সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনীহা কেন?
সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করব? এটা অসম্ভব। এতে না থাকে সম্মান, না থাকে সন্তানের ভবিষ্যৎ। এটাই বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতা। বিশেষ করে শহরগুলোতে কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি স্কুলগুলোতে আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ভর্তি করানোর প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। এমনকি বাসস্থানের কাছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও দূরের কোনো কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি স্কুলগুলোতে ঝুঁকছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেনগুলোতে নেই কোনো সরকারি নীতিমালার বাস্তবায়ন। শুধুমাত্র বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের জন্য বাহিরের চাকচিক্য দেখিয়ে অভিভাবকদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে। এই সুযোগে প্রতি বছর সেশন ফি তো আছেই আরও আছে ক্লাস টেস্ট, মডেল টেস্ট নামের বাণিজ্য।
আমার প্রশ্ন হলো, সরকার প্রতি বছর বাজেটে শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে কি ভুল করছে? নাকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া মানসম্মত নয়? গত ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে বাংলাদেশ সরকার শিক্ষায় বরাদ্দ দিয়েছে মোট বাজেটের ১১.৬৯%।
বাংলাদেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৩ হাজার ৬০১টি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকেন। যেখানে প্রতিযোগিতামূলক লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত করে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীতে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের ডিপিএড প্রশিক্ষণ এবং সকল বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠানো হয়।
পাঠদানে যাতে কোনো রকম সমস্যা না হয় সেজন্য প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পাঠদানে আগ্রহ তৈরি হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গার্ল গাইডসের হলদে পাখি কার্যক্রম, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। যদি তুলনামূলক বিশ্লেষণে যাই তাহলে বলা যায় এর কোনো ছিটেফোঁটাও পাওয়া যাবে না ঐ সকল কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে।
সাধারণ মানুষের ধারণা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা। কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর এবং অবশ্যই পরিচ্ছন্ন। কিন্ডারগার্টেনগুলোর তুলনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাকচিক্য কম হতে পারে। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের অজুহাতে সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান না।
কোনো এক অজানা কারণে জন্য সচ্ছল অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে যান বেসরকারি স্কুলগুলোতে। আমার এই লেখা কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি স্কুলগুলোর বদনাম করা নয় বরং আমি বলতে চাই অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি অনীহা কেন?
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ভর্তি না করানোর কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই—
১. শিক্ষা ঘণ্টা নিয়ে অভিযোগ। কিন্ডারগার্টেনগুলোতে প্লে/ নার্সারিতে বাচ্চাদের ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা পাঠদান করানো হয়। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সেখানে পাঠদান করানো হয় ৪-৫ ঘণ্টা। আবার কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি স্কুলগুলোতে তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা ঘণ্টা ৫-৬ ঘণ্টা, সেখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮-৯ ঘণ্টা। এই যে প্রতি ক্ষেত্রে প্রায় ৩-৪ ঘণ্টার ব্যবধান সচ্ছল পরিবারের অভিভাবকরা মানতে চান না। তারা মনে করেন এতে ছোট শিশুরা শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়বে।
২. সাধারণ মানুষের ধারণা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা। কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর এবং অবশ্যই পরিচ্ছন্ন। কিন্ডারগার্টেনগুলোর তুলনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাকচিক্য কম হতে পারে। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের অজুহাতে সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান না।
৩. কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি স্কুলগুলোতে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি কয়েকটি আনুষঙ্গিক বই পড়ানো হয়। যা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত নয়। এই আনুষঙ্গিক বই পড়ানোর জন্য অভিভাবকরা খুশি হন এই ভেবে যে, তাদের সন্তান অনেক পণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে। এই মানসিক কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ভর্তি করান না।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার মান ভালো। এখানকার শিক্ষকরা যোগ্য, দক্ষ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কিন্তু এই বিষয়গুলো অভিভাবকরা জানেন না আবার জানলেও মানতে চান না। এই অজানা কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ভর্তি করান না।
৪. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মমুখী বাচ্চাদের শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য ৮-৯ ঘণ্টা শিক্ষা ঘণ্টা করা হয়েছে। সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা কর্মজীবী বাচ্চাদের সঙ্গ পছন্দ করেন না। এই ভুল ধারণার জন্য অভিভাবকরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিমুখ। এর পাশাপাশি শিক্ষা ঘণ্টা বেশি হওয়ার জন্য ঝরে পড়ার সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে।
৫. একটা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা আছে অভিভাবকদের। তারা মনে করেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেতন কম। তাই পড়াশোনার মান খারাপ। বেশি বেতনের স্কুলে পড়ানো একটা সামাজিক স্ট্যাটাসও মনে করেন। এই মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার কারণে সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি এলার্জি।
৬. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার মান ভালো। এখানকার শিক্ষকরা যোগ্য, দক্ষ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কিন্তু এই বিষয়গুলো অভিভাবকরা জানেন না আবার জানলেও মানতে চান না। এই অজানা কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ভর্তি করান না।
৭. অনেকের অভিযোগ কিন্ডারগার্টেনগুলোতে প্লে/ নার্সারি ক্লাস আছে। এতে বাচ্চারা স্কুলমুখী হয় ছোট বয়সে। কিন্তু অভিভাবকরা জানেন না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণি নামে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি আছে। যা প্লে/ নার্সারির আদলে গড়ে তোলা হয়েছে।
তাছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিনিয়ত জেলা শিক্ষা অফিসারের তত্ত্বাবধানে সার্বক্ষণিক পড়াশোনা মানসম্মত করার জন্য পরিদর্শন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তারপরও অভিভাবকদের অনীহা।
এ রকম নানাবিধ সমস্যার আবর্তে ঘুরছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির অনীহা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো আমিও বলছে চাই, ‘আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই। যা কেবল তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়।’
শারমিন চৌধুরী ।। সহকারী শিক্ষক, শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, টিকাটুলি, ঢাকা