় তৈরিতে ভূমিকা রাখবে তাদের সাহায্য করা। ফেডারেশন যাতে মেয়েদের ঘরোয়া ফুটবল নিয়মিত আয়োজন করতে পারে তার জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। কোনো কোনো বিশেষ প্রতিভা থাকলে তাদের দীর্ঘমেয়াদে বৃত্তির ব্যবস্থা করা যাতে সব ভুলে সে খেলায় মন দিতে পারে।
দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবলে এসব একেবারেই অনুপস্থিত। ক'দিন আগেই ঘটা করে দেশে পালন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এসব দিবসের একটা কর্পোরেট চরিত্র আছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই সেইদিন তাদের নারী কর্মীদের ফুল দিয়ে অফিসে স্বাগত জানিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।
এই দিবস যখন পালন করা হচ্ছিলো তখন বাংলাদেশের মেয়েরা সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল খেলছে নেপালে। তাদের শুভেচ্ছা জানাতে কিন্তু কাউকে দেখা যায়নি। অথচ এই মেয়েরাও কিন্তু বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। তাদের সাফল্য এক অর্থে বাংলাদেশের প্রতিটি নারীর সাফল্য।
তারা চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফেরার পর অনেক ফুলেল শুভেচ্ছা পেয়েছে। যদি চ্যাম্পিয়ন নাও হতো তাতে তাদের কৃতিত্ব কিছু কমতো না। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তাদের এত দূর এগিয়ে আসাই অনেক বড় সাফল্য। এই সাফল্যে সামান্য অভিবাদন কিংবা ফুলেল শুভেচ্ছাই তাদের জন্য যথেস্ট নয়। প্রয়োজন তাদের পৃষ্ঠপোষকতা। তবেই কেবল সম্ভব এগিয়ে যাওয়ার এই পথকে আরও দীর্ঘ করা।
আজাদ মজুমদার ।। যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, নিউ এইজ