বায়ু দূষণে মৃত্যুর দায় কি পরিবেশ মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে?
বিশ্বব্যাপী অক্ষমতা এবং মৃত্যুর শীর্ষ কারণ হচ্ছে দূষণ। প্রতিবছর প্রায় ৯০ মিলিয়ন মানুষ দূষণে মারা যায় যার দুই-তৃতীয়াংশ মারা যায় শুধুমাত্র বায়ু দূষণের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যমতে, বায়ু দূষণ বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ মিলিয়ন লোককে হত্যা করে।
মূলত স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার ফলে একজন ব্যক্তির হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ এবং ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
পৃথিবীতে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করে তার তালিকা প্রকাশ করে। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আইকিউ এয়ার-এর তথ্যমতে ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ দূষিত নগরীর তালিকায় ঢাকা ছিল ৪ নম্বরে। যদিও ঢাকাকে পেছনে ফেলে ঘানার আঙ্কারা, ভারতের দিল্লি ও কলকাতার অবস্থান আরও উপরে।
আরও পড়ুন
খারাপের দিক হলো, ঢাকা তার শীর্ষ ৫-এ অবস্থান প্রায় প্রতিদিনই ধরে রাখছে। বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে অল্প কয়েকটি জেলা বাদে প্রায় সব জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। শীতকালে বৃষ্টি না থাকার কারণে বাংলাদেশে বায়ু দূষণ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে যায়।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা এবং টেলিভিশন বায়ু দূষণ ও প্রতিকার নিয়ে সোচ্চার। যুগের পর যুগ ধরে বায়ু দূষণ নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, লেখালেখি, প্রতিবাদও প্রতিরোধ হলেও উন্নতি হচ্ছে না বায়ুমানের।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের পরিবেশ সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী, বৃহত্তর ঢাকার বায়ু দূষণের অন্যতম উৎস ইটভাটা। কয়েক বছরে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে নির্মাণসামগ্রীর চাহিদা এবং ব্যবহার বেড়েছে।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা এবং টেলিভিশন বায়ু দূষণ ও প্রতিকার নিয়ে সোচ্চার। যুগের পর যোগ ধরে বায়ু দূষণ নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, লেখালেখি, প্রতিবাদও প্রতিরোধ হলেও উন্নতি হচ্ছে না বায়ুমানের।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৭ হাজার ৮৬টি ইটভাটা রয়েছে। এই ইটভাটাগুলোর কাঠ-কয়লা পোড়ানো এবং কালো ধোঁয়া তৈরি বায়ু দূষণের মূল কারণ। ইটভাটা তৈরি করার জন্য পরিবেশের ছাড়পত্র প্রয়োজন হলেও দেশের ৪ হাজার ৫০৫ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।
এইসব ইটভাটা শুধুমাত্র পরিবেশের ক্ষতি করছে এমনটি নয়। কৃষি জমির মাটি এবং ফসলের ক্ষতিও করছে। ইটভাটা উর্বর মাটি ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে বায়ু, মাটি ও প্রকৃতির অপূরণীয় স্থায়ী ক্ষতি করছে।
ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা করা যাবে না। কৃষিজমিতেও ইটভাটা অবৈধ। অথচ দেশের প্রায় বেশিরভাগ ইটভাটাতেই এই আইন মানা হচ্ছে না।
আরও পড়ুন
বায়ু দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে ইটভাটার কথা বলা হলেও বিশ্ব ব্যাংকের সমীক্ষা বলছে এটি ১৩ শতাংশ দায়ী। রান্নার চুলায় ব্যবহৃত জ্বালানি থেকে আসে বায়ু দূষণের ২৮ শতাংশ। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৪ শতাংশ, রাস্তার ধুলা থেকে ১৩ শতাংশ, শহরের বর্জ্য পোড়ানো থেকে ১১ শতাংশ এবং যানবাহন থেকে ৫ শতাংশ দূষণ হয়। বাকি ৬ শতাংশ দূষণ অন্যান্য উৎস থেকে হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি আন্তসীমান্ত বায়ু দূষণের জন্যও এখানকার বায়ু দূষিত হয়ে থাকে।
প্রতিবছর শীতকালে খারাপ পরিস্থিতি হওয়া সত্ত্বেও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বায়ু দূষণ রোধে নির্দেশিকার বাস্তবায়ন দেখা যায় না। নির্দেশিকায় রাস্তা নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, বিটুমিনের ওপর বালু না ছিটিয়ে মিনি অ্যাসফল্ট প্ল্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, রাস্তার পাশের মাটি কংক্রিট বা ঘাসে ঢেকে দেওয়া, রাস্তা পরিষ্কারের ঝাড়ুর পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বড় সড়কে কমপক্ষে দুইবার পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া—কোনোটি কার্যকর করার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।
ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা করা যাবে না। কৃষিজমিতেও ইটভাটা অবৈধ। অথচ দেশের প্রায় বেশিরভাগ ইটভাটাতেই এই আইন মানা হচ্ছে না।
বাংলাদেশে নির্মাণসামগ্রী রাখা বা পরিবহনের সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিমালা না থাকায় নির্মাণস্থলগুলোয় প্রচুর ধুলাবালি থাকে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শীতকালে ঢাকায় প্রতিদিন ৫০০ মেট্রিক টন ধুলা সড়কে জমে এবং ২ হাজার মেট্রিক টন বাতাসে উড়ে।
পৃথিবীর প্রায় ৮৯টি শহর তাদের বায়ুমান ঠিক রাখতে পারছে। পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো প্রায় সব সময় শীর্ষে অবস্থান করছে। শুধুমাত্র ধনী দেশ নয়, মধ্যম আয়ের অনেক দেশও তাদের বায়ুমান ঠিক রাখতে পেরেছে। বাংলাদেশ কি পারছে?
আরও পড়ুন
পৃথিবীর অনেক দেশ যেহেতু বায়ু দূষণ কমাতে পেরেছে তাই বাংলাদেশের পক্ষেও এটি কমানো সম্ভব আর এর জন্য প্রয়োজন আইন, পরিকল্পনা এবং সমন্বিত উদ্যোগ। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও দূষণকে জাতীয় অগ্রাধিকার ঘোষণা করা দরকার।
বায়ু দূষণ মোকাবিলায় বাতাসের গুণগত মানের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত বিষয়গুলো সমন্বিত করে কার্যকর সরকারি নীতিমালার মধ্যে আনতে হবে। পরিবেশ আইন বাস্তবায়নে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা উচিত।
যেকোনো ধরনের দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। বাংলাদেশের দূষণ কমানোর পাশাপাশি আন্তসীমান্ত বায়ু দূষণ বন্ধ করার জন্য আঞ্চলিকভাবেও উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে সব দেশের একমত হতে হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বায়ু দূষণ রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রয়োজন। তার জন্য দুইদেশের সরকার প্রধানদের একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]