ওস্তাদ রশিদ খান : জীবনমঞ্চ থেকে চিরবিদায়, সুরের মঞ্চে নয়
গ্রিক পুরাণের সুরের দেবতা অর্ফিয়ুসকে উদ্দেশ্য করে শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন—‘অর্ফিয়ুস তার বীণার সুরে বৃক্ষ আর পর্বত শীর্ষসমূহকে জমে যেতে দিয়েছেন / তারা নত হতো যখনই তিনি গাইতেন গান: তার গানের সুরে নত হতো তরু ও পুষ্পসকল / চির প্রস্ফুটিত; যেন সূর্য ও বৃষ্টির ধারাজল / সেখানে সৃষ্টি করেছে এক চিরায়ত বসন্তদিন।’
আমাদের রবীন্দ্রনাথ সুরের বন্দনা করে লিখেছেন—‘তোমার বীণায় গান ছিল / আর আমার ডালায় ফুল ছিল।’ আবার
‘মেঘের ডমরু ঘন বাজে’...লিখেছিলেন বাংলার নজরুল। ‘ডমরু’ বা ‘ডম্বরু’ বাজান প্রলয়ের অধিকর্ত্তা শিব, যিনি পশুপতি, যিনি নটরাজ।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘প্রলয় নাচন নাচলে যখন / জটার বাঁধন পড়লো খসে / হে নটরাজ!’ সহজ কথায় বলতে হলে পৃথিবীর সব দেশে এবং সব জাতিসত্ত্বার পুরাণে গীত-সংগীত-নৃত্যের কল্প অধিদেবতারা সর্বত্রই বন্দিত হয়ে থাকেন।
আরও পড়ুন
সুরের মানুষকে ভালোবাসে না এমন কেউ নেই। ৯ জানুয়ারি ২০২৪, বিকেলে উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের অগণন অনুরাগীদের কাঁদিয়ে অকাল প্রয়াত হলেন মাত্র মধ্য-পঞ্চাশের ওস্তাদ রশিদ খান।
এবার খোলাখুলি বলি। আমি সেইভাবে সংগীত ভুবনের মানুষ নই। আর দশটা বাঙালি ঘরের মেয়ের মতো শৈশবে আমিও খানিকটা গান শিখেছি বা তখন উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিক্ষকদের কাছে রাগ ইমন, ভূপালী, আশাবরী, ভৈরব, দুর্গা, মালকোষ বা দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৭ থেকে আবার কিছুদিন উচ্চাঙ্গ সংগীতে সামান্য তালিম নিয়ে রাগ হংসধ্বনি, ছায়ানট, মেঘমল্লার, শুদ্ধ কল্যাণ, বেহাগ, সোহিনী বা বৃন্দাবনী সারং টুকটাক শিখলেও আমি যে ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের খুব নিয়মিত শ্রোতা এমন দাবি করব না।
কাজেই ওস্তাদ রশিদ খানের নাম জানলেও বা কখনো শুনলেও তাকে নিয়মিত ইউটিউবে অনুসরণ করেছি বা শুনেছি এমনটা দাবি করা অমূলক হবে।
জীবনের নানা জটিলতা বা ব্যস্ততার ভেতর গান যেটুকু শুনি, তার বেশিরভাগ সময় নিখাঁদ বাংলা ভাষায় লিখিত ও সুরারোপিত রবীন্দ্র সংগীত বা কখনো কখনো বাংলা সুরের পঞ্চ ভাস্করের অন্য চার ভাস্কর বা নজরুল-অতুল প্রসাদ-রজনীকান্ত-দ্বিজেন্দ্রলালই বেশি শোনা হয়। হালের জীবনমুখী গানও কিছু শোনা হয়। কাজেই রশিদ খানকে নিয়ে লেখার যোগ্যতা কি আমার আদৌ আছে?
ভারতের উত্তর প্রদেশের বাদায়ুনে ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই জন্ম এই সংগীতশিল্পীর। মামা ওস্তাদ নিসার হুসেইন খানের (১৯০৯-১৯৯৩) কাছে তার প্রথম হাতেখড়ি।
মামা নিসার হুসেইনের শিক্ষাদানের পদ্ধতিটা এবার বলি। প্রতিদিন ভোর চারটায় উঠে ভাগ্নে রশিদকে একটি মাত্র স্বরের ওপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা জুড়ে অনুশীলন করতে হতো। কখনো কখনো গোটা দিন একটি মাত্র স্বর সাধনায় চলে যেত।
নিসার হুসেইন খান কী কঠোর শিক্ষা দিতেন বালক রশিদকে তা পড়ে চমকে গেলাম। তবে একইসাথে বুঝলাম কী করে রাগ আহীর ভৈরবে ‘আলবেলা সাজন আয়ো রে’ বা রাগ শ্যাম কল্যাণে ‘পায়েল মোরা বাজে’-র অমন ওজস্বী কণ্ঠস্বর তৈরি হয় যা একইসাথে এত কোমল ও কাব্যিক!
আরও পড়ুন
মামা নিসার হুসেইনের শিক্ষাদানের পদ্ধতিটা এবার বলি। প্রতিদিন ভোর চারটায় উঠে ভাগ্নে রশিদকে একটি মাত্র স্বরের ওপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা জুড়ে অনুশীলন করতে হতো। কখনো কখনো গোটা দিন একটি মাত্র স্বর সাধনায় চলে যেত।
যদিও বালক রশিদের এমন অনুশীলন সবসময় ভালো লাগতো না, তবে এই কঠোর অনুশীলনই কি তাকে পরবর্তী জীবনে তাল ও লয়কারীতে এত অনায়াস দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করেনি?
রাগ ঝিঁঝিটে করা তার তারানা বলুন অথবা রাগ মরু বেহাগে তার ‘পিয়া নাহি ঘর’...শৈশবের কঠোর অনুশীলনই এমন কণ্ঠস্বর অর্জনে তাকে সাহায্য করেছে নিশ্চিত।
১৯৮০-র দশকের শুরুতে কলকাতার আইটিসি সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে এক তরুণ ছাত্র হিসেবে পণ্ডিত ভীমসেন জোশীর গান শুনতে বিখ্যাত ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে তাকে যখন উইংসের পাশ থেকে সরিয়ে পেছনে যেতে বলা হয়, তখন আহত বোধ করলেও জেদও চাপে এই শাস্ত্রীয় সংগীত আরও ভালোভাবে ‘আয়ত্ত’ করার জন্য। ফলে সংগীত সাধনায় পরিশ্রম বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
তবে পূর্বসূরিদের মতো পান চিবোতে চিবোতে খেয়াল আর ঠুমরির লয়কারীতেই নিজেকে আটকে রাখেননি রশিদ। ‘জব ইউ মিট’ সিনেমায় ‘আওগে জব’ গাওয়া থেকে রবীন্দ্র সংগীতে ‘রাখো রাখো হে’ তিনি যখন করেন খানিকটা বেশি রাগাশ্রয়ী ভঙ্গিতে, তখন মুগ্ধ না হয়ে উপায় কী?
রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার এই শিল্পী তার ‘বৈঠকী রবি’-র গানগুলোয়, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর সাথে ‘মহারাজ এ কি সাজে’ থেকে কৌশিকী চক্রবর্তীর সাথে ঠুমরির যুগলবন্দীতে বারবার নিজেকে ভেঙেছেন ও নতুন করে গড়েছেন।
‘রাখো রাখো হে’ গানটি রশিদ খানের গলায় শোনার পর বুঝলাম কেন ধ্রুপদি সংগীতের শিল্পী অন্য সব গানেও অনায়াসে হরধনু ভঙ্গ করার শক্তি রাখেন! রাগ পুরিয়া ধানেশ্রীতে ‘পায়েলিয়া ঝঙ্কার’ থেকে গায়ক হরিহরণের সাথে ঠুমরিতে ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’...যেন এই ভারতবর্ষের ষোড়শ মহাজনপদের সব মেঘদূতম, সব রাগ দীপক...আগুন ও ধারাজল...সবকিছুই তার কণ্ঠে অবিশ্বাস্য মান্যতা পায়!
রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার এই শিল্পী তার ‘বৈঠকী রবি’-র গানগুলোয়, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর সাথে ‘মহারাজ এ কি সাজে’ থেকে কৌশিকী চক্রবর্তীর সাথে ঠুমরির যুগলবন্দীতে বারবার নিজেকে ভেঙেছেন ও নতুন করে গড়েছেন।
আরও পড়ুন
২০০৬ সালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে সংগীতের জন্য ‘পদ্মশ্রী’ পাওয়া এই শিল্পী ওস্তাদ আমির খসরুর সুফি সংগীতকে হিন্দুস্থানি সংগীতের সাথে মিশ্রণের চেষ্টা করেছেন তার ‘ন্যায়না পিয়া সে’-র মতো গানে। এই সুফি গানটি অবশ্য আমির খসরুরই রচনা।
তবে অকাল প্রয়াত সংগীত সাধকের যেটুকু গান লেখার সুবাদে আরও খানিকটা শোনা হলো, তা তাকে সামনে আরও শোনার স্পৃহাই বাড়িয়ে দিল। প্রতিদিনের ইঁদুর দৌড় বা নানা নিষ্ঠুরতার নিদান যে মিলতে পারে ধ্রুপদি সংগীতেই সেইটাও নতুন করে বোঝা হলো।
তবে এত অল্প বয়সে প্রস্টেট ক্যান্সারে এমন কালজয়ী শিল্পীর মৃত্যু আমাদের দুঃখই বাড়িয়ে দেয়। শেষ করি রবীন্দ্রনাথের কথাতেই—‘তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে / দেবে কি গো বাসা আমায় একটি ধারে?’
অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক