বিপজ্জনক নগরীতে আমাদের বাস, করণীয় কী?
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে নগরায়ণের প্রবণতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-১১ অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, অভিঘাত সহনশীল এবং টেকসই নগর ও জনবসতি গড়ে তোলার কথা বলেছে। কিন্তু আজও কি আমরা একটি নিরাপদ এবং অভিঘাত সহনশীল নগরী গড়ে তুলতে পেরেছি?
রাজধানী ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশের নগরগুলোয় ঘটিত অগ্নি দুর্যোগ আজ বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর অনুমতি ও প্রত্যয়নপত্রের ঘাটতি উদ্ঘাটন সরকারি তদারকিতে গাফিলতিরই সমার্থক।
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ ঘটে যাওয়া বেইলি রোড অগ্নিকাণ্ড তারই বার্তাবাহক। আইনানুযায়ী, কোনো ভবনে রেস্তোরাঁ স্থাপনে সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রায় ১০টি প্রত্যয়নপত্র বা সনদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই সনদগুলো যথাযথভাবে প্রদান, পরবর্তী পরিচালনায় তার ব্যত্যয় এবং এই সনদগুলো ছাড়াই বিভিন্ন পরিষেবার সংস্থান হয়েছে কি না তা দেখার দায়িত্ব যেন কারও নেই।
আরও পড়ুন
সর্বোপরি, ভবন বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদেরও এই বিষয়ে কোনো দায় নেই। ফলে, দুর্ঘটনার পর অনুমোদন ও তদারকির দায়িত্বে থাকা সংস্থা সমূহ পরস্পরের ওপর দায় চাপানোর মধ্য দিয়ে দায়মুক্তির একটি ধারা তৈরি করেছে।
শুধুমাত্র নোটিশ দিয়ে ও ‘অনুমোদন নেই’ বলে দায় এড়ানোর ফলশ্রুতিতেই নগরজুড়ে একের পর এক মৃত্যুকূপ তৈরি হয়েছে এবং প্রতি বছর আত্মাহুতি দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) এবং অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩-এ বহুতল ভবনের উচ্চতা এবং ভবনের শ্রেণিবিভাগজনিত অসামঞ্জস্যতা বিদ্যমান। ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় (২০০৮) রেস্তোরাঁ ব্যবহারের আলাদা ধরণ চিহ্নিত নেই এবং বিএনবিসি (২০২০)-তে জনসমাগম ঘটে এমন স্থান, বিপদজনক ব্যবহার এবং বাণিজ্যিক রান্নাঘরকে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করে ফায়ার ইনডেক্সে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
যদিও বর্তমানে, ভবনের শ্রেণিবিভাগজনিত এইসব অসামঞ্জস্যতা নিরসন করা এবং বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ (ড্যাপ)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী ‘ঢাকা মহানগর এলাকায় অনুমোদনহীন/ইমারতের বিচ্যুতি/ব্যত্যয় সংক্রান্ত ইমারত-এর ব্যবস্থাপনার জন্য নীতিমালা’ প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে।
এছাড়া রাজউকের সাথে অন্যান্য সংস্থার তথ্য আদান প্রদানে পারস্পরিক সমন্বয়করণসহ রাজউকের পুরো সেবা প্রদান ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু কবে নাগাদ এসব প্রচেষ্টা কার্যকর রূপ নেবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ বা সময় নেই।
অপরদিকে ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা (২০১৪)’-টিও স্থগিত থাকার কারণে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না।
শুধুমাত্র নোটিশ দিয়ে ও ‘অনুমোদন নেই’ বলে দায় এড়ানোর ফলশ্রুতিতেই নগরজুড়ে একের পর এক মৃত্যুকূপ তৈরি হয়েছে এবং প্রতি বছর আত্মাহুতি দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।
দেশব্যাপী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণ বা নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এখনো পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। দেশজুড়ে ন্যূনতম ৭৩৫টি স্টেশন প্রয়োজন হলেও রয়েছে মাত্র ৪৯৪টি। পাশাপাশি অনুমোদিত জনবলের মাত্র ৪০ শতাংশ নিয়োজিত রয়েছে।
প্রধান প্রধান শহর ব্যতীত দেশের অন্যান্য শহরগুলোয় ভবন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণকারী কোনো কার্যকরী সংস্থা নেই। বিএনবিসি-এর নির্দেশনা অনুযায়ী আজ অবদি ‘বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিআরএ)’ গঠন করা যায়নি। ফলে দেশজুড়ে ‘টাইম বোমা’র মতো অবৈধ ভবন তৈরির কার্যক্রম থামছে না।
ড্যাপ প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা মহানগরীর প্রায় ৯৫ শতাংশ ভবন অবৈধভাবে নির্মিত মালিকদের কাছে জিম্মি। নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর কেমিক্যালের গোডাউনগুলো স্থানান্তরের প্রচেষ্টাও এদের কারণে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ পুঁজি ও পেশীশক্তির দৌরাত্ম্যে পরাভূত হয়েছে মনুষ্যত্ব এবং মূল্যবোধ।
আরও পড়ুন
দেশজুড়েই অপরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে নগরবাসীদের চিত্তবিনোদনের জন্য উন্মুক্ত স্থান, গণপরিসর এবং জলাশয়সমূহ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে অগ্নি নির্বাপণে প্রয়োজনীয় পানির জোগান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, যা এখন অত্যন্ত জরুরি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
পাশাপাশি, জলাশয়বিহীন অতিঘনত্বের নগরীর যে অংশে আর নতুন পুকুর বা জলাশয় গড়ে তোলা সম্ভব নয়, সেখানেও ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’-এর মতো অতি জরুরি অনুষঙ্গ অনুপস্থিত।
অবহেলাজনিত কারণে ঘটা ভবন অগ্নিকাণ্ড ও এর হতাহতের বিপরীতে ভবন নির্মাণ, অকুপেন্সি সার্টিফিকেট এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অনুমোদন প্রদানকারী ১০টি সংস্থাকে দায়ী করে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ এবং ভবন মালিককে ‘অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের’ আসামি হিসেবে গণ্য করে আইনের আওতায় আনা হোক। পাশাপাশি, পর্যায়ক্রমিকভাবে করণীয়গুলো দ্রুত সময়ে বাস্তবায়ন করা হোক।
১. আগামী ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সরকারি ৬টি মন্ত্রণালয় বা সংস্থার সমন্বয়ে ‘টাস্ক ফোর্স’ গঠনপূর্বক নগরীতে অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং তার দ্রুত যথাযথকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য শহরগুলোয় এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে ‘অতি বিপজ্জনক’ ও ‘বিপজ্জনক’ ভবনসমূহ চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি এর তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও সংশ্লিষ্ট ভবনসমূহের সম্মুখে দৃশ্যমানভাবে ‘চিহ্নিতকরণের’ উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক।
২. ভবন নির্মাণ এবং অনুমোদন সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি সংস্থা তাদের নিজ নিজ তথ্যসমূহ পারস্পরিক ব্যবহারের নিমিত্তে একটি ‘অনলাইন প্ল্যাটফর্ম’ অথবা ‘ওয়েবভিত্তিক পোর্টাল’-এর মাধ্যমে একীভূতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৩. রাজধানী জুড়ে বিদ্যমান ‘অবৈধ/অননুমোদিত/অনুমোদিত কিন্তু ব্যত্যয়কারী’ ভবনগুলো ড্যাপে অনুসৃত বিধান অনুযায়ী যথাযথকরণে ইতিমধ্যকার গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা দ্রুততম সময়ে অনুমোদন ও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দেশব্যাপী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণ বা নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এখনো পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। দেশজুড়ে ন্যূনতম ৭৩৫টি স্টেশন প্রয়োজন হলেও রয়েছে মাত্র ৪৯৪টি।
৪. নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সংস্থা হিসেবে সিটি কর্পোরেশনগুলোর নেতৃত্বে অন্যান্য অংশীজনের মাধ্যমে ভবনের ‘প্রতি বছর নবায়নযোগ্য ব্যবহার যোগ্যতা’র সনদ উক্ত ভবনের প্রবেশ অঞ্চলে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)-এর অনুসৃত নীতি অনুযায়ী ‘বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিআরএ)’ প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের সব ভবন নিরাপদ করার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৬. অবিলম্বে স্থগিত হয়ে থাকা ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা ২০১৪’-কে প্রয়োজনীয় সংশোধনী সাপেক্ষে দ্রুততম সময়ে অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
বর্তমানে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে অনুমোদিত জনবল পূর্ণাঙ্গকরণ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স-এর ‘সিভিল ডিফেন্স’ অংশকে শক্তিশালী করার উদ্যোগে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রশিক্ষিত জনগণ তৈরির কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করতে হবে। সব শিল্প ও বাণিজ্যিক ভবনে এরূপ প্রশিক্ষিত জনগণের নিয়োগ প্রদান বাধ্যতামূলক করতে হবে।
আরও পড়ুন
৭. সাংঘর্ষিক ও অস্পষ্টতা পরিহারপূর্বক অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-এর পারস্পরিক সামঞ্জস্যতা নিশ্চিত করে যথাযথকরণের আশু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৮. বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের তৈরিকৃত ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার ফর ডিজাস্টার’ অনুযায়ী কোনো দুর্যোগ সংঘটিত হলে তা মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব প্রদান করার বিধানটি পর্যালোচনাপূর্বক বাস্তবোচিত ও যথাযথকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৯. শিল্পাঞ্চলগুলোয় অগ্নি দুর্যোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জনে, ফায়ার স্টেশনবিহীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টসমূহে জরুরি ভিত্তিতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে ‘স্যাটেলাইট ফায়ার স্টেশন’ স্থাপন ও পরিচালনা করার সার্বিক ও সর্বাঙ্গীণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১০. অগ্নি ঝুঁকি ও নিরাপত্তা বিষয়ক নিয়মিত গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনায় আধুনিক প্রযুক্তির নির্ভরতায় ‘স্মার্ট প্রচার ও জনসংযোগ’-এর ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিতে হবে।
১১. অগ্নিকাণ্ড নির্বাপণে প্রয়োজনীয় পানি সংস্থানের উৎস হিসেবে নগরব্যাপী বিদ্যমান পুকুর, খাল এবং অন্যান্য জলাশয় পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করতে হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা’ আনয়নপূর্বক বর্তমান ঘনবসতিপূর্ণ নগরায়ণে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিতের উদ্যোগ নিতে হবে।
১২. নগর ব্যবস্থাপনায় সুশাসন-জবাবদিহিতা-ন্যায্যতার ভিত্তিতে দক্ষ এবং পর্যাপ্ত পেশাজীবীদের সমন্বয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ইকবাল হাবিব ।। স্থপতি ও নগরবিদ; সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)