পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই!
শিক্ষা খাতে তিনটি দুঃসংবাদ আমাদের ভাবাচ্ছে। প্রথমটি হলো, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলো জেলা ও বিভাগের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাচ্ছে। দ্বিতীয়টি হলো, সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হবে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারের ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আদায় সংক্রান্ত আপিল নিষ্পত্তি করে আদালত এই রায় দিয়েছেন।
তৃতীয়টি হলো, সংশোধিত এডিপিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বড় ‘কোপ’। অর্থাৎ সংশোধিত এডিপিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমছে ১৬,৫০০ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কম থাকায় শিক্ষা খাতে সাড়ে ১২ হাজার কোটি ও স্বাস্থ্যে ৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কমছে।
শিক্ষা নিয়ে আমাদের এমনিতেও ভালো সংবাদ নেই। যা কিছু সিদ্ধান্ত হয় তা আরও অধঃপতনের দিকে ত্বরান্বিত করছে। এর মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রম তো মূলধারার শিক্ষাকে পুরো ধ্বংস করে দেবে। এত প্রতিবাদ, এত কথা তবুও সরকার নাছোড় বান্দা ‘পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই’-এর মতো এই বিশাল ক্ষতির প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বলেই গোঁ ধরেছে।
আরও পড়ুন
ঢাকার ৭টি বড় বড় কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান নামিয়ে দিয়েছে। এখন বাকি যেই বিশ্ববিদ্যালয় আছে তার দিকে নজর গিয়েছে। কলেজগুলোর মান একটু বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নামবে।
এমনিতেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও গবেষণার মান খুব খারাপ। এর ওপর এইগুলোর ঘাড়ে কলেজ চাপিয়ে দিলে এদের মান আরও খারাপ হবে।
কলেজের গড় একটু বাড়াতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান কমানো জাতির জন্য কি আদৌ মঙ্গলজনক হবে? একদমই না। তাও যদি কলেজের মান অনেক বাড়ানো যেত তাহলে ভেবে দেখা যেতে পারতো।
এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু গবেষণা করে দেখা উচিত ছিল ঢাকার ৭টি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান কি বৃদ্ধি পেয়েছে? বা এতে কি আদৌ দেশের লাভ হচ্ছে?
সাত কলেজের কাজ করে শিক্ষকরা কিছু টাকা পয়সা পাচ্ছে এই লোভে অনেক শিক্ষকও এর পক্ষে। কিন্তু বড় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মোটেই উপকারি নয়।
যেই বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজের ভার বহন করতে পারছিল না সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাড়ে তার নিজের সমান আরও ৭টি প্রতিষ্ঠানকে চাপিয়ে দিয়ে কীভাবে তার মান বৃদ্ধি করবে? আমি এখন ৭ কলেজের একটি বর্ষের পরীক্ষা কমিটির সভাপতি। আমি টের পাচ্ছি আমার ওপর দিয়ে কী তুফান যাচ্ছে।
ওদের পরীক্ষার প্রশ্ন করা, মডারেশন করা, প্রশ্নপত্র ছাপানো ইত্যাদি তো আছেই তার ওপর ৭ কলেজের ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য বহিরাগত পরীক্ষক পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন আমার বিভাগের কয়েকজন শিক্ষককে ৭ কলেজের একাধিক কলেজে দৌড়াতে হয় যার ফলে ওই শিক্ষকরা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে সার্ভিস দিতে পারছে না।
আরও পড়ুন
নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ওই শিক্ষকদের সার্ভিস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ওই শিক্ষকরা নিজের লেখাপড়া ও গবেষণা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই গল্প বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি বিভাগের। সাত কলেজের কাজ করে শিক্ষকরা কিছু টাকা পয়সা পাচ্ছে এই লোভে অনেক শিক্ষকও এর পক্ষে। কিন্তু বড় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মোটেই উপকারি নয়।
পশ্চিমবঙ্গের অনেক কলেজও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তার কুফল তারা ভোগ করছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও পেছনে। মনে রাখতে হবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গ্র্যাজুয়েট নেই। আছে কেবল মাস্টার্স আর পিএইচডি প্রোগ্রাম।
কলেজগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হওয়া সত্ত্বেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কলেজগুলোর পরীক্ষার সাথে কোনোভাবেই জড়িত না। অর্থাৎ পরীক্ষার প্রশ্ন করা থেকে শুরু করে ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলো কলেজগুলোই নেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল সার্টিফিকেট দেয় আর সর্বোপরি তদারকি করে।
পৃথিবীর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন কী করে? সর্বদা চেষ্টা করে কী করে তার শিক্ষকদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়। তারা চেষ্টা করে যেই কাজ একজন কম শিক্ষিত ও কম যোগ্য মানুষদের দিয়ে করানো যায় সেই কাজ তারা তাদের সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষকদের দিয়ে করায় না। তার জন্য তারা টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট নেয়, পার্টটাইম ও অ্যাডজাঙ্কট শিক্ষক নিয়োগ দেয়। আমরা তো তা করছিই না উল্টো আমাদের দিয়ে নিজ বিভাগের বাইরে ৭টি কলেজের ঘানি টানাচ্ছে।
দেশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের। সরকার তো দায়িত্ব পালন করছেই না উল্টো বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করছে।
এই দুঃসংবাদের মাঝে আরও একটি দুঃসংবাদ হলো এখন থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হবে। এটা শেষমেশ কাদের ঘাড়ে পড়বে? আমরা তো আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চিনি। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তাদের মালিক আছে এবং মালিকরা নানাভাবে মুনাফা নেয়। এখন কি মালিকরা মুনাফা নেওয়া কমিয়ে দেবে? মোটেও না।
তারা ট্যাক্সের টাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই আদায় করবে। এর মানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া আরও ব্যয়বহুল হবে। দেশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের। সরকার তো দায়িত্ব পালন করছেই না উল্টো বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করছে। ফলে শিক্ষার্থীরা আরও বিদেশগামী হবে।
আরও পড়ুন
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আরও বেশি হারে বিদেশে চলে যাবে। যদি দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে পারতাম আমাদের ধারণা আছে, কী পরিমাণ ডলারের সাশ্রয় হতো? শুধু তাই না ব্রেইন ড্রেইনও কমতো।
ঐদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে কম খরচ করে আমাদের সোনার বাংলাদেশ। শিক্ষা খাতে জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ আর স্বাস্থ্য খাতে তা ১ শতাংশেরও কম। করবে না কেন?
এসব বরাদ্দের দায়িত্বে যারা তারা বা তাদের সন্তানরা কি এই দেশের পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে বা এই দেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়? এইখানেই সব সমস্যার ভূত লুকিয়ে আছে। যতদিন না আমরা দেশের এমপি, মন্ত্রী, আমলা ও তাদের সন্তানদের এই দেশের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে ও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করবো ততদিন এই দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে না।
তারা যেকোনো অজুহাতেই সিঙ্গাপুর, ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় দৌড় দেবে। তাদের ছেলেমেয়েরা পড়ে ইউরোপ, কানাডা কিংবা আমেরিকায়। তারা কেন এই দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিষয়ে বিশেষ নজর করবে? কেন?
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়