মেলা নিয়ে ‘ম্যালা’ কথা
একটা জনগোষ্ঠী একত্রিত হলে তাদের সামষ্টিক চরিত্রটা ভেসে ওঠে। তা কাঁচাবাজারে হোক আর ধর্মালয়, স্থান-কাল বিবেচ্য নয়। বইমেলা এর ব্যতিক্রম নয়। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা এখন ২ কোটির বেশি। একুশের বইমেলায় কম করে ষাট থেকে সত্তর লাখ মানুষ আসে পুরো মাসে। কিন্তু বই কেনে ক’জন?
বইমেলা মূলত একদল ফূর্তিপ্রিয় মানুষের উদ্দেশ্যবিহীন ছোটাছুটির স্থানে পরিণত হয়েছে। এরা ঠেলা-ধাক্কার মধ্যে সমবেত হওয়ার আনন্দ খুঁজে ফেরে। এরা সারাবছর ঠেকায় পড়ে কিছু বই হয়তো হাতড়িয়েছে, কিন্তু সদার্থে বই পাঠের ধারে কাছে নেই।
ঠিক এই রকম কিছু লেখকের আবির্ভাব ঘটে মেলার মাঠে আর সোশ্যাল মিডিয়ার হাটে। ১১ মাস ধরে ঘুমিয়ে থাকা এক দানব যেন জেগে ওঠে মেলার আওয়াজ পেয়েই। সারাবছর কোথাও এদের সাহিত্যকর্ম চোখে পড়ে না। নেই পড়াশোনার সঙ্গে ন্যূনতম সংযোগ। মেলা এলেই ঝকমারি বিজ্ঞাপন আর ‘ধকমারি’ ঘোষণায় পাঠককূলকে নাড়িয়ে দেয়।
আরও পড়ুন
এর মাঝে আছেন আরেকদল। এরা বই ছাপায়। এরাও দানবের মামতো ভাই। এরা অবশ্য ঘুমায় একটু কম। ১০ মাস। ঠিক মেলার আগে আগে এরা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। সারাবছর কোনো বহুতল ভবনের তলকুঠুরে না হয় চিলেকোঠায় এরা আধমরার মতো পড়ে থাকে। কিন্তু মেলায় এদের সজীব রূপ দেখে মনে হয় সত্যিই বসন্ত এসে গেছে।
বইমেলা মূলত একদল ফূর্তিপ্রিয় মানুষের উদ্দেশ্যবিহীন ছোটাছুটির স্থানে পরিণত হয়েছে। এরা ঠেলা-ধাক্কার মধ্যে সমবেত হওয়ার আনন্দ খুঁজে ফেরে। এরা সারাবছর ঠেকায় পড়ে কিছু বই হয়তো হাতড়িয়েছে, কিন্তু সদার্থে বই পাঠের ধারে কাছে নেই।
বইমেলা যে তিনটি গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়, তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক সামাজিক কিংবা অন্য কোনো ক্ষেত্রগত অমিল থাকতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে দুটো চারিত্রিক ঐক্য দেখবার মতো। এক. এরা উদ্দেশ্যবিহীন। দুই. এরা বাজারচালিত (হুজুগে বা স্রোতমুখী বলা চলে)।
তাই বলে কি একটা সত্যিকারের একনিষ্ঠ পাঠক গোষ্ঠী এই দেশে নেই। নিবেদিতপ্রাণ প্রকাশক। প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। আছে। কিন্তু এরা এই বিপুল সমুদ্রের কাছে এতই নগণ্য যে জাতীয় চরিত্র রূপায়নে কোনো ভূমিকা রাখে না। বরং সারবত্তাহীন একটা সমাজ যেন উঠে আসে এই বইমেলায়। কিন্তু এভাবেই কী পড়ে থাকবে একটা জাতির সাহিত্য জগৎ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেই হয়, কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যা রবি…
একটা কল্যাণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার জনগণকে সুস্থ বিনোদন ও জ্ঞানচর্চার ব্যবস্থা করা। সেই উদ্দেশ্যে আমাদের দেশে অনেক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি। আমাদের মতো অর্থনীতির অনেক দেশে এত কিছু নেই। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। রূপকথার দৈত্যের মতো এদের প্রাণভোমরাটা রেখেছে অন্য কারও কলসিতে।
এরা সাহস করে উঠে দাঁড়াতে চাইলেই মেরুরজ্জুতে টান পড়ে। আর মেরুরজ্জুর উপরে যে মাথাটা বসে, তা কেন যেন দেহের চেয়ে ওজনদার। তা কখনোই স্বাধীনভাবে স্থিত হতে পারে না। এসব প্রতিষ্ঠানে কবি সাহিত্যিকরাই স্থান পান। হয়তো স্থানিক গুণে এদের সৃষ্টিশীল সত্তাটা বিকৃত হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
এসব প্রতিষ্ঠান যেসব ব্যক্তিদের পুরস্কার, পদবি দিয়ে স্বীকৃতি দেয়, অনেক ক্ষেত্রেই এদের সাহিত্যকীর্তির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বইমেলায় উদ্দেশ্যবিহীন ছুটে চলা লেখকদের চেয়ে এদের লেখালেখির উৎকর্ষ খুব বেশি বলা যাবে না। এদের স্বীকৃতি দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠকদের সামনে একটি জাতীয়-মান তুলে ধরছে। ফলে পাঠক এই মানকে সামনে রেখে বই পড়ায় উৎসাহী বা অনুৎসাহী হচ্ছে।
সমস্যাগুলো আসলে উপরিতলের। মেলা এলে এইসব নিয়ে আমরা চিন্তিত হয়ে উঠি। কিন্তু তলিয়ে দেখা হয় না। লেখালেখির বীজতলা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেইখানে পঠন-পাঠনের সংস্কৃতি থাকবে। তা থেকে ভবিষ্যতের লেখকরা বেরিয়ে আসবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে গেছে কোচিং সেন্টারগুলোর রেস্ট হাউস।
শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। জ্ঞানচর্চা কিংবা আত্মবিকাশ এখানে উদ্দেশ্য নয়। শিক্ষকরা নিতান্ত পেশাজীবীর ভূমিকায় থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে সেই ভূমিকা আরও দুঃখজনক।
মোট কথা, পাঠবিমুখ এক সমাজ তৈরি করেছি আমরা। বইমেলা এলে বিষয়টা আমাদের নজরে আসে। তখন মনে হয় সমস্যাটা একান্ত লেখক ও প্রকাশকদের। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় তা এক অশুভ ভবিষ্যতের পূর্বাভাস।
আরও পেছনে গেলে হতাশাও জাগে মনে। বিদ্যালয়গুলোর বার্ষিকীর লেখালেখি মান দেখলে বোঝা যায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কেউ স্বাধীনভাবে লিখতে ও ভাবতে শিখছে না।
দেশে অন্তত ৫০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বছরে কম করে হলেও ১০ হাজার টাকার বই কেনার তহবিল থাকে। কয়টা বই কেনে প্রতিষ্ঠানগুলো? এরা বই কিনলে তো বইয়ের বাজার এত সংকুচিত হয়ে আসত না।
আরও পড়ুন
বিদ্যালয়ে একটা করে লাইব্রেরিয়ানের পদ তৈরি করা হয়েছে। এরা এখন সবাই শিক্ষক হয়ে গেছেন। লাইব্রেরি বন্ধ রেখে বাংলা কিংবা গণিতের ক্লাস নেন। লাইব্রেরি যে বাংলা, গণিত ক্লাসের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় তা কে বোঝাবে তাদের?
মোট কথা, পাঠবিমুখ এক সমাজ তৈরি করেছি আমরা। বইমেলা এলে বিষয়টা আমাদের নজরে আসে। তখন মনে হয় সমস্যাটা একান্ত লেখক ও প্রকাশকদের। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় তা এক অশুভ ভবিষ্যতের পূর্বাভাস।
মস্তিষ্কহীন রুচিবর্জিত ভোগসর্বস্ব এক জনগোষ্ঠী গড়ে তুলছি আমরা। পুরো জাতি বইমুখী করার জন্য জাতীয় পর্যায়ের উদ্যোগ জরুরি হয়ে পড়ছে।
জয়দীপ দে ।। কথাসাহিত্যিক