নারী মরে গেলেও কেন কুৎসা থামে না?
সম্প্রতি করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। মৃত্যুর মিছিলে ৩২ শতাংশ নারী। আমরা ইতোমধ্যে বেশকিছু প্রথিতযশা ব্যক্তিকে হারিয়েছি, যার মধ্যে আছেন জাতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ সমাদৃত একুশে পদক প্রাপ্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক ও দেশবরেণ্য তারকা অভিনেত্রী, মুক্তিযোদ্ধা, সংসদ সদস্য, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত কবরী সারওয়ার এবং ৭১ টেলিভিশনের প্রতিশ্রুতিশীল সহযোগী প্রযোজক রিফাত সুলতানা।
লক্ষণীয় যে, এই তিনজন গুণী নারীর কোভিড-উদ্ভূত মৃত্যু জনগণকে যেমন ব্যথিত করেছে, তেমনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই তিনজন নারীর মৃত্যুর পর অনাকাঙ্ক্ষিত, কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল মন্তব্যের উপস্থিতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই তিনজন নারী তাদের কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শ্রম ও সৃজনশীল মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন।
প্রকৃত ধর্মের প্রকৃতি অন্যরকম। দেশ-জাতি-বর্ণ-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে যা সকল মানুষের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে, তাই মানুষের ধর্ম—মানব ধর্ম। বলা উচিত, মনুষ্যত্বই মানুষের ধর্ম।
তাদের বস্তুনিষ্ঠ অবদান এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল ধ্যানধারণা সমাজের একটি অংশকে অপ্রত্যাশিত মন্তব্য করতে প্রলুব্ধ করছে। তিনজন নারীর মৃত্যু ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হলেও ধর্মের দোহাই দিয়ে বলা হয়েছে যে, করোনায় কেবল পাপীদের মৃত্যু হয়। কেন তাদের পাপী হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে? এর অন্যতম কারণ হল রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে নারীর অবস্থান অধস্তন। পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে লিঙ্গীয় শ্রম বিভাজন, শোষণ এবং ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধকে দায়ী করা যায়। অধস্তন চাপ প্রয়োগ এবং আত্মস্থকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই তিনজন প্রয়াত নারীর মধ্যে মিতা হক ও কবরী সারওয়ার প্রকাশ্যে এবং রিফাত সুলতানা নীরবে প্রতিবাদ করে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে অবদান রেখে গেছেন।
করোনা সংক্রমিত রিফাতের সিজারিয়ান অপারেশনে কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার পর মৃত্যু হয়। এই সাহসী সাংবাদিকের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে উগ্রপন্থী রাজনীতিবিদদের সঠিক পথে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে-রিফাতকে দাফন করা হবে নাকি পুড়িয়ে ফেলা হবে। কেননা, তাদের মতে রিফাত বড় মাপের নাস্তিক ছিল। মিতা হকও এভাবে চিত্রিত হয়েছেন।
উগ্রপন্থীদের নারী বিদ্বেষমূলক ব্যাখ্যায় স্মরণ করতে চাই, বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী পুরোধা ব্যক্তিত্ব বেগম সুফিয়া কামালকে। তার মতে, ইসলাম ধর্মে নারীর অধিকার নির্দিষ্ট থাকার পরেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ধর্মের পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করে। তিনি একজন ধর্মপরায়ণ নারী হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও হুমকি থেমে থাকেনি।
ভিন্নমত প্রকাশ গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলেও প্রগতিশীলতার সঙ্গে রক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব আবহমান কাল ধরে বিদ্যমান। এই সমাজে নারীর প্রগতিশীল মতামতকে তীব্রভাবে আক্রমণ করা হয়। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নারীকে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয়ভাবে অধস্তন ভাবার জন্য স্বল্প শিক্ষিত মানুষের মাঝে কিছু পীর কর্তৃক ধর্মের অপপ্রচারকে দায়ী করেন। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার হওয়া বঞ্চিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেছিলেন।
‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নারীকে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয়ভাবে অধস্তন ভাবার জন্য স্বল্প শিক্ষিত মানুষের মাঝে কিছু পীর কর্তৃক ধর্মের অপপ্রচারকে দায়ী করেন। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার হওয়া বঞ্চিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেছিলেন।
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ প্রগতিশীল রাজনীতি এবং মতাদর্শের পুরোধা ব্যক্তিদের হারানোর মধ্য দিয়ে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রান্তিকালে প্রবেশ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন, মিতা হকের মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২০১২ সালের রামুর ঘটনার পর স্বোপার্জিত স্বাধীনতা প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সভায় মিতা হকের গলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ‘ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রুকুটিতে দাও ছেড়ে দাও, ওগো, আমি তুফান পেলে বাঁচি’- উল্লেখ করে গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলেছেন—এই গানের বাংলাদেশ থাকবে তো?
যে গানের তরী পঞ্চ কবির হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়ে বাংলাকে তার রসে-রঙ্গে-সুরে-প্রাণে ভাসিয়েছে, সে মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিচলিত করেছিল। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা তীব্র আকারে নারীর বিরুদ্ধে মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রত্যক্ষ করছি। নানা ইতিবাচক পরিবর্তন হলেও নারীদের অবস্থানের ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন এখনো হয়নি। তাই ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছে। তাই, সহজ প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কী চাই?
প্রকৃত অর্থে, বৈষম্য, ধর্মীয় অপপ্রচার, অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির বিনাশ চাই। এসবের বিপরীতে আছে মমতা, ন্যায়, ন্যায়বিচার, শান্তিপূর্ণ অবস্থান। ধর্ম সবার জন্য। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাফের, মোনাফিক, নাস্তিক বলে গালি দেওয়া গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়।
সাংবাদিক শাকিল আহমেদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, কেমন করে একটা দেশে এরকম পশ্চাৎপদ এবং ধর্মের ভুল ব্যাখ্যাকারী মানুষ তৈরি হয়ে চলেছে। যারা কেবল নিজের ভ্রান্ত বিশ্বাসে অন্ধ এবং ধর্মের নামে উগ্রবাদের বিষ ছড়িয়ে দেশকে আসলে আফগানিস্তান বানাতে চায়। তিনি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন।
প্রকৃত ধর্মের প্রকৃতি অন্যরকম। দেশ-জাতি-বর্ণ-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে, যা সকল মানুষের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে, তাই মানুষের ধর্ম—মানব ধর্ম। বলা উচিত, মনুষ্যত্বই মানুষের ধর্ম। তাই বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে সবাইকে উগ্র ধর্মীয় শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। শুদ্ধ সংস্কৃতি ও শুদ্ধ গানের মানুষ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক, চলচ্চিত্রের বরেণ্য অভিনেত্রী কবরী ও রিফাত সুলতানার মতো সংবাদ তৈরির কারিগরের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হবে। তবে তা সহজ নয়।
অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম ।। ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক তথ্য কমিশনার