ঘরের দুর্নীতি, পরের দুর্নীতি
দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিল বাংলাদেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বৈশ্বিক দুর্নীতির সূচকে টানা তিনবার দুর্নীতিতে একনম্বর হয়ে হ্যাট্রিক করে বাংলাদেশ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে পায় এমন উপাধি!
বিএনপি সরকারের সময়ে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার এই র্যাঙ্কিং নিয়ে আওয়ামী লীগ ১৫ বছরে বিএনপিকে কম কথা বলেনি। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপিদের অনেককেই দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় বিএনপির কড়া সমালোচনা করেছেন। করছেন।
কয়েকবছর ধরে দেখছি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি’র বিভিন্ন প্রতিবেদনকে অস্বীকার করে বক্তব্য দিতে দেখেছি সরকারদলীয় মন্ত্রী এবং দায়িত্বশীল নেতাদের।
আরও পড়ুন
বৈশ্বিক দুর্নীতির সূচক প্রকাশের পরেই কোনো কোনো মন্ত্রী টিআইবির কড়া সমালোচনা করেছেন। সর্বশেষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের যে তালিকা প্রকাশ হয় তাতে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম (৩১ জানুয়ারি ২০২৩)।
এর আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩তম। ২০২১ সালের তুলনায় বাংলাদেশের এক ধাপ অবনমন হয়েছে। অর্থাৎ একবছরের ব্যবধানে দুর্নীতি বেড়েছে। ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি এই সূচক প্রকাশের পরই ক্ষমতাসীনদের অনেকেই এই র্যাঙ্কিং মিথ্যা, কাল্পনিক বলে টিআইবি’র কড়া সমালোচনা করেছেন।
আমার মতে, বৈশ্বিক এই সূচক নিয়ে সমালোচনা অযৌক্তিক। কারণ, দুর্নীতিতে বাংলাদেশ যখন চ্যাম্পিয়নের তালিকায় ছিল তখনকার ক্ষমতাসীন দল বিএনপিও টিআইবি’র এমন কড়া সমালোচনা করেছিল। ওইসময়ে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ আবার এটাকে দারুণভাবে গ্রহণ করেছিল। এখন ঠিক তার বিপরীত।
দুর্নীতিতে বাংলাদেশ যখন চ্যাম্পিয়নের তালিকায় ছিল তখনকার ক্ষমতাসীন দল বিএনপিও টিআইবি’র এমন কড়া সমালোচনা করেছিল। ওইসময়ে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ আবার এটাকে দারুণভাবে গ্রহণ করেছিল। এখন ঠিক তার বিপরীত।
টিআইবি’র অনেক প্রতিবেদন এবং বক্তব্যকে অস্বীকার করছে ক্ষমতাবানদের কেউ কেউ। নিজের বেলায় টিআইবি’র প্রতিবেদন, বক্তব্য না মেনে নেওয়া খুবই অযৌক্তিক।
দুই দশকে দেখছি, দুর্নীতিতে যখন কোনো সরকারি সেবাখাত বা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে টিআইবি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে তখন প্রতিষ্ঠানটির কড়া সমালোচনা করা হয়। দুর্নীতি বন্ধ না করে, দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো টিআইবি বিরোধী বক্তব্য দেওয়া হয়। যেন টিআইবি’ই শক্ত কোনো বিরোধী দল।
যৌক্তিকভাবে টিআইবি’র প্রতিবেদন, গবেষণা কিংবা জরিপকে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানা না হলে তাও মাঠ পর্যায়ে কাজ করে তার চ্যালেঞ্জ নিতে পারে। কথার কথা না বলে কোনটি ভুল তা তুলে ধরা হলে মানুষও বুঝতো টিআইবি’র প্রতিবেদনে ভুল আছে কি না বা টিআইবি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে কি না।
দেশে কি দুর্নীতি নেই? এটা সরকার প্রধানও কখনো অস্বীকার করেননি। দুর্নীতি দেশে আছে এটা স্বীকার করে নিয়ে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছিল। ওইসময়ে সরকার গঠনের পর ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানে প্রভাবশালী কারও কারও বাসায় সিন্দুকভরা টাকা পাওয়া গেছে। দুর্নীতি বিরোধী একটা অভিযান সমাজে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখিয়ে পরে আবার থেমে গেছে।
আরও পড়ুন
সেই সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন, গ্রেপ্তার অভিযান এবং কিছু রাঘব বোয়ালের নামে দুর্নীতির অনুসন্ধান ফাইলও চালু করেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তাদের অনেকেই ক্লিন সার্টিফিকেট পেয়েছেন।
সদ্য শেষ হওয়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ইশতেহারে টাকা পাচার বন্ধ এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অবস্থানের কথা পরিষ্কার করেছেন। মন্ত্রীরাও তাদের নিজ নিজ দপ্তরে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথমদিন সাংবাদিকদের বলেছেন দুর্নীতির লাগাম তারা টানতে চান।
মন্ত্রীদের এমন কথা এর আগে অবশ্য কথার কথায় থেকেছে। এর আগেও দেখেছি, দায়িত্ব নেওয়ার প্রথমদিন প্রায় সব মন্ত্রীই সততার মাধ্যমে দপ্তর পরিচালনা কথা বলেছেন। কিন্তু পরে তাদের দপ্তরে দুর্নীতি থামানোর দৃশ্যমান পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।
সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের কাছে দেওয়া হলফনামায় দেখেছি অনেক মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের সম্পদ বেড়েছে অলৌকিকভাবে! দেশের অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের যখন চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা তখন জনপ্রতিনিধিদের অস্বাভাবিক সম্পদ বাড়ার চিত্র মোটেই স্বাভাবিক নয়! মূল্যস্ফীতি বেড়ে জনগণের যখন নাকাল অবস্থা তখন তাদের প্রতিনিধিদের সম্পদের অলৌকিক উত্থান নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।
সরকার প্রধান দুর্নীতির বিরোধী যে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে, এই মুহূর্তে তা বাস্তবায়নের বড় দায়িত্ব আসে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর। রাষ্ট্র দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা এই প্রতিষ্ঠানটিকে দিয়েছে কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে কি ব্যবস্থা নিয়েছে?
দুদকের দায়িত্বশীলরা প্রায়ই গণমাধ্যমে বলে থাকেন তাদের ওপর কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই। প্রশ্ন আসে রাজনৈতিক চাপ না থাকলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেই কেন? সরকার প্রধানও যখন ঘোষণা দেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের তখন আর বাধা কোথায়?
দুর্নীতিই দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল দুর্নীতিই দেশের জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ খেয়ে ফেলছে। দুর্নীতি না থাকলে প্রবৃদ্ধি আরও বাড়তো।
দুদক যে চাইলেই পারে তাতো আমরা এক যুগ আগে দেখেছি। যেমন প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর অর্থ বিদেশ থেকে দেশে ফেরত আনার দাবি করেছিল সংস্থাটি। কাজেই অর্থ ফেরত আনার দৃষ্টান্ত তো তাদের রয়েছেই। আন্তরিক সদিচ্ছা থাকলে যে সম্ভব তা প্রমাণিত।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ আগের চেয়ে অনেকগুণ বাড়লেও পাচারের টাকা ফেরত আনার কোনো উদ্যোগ নেই। ব্যাংক খাতে, সেবা খাতে দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষ ঠিকমতো সেবা পাচ্ছে না।
আরও পড়ুন
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে এক নম্বর সমস্যা দুর্নীতি। প্রায় ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী উচ্চমাত্রার দুর্নীতির এই সমস্যাকে এক নম্বর হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। শুধু ব্যবসায়ীরা নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও অন্যতম প্রধান সমস্যা দুর্নীতি। দুর্নীতিই দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল দুর্নীতিই দেশের জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ খেয়ে ফেলছে। দুর্নীতি না থাকলে প্রবৃদ্ধি আরও বাড়তো।
এমন অবস্থায় তাহলে করণীয় কী? এর উত্তর, দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। দুর্নীতি যেই করুক তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে, এমন বার্তা সমাজে পৌঁছে দেওয়া। আরও করণীয় হচ্ছে, দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রের অনুকূলে আনতে হবে।
যেসব দেশে টাকা পাচার হয়েছে শোনা যায়, সেইসব দেশ থেকে দুর্নীতিবাজদের কী পরিমাণ সম্পদ আছে তা তুলে ধরা। কাজটি কঠিন কিছু নয়। মানি লন্ডারিংয়ে তদন্তকারী কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, আন্তরিক সদিচ্ছা থাকলে পাচারকারীদের অবৈধ অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে আনা সম্ভব। প্রয়োজন আন্তরিক সদিচ্ছার। এই সদিচ্ছা থাকলে সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি। প্রশ্ন আসে, এই সদিচ্ছা কি দেখাবে?
আদিত্য আরাফাত ।। বিশেষ প্রতিনিধি, ডিবিসি নিউজ