মানুষ কত অসহায়
করোনায় আক্রান্ত মাকে বাঁচাতে অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে ছেলে পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে মোটরসাইকেলে করে হাসপাতালে যাচ্ছেন, গণমাধ্যমে এই ছবিটি দেখে দু’চোখে পানি ধরে রাখা গেল না। মনে হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার সেই বীর ছেলের কথা। যে ছেলে যুদ্ধ জয় করে রক্ত মেখে, ঘেমে মাকে ডাকাত দলের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। এরপর মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল! কী দুর্দশাই হোত তা না হলে।’ আমি নিশ্চিত জিয়াউলের মা, স্কুল শিক্ষিকা রেহানা পারভীনও সেই একই কথা ভেবেছেন ছেলেকে নিয়ে।
হ্যাঁ, জিয়াউল হাসান যেন সেই বীরপুরুষ রূপে ফিরে এসেছেন আমাদের সমাজে। মায়ের অক্সিজেন লেভেল ৮০ তে নেমে যাওয়ার পর, কোথাও অ্যাম্বুলেন্স, এমনকি অটোরিকশা বা কোনো থ্রি-হুইলার না পেয়ে নিজের পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার গামছা দিয়ে বেঁধে মোটরসাইকেলে মাকে নিয়ে সেই ঝালকাঠি থেকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করিয়েছেন। একদিনের মধ্যেই মায়ের অবস্থার উন্নতি ঘটেছে।
অথচ গত বছরে করোনার ছবি ছিল অন্যরকম। করোনা আক্রান্ত মা-বাবাকে রাস্তায় বা জঙ্গলে ফেলে রেখে সন্তানরা চলে গেছে। করোনায় কেউ মারা গেলে পরিবারের লোকজন তাদের মরদেহ গ্রহণ পর্যন্ত করতে চায়নি। কেউ কেউ হাসপাতালে বাবা-মা, স্বজনদের ফেলে পালিয়ে গেছে। করোনা আক্রান্ত হতে পারে, এই ভয়ে সন্তান বাবা-মায়ের লাশ থেকে বেশ দূরে থেকেছে। এ বছর দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর দেখলাম আমরা সেই স্টিগমা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। মানুষের ভয় কমে গেছে।
গত বছরে করোনার ছবি ছিল অন্যরকম। করোনা আক্রান্ত মা-বাবাকে রাস্তায় বা জঙ্গলে ফেলে রেখে সন্তানরা চলে গেছে। করোনায় কেউ মারা গেলে পরিবারের লোকজন তাদের মরদেহ গ্রহণ পর্যন্ত করতে চায়নি। কেউ কেউ হাসপাতালে বাবা-মা, স্বজনদের ফেলে পালিয়ে গেছে। করোনা আক্রান্ত হতে পারে, এই ভয়ে সন্তান বাবা-মায়ের লাশ থেকে বেশ দূরে থেকেছে।
তবে এখনো করোনা চিকিৎসায় রয়ে গেছে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি ও পরিকল্পনার অভাব। আমাদের স্বাস্থ্য সুবিধা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শহরকেন্দ্রিকই রয়ে গেছে। গ্রাম বা জেলা পর্যায়ে করোনা চিকিৎসাসহ প্রায় সব চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্বল। আর তাই তো করোনায় অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়ার জন্য জিয়াউল হাসানকে বাধ্য হতে হলো অসুস্থ মাকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় মোটরসাইকেলে বসিয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসতে।
এই ঘটনার রেশ না কাটতেই গণমাধ্যমে জানলাম, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার টাকা না থাকায় ৯ ঘণ্টা চার্জার রিকশা চালিয়ে ঠাকুরগাঁও থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে এসেছেন তারেক ইসলাম। এই ৯ ঘণ্টায় তারেককে অসুস্থ মেয়ে নিয়ে ১১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। সাত মাস বয়সী শিশু জান্নাত রক্ত পায়খানা করায় গত ১৩ এপ্রিল রাতে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে একদিন চিকিৎসা দেওয়ার পর চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য জান্নাতকে রংপুরে সুপারিশ করেন। কিন্তু লকডাউন পরিস্থিতিতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার টাকা না থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েন তারেক। চারদিন ধরে কোনো ব্যবস্থা করতে না পেরে অবশেষে নিজে চার্জার রিকশা চালিয়ে সন্তানকে নিয়ে রংপুরে আসেন। আহারে কী অসহায়ত্ব।
প্রশ্ন জাগে, কেন একজন শিশু রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো যন্ত্রপাতি বা চিকিৎসক ঠাকুরগাঁও এর মতো পুরনো জেলা সদর হাসপাতালে নেই? কেন এই লকডাউনের মধ্যে বাবাকে চার্জার রিকশা চালিয়ে মেয়েকে রংপুর হাসপাতালে নিয়ে আসতে হলো?
করোনা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, অথচ করোনা চিকিৎসা এখনো রাজধানীকেন্দ্রিক। গত বছরেও তাই ছিল। গণমাধ্যমে দেখলাম ৩৬ টি জেলার প্রধান হাসপাতালে কোনো আইসিইউ ইউনিট নেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে কিন্তু আমাদের বিবেকের কোনো পরিবর্তন আসেনি, দুর্নীতিতেও কোনো কমতি পড়েনি।
গত একমাস ধরে যখন মানুষের মধ্যে করোনা চিকিৎসা নিয়ে হাহাকার শুরু হয়েছে, তখন সরকার করোনা চিকিৎসায় সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বললেও, আদতে এখনো কিছু করতে পারেনি। খোদ রাজধানীতে করোনা চিকিৎসার জন্য ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা যোগ করা হলেও, জেলা শহর ও মাঠ পর্যায়ে হাসপাতাল তৈরি, নতুন কোভিড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাসহ আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারটি এখনো পরিকল্পনা পর্যায়েই রয়েছে। প্রশ্ন হলো, গত একবছরে স্বাস্থ্যখাতে কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে? সেই উন্নয়ন কেন জনগণের কাছে পৌঁছাচ্ছে না?
আমরা ধরেই নিয়েছি করোনা রাজধানী নির্ভর। শুধু এখানকার মানুষ বাঁচলেই হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটাই নাজুক যে সেখানে করোনা ঢেউ সামলানো খুবই কঠিন।
প্রতিদিন শতাধিক রোগী মারা যাওয়ার পরও সরকারের সব উদ্যোগ কেন এখনো পরিকল্পনা পর্যায়ে আটকে আছে? কারণ ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি আমাদের স্বাস্থ্যখাত কতটা অযোগ্য এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। করোনা বিষয়ক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রাজধানীকেন্দ্রিক এবং এইখাতে প্রশাসনিক দুর্বলতাও চূড়ান্ত।
কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে বা অভিযোগ প্রমাণিত হলে, তাকে শুধু বদলি করা হয় বা ওএসডি করা হয়। বড় জোর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। এই অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি এবছরও।
আমরা ধরেই নিয়েছি করোনা রাজধানী নির্ভর। শুধু এখানকার মানুষ বাঁচলেই হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটাই নাজুক যে সেখানে করোনা ঢেউ সামলানো খুবই কঠিন। কীভাবে সমন্বিত কায়দায় দেশজুড়ে করোনা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে, সে বিষয়ে এখনো সরকার কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে শোনা যায়নি।
করোনার মতো একটি মহামারি দ্বিতীয় দফায় ঠেকানোর জন্য স্বাস্থ্যখাতের প্রস্তুতি খুবই নামমাত্র। এই নামমাত্র প্রস্তুতি নিয়ে প্রথম ঢেউ ঠেকানো গেলেও দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকানো অসম্ভব। অসম্ভব বলেই অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে বা ৯ ঘণ্টা চার্জার রিকশা চালিয়ে চিকিৎসার জন্য ছুটতে হচ্ছে। এই ছুটে চলার অবসান কবে হবে কেউই জানে না।
শাহানা হুদা রঞ্জনা ।। সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন