অপতথ্য, ডিপফেক যুগে নির্বাচনী সাংবাদিকতা
সুদর্শন, সদালাপী ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ (Emmanuel Macron) এ্যালিসি প্রাসাদে প্রবেশ করেছিলেন ২০১৬ সালে। আঠারো শতকে নির্মিত প্যারিসের এই প্রাসাদ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের দাপ্তরিক বাসভবন। ফ্রাঁসোয়ো ওলাদকে পরাজিত করে ফ্রান্সের ২৫-তম রাষ্ট্রপতি হতে ম্যাক্রোঁকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। মোকাবিলা করতে হয়েছিল শক্তিশালী সব প্রতিপক্ষ।
নির্বাচনের সময় ম্যাক্রোঁকে মোটামুটি ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল তার বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া অপতথ্য। যেমন—নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে বেলজিয়ামের একটি জনপ্রিয় সংবাদপত্র লা-সোয়ের’ এর (Le Soir) একটি নকল ভার্সন বাজারে ছাড়া হয়। যার প্রধান সংবাদ ছিল ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর নির্বাচনী প্রচারণায় তহবিল জুগিয়েছে সৌদি-আরব।
এছাড়া ট্যাক্স-হেভেন বলে পরিচিত বাহামায় অফ-শোর ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রচুর অর্থ লেনদেন করেছেন ম্যাক্রোঁ। একইসাথে রাষ্ট্রপতি পদের পদপ্রার্থী ম্যাক্রোঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল কুৎসিতসব অপতথ্য (Disinformation)। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ইয়ানুয়েল ম্যাক্রোঁর সাথে তার স্ত্রী ব্রিজিত তোনিয়োর বয়সের পার্থক্য ২৫ বছর।
আরও পড়ুন
ব্রিজিত তোনিয়ো ম্যাক্রোঁর স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। এই সম্পর্ক নিয়েও ছিল নানা রকম মুখরোচক সংবাদ, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল অনলাইন পরিসরে সক্রিয় ভোটারদের প্রভাবিত করে ভোটের ফল পাল্টে দেওয়া।
এখানে একটা কথা যুক্ত করা যেতে পারে, বর্তমান যুগে ভোটের ফল নিজের পক্ষে আনতে কাউকে আর ভোটকেন্দ্র দখল করতে হয় না, দখলে নিতে হয় ভোটারের মনোজগৎ। আর এই মনের দখল নেওয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো সংবাদ।
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। নির্বাচনকেন্দ্রিক সাইবার পরিসরে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়া বা শেয়ার করা ভুয়া খবর কোনটি? এই সংবাদটি হলো ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্টে নির্বাচন নিয়ে। ঐ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যঙ্গাত্মক ও কাল্পনিক গল্পগাঁথার হাস্যরসাত্মক মাধ্যম ডব্লিইটিওই:ফাইভ (WTO5) ‘Pope Francis shocks world, endorses Donald Trump for president’ শিরোনামের একটি সংবাদ প্রকাশ করে।
বর্তমান যুগে ভোটের ফল নিজের পক্ষে আনতে কাউকে আর ভোটকেন্দ্র দখল করতে হয় না, দখলে নিতে হয় ভোটারের মনোজগৎ....
এরপর আগুনের বেগে তা ছড়িয়ে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারাবিশ্বে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ভোটে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অসংখ্য মার্কিনিদের প্রভাবিত করেছে এই ভুয়া সংবাদটি।
২০১৬ পার হয়েছে এখন আমাদের সামনে ২০২৪, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন। বর্তমানে অপতথ্যের ভিত্তিতে তৈরি ভুয়া খবর বা ফেকনিউজ সম্পর্কে মোটামুটি সবাই অবগত।
এবার একটু আলাপ করা যাক ডিপফেক নিয়ে। যা এরইমধ্যে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আমাদের সামনে চলে এসেছে।
ডিপফেক (Deepfake)
ডিপফেক মূলত এক ধরনের ভুয়া ভিডিও। সাধারণত এআই (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার করে এই ধরনের ভুয়া ভিডিও তৈরি করা হয়। মূলত ভুয়া পর্ণগ্রাফিতে এই প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান ডিপট্রেস অনলাইনে ১৫০০০ হাজার ভিডিও নিরীক্ষা করে দেখতে পায় এই ভিডিওগুলোর ৯৬ শতাংশের আধেয় ডিপফেক ভিডিও। যেখানে নীলছবির কোনো নায়িকার মুখচ্ছবি ব্যবহার করে নতুন ভুয়া নীলছবি তৈরি করা হয়েছে। অনেক গবেষক আবার এই ধরনের ভিডিওকে বলে থাকেন রিভেঞ্জ পর্ণ অর্থাৎ প্রতিশোধমূলক নকল নীল ছবি।
ডিপফেক শুধু নীলছবির জগতেই নয়, প্রভাব বিস্তার করছে বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়। আমাদের সবারই জানা, নির্বাচনী মাঠের বড় লক্ষ্য থাকে নিজের পক্ষে প্রচারণার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ ঘায়েল করা। সোজা কথায়, প্রতিপক্ষ নিন্দিত করা, অন্যের কাছে অযোগ্য, অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিত্রিত করা।
ধরা যাক, মন্টু ও ঝন্টু দুইজন কাল্পনিকভাবে জাতীয় নির্বাচনে পদপ্রার্থী। তাদের প্রায় সমান সংখ্যক ভোটার রয়েছে। নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা। এমন সময় ভোটের দুই দিন আগে মন্টুর একটি ভুয়া ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ল। যাতে তিনি গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণের প্রতি সমর্থন দিচ্ছেন। গুণগান গাচ্ছেন ইহুদি সেনাদের। এই বর্বর গণহত্যায় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের ভূমিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বাংলাদেশে মুসলিম মনোভাব খুবই প্রবল ও তীব্র। তাই, এই ডিপফেক ভুয়া ভিডিও মুহূর্তেই মন্টুর সব পরিশ্রম নস্যাৎ করে দিতে পারে। পরাজয়ের কারণ হতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছে।
জাতীয় নির্বাচন একটা দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়। নির্বাচনে জনগণের রায়ের ওপরই নির্ভর করে দেশটির আগামী দিনের নীতি, আদর্শ, পরিকল্পনা, এমনকি অর্থনৈতিক অগ্রগতির নানা বিষয়। যে কারণে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাকাঙ্খী রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে থাকে।
আরও পড়ুন
এক সময় নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারে, ভোটকেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা হতো। এরপর আসে গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা। আর এখন যে যুগে আমরা বসবাস করছি, সেইখানে রাজনৈতিক দলগুলোর চেষ্টা এখন যেকোনো মূল্যে ভোটারের মগজ বা ভাবনার জগৎ দখল নেওয়া।
আর যেহেতু নির্বাচন একটি রাজনৈতিক দলের জন্য যুদ্ধ সমতুল্য, তাই ভোটারের চিন্তা চেতনার দখলের বিষয়ে কেউ আর নীতি-নৈতিকতার কথা ভাবছেন না। ফলে শুরু হয়েছে এক মরিয়া মারামারি, অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
পুনঃনিরীক্ষা, পুনঃনিরীক্ষা এবং পুনঃনিরীক্ষা
২০২৩ সালে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আধেয় (ইউজিসি: ব্যবহারকারী তৈরির করা স্বাধীন আধেয়) ও নিউজ আউটলেটের নিউজ আধেয়ের মধ্যে পার্থক্য করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনটা যে সংবাদ আর কোনটা কারও ব্যক্তিগত মতামত তা আলাদা করা সত্যিই কঠিন।
জাতীয় নির্বাচন একটা দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়। নির্বাচনে জনগণের রায়ের ওপরই নির্ভর করে দেশটির আগামী দিনের নীতি, আদর্শ, পরিকল্পনা, এমনকি অর্থনৈতিক অগ্রগতির নানা বিষয়।
এমন বাস্তবতায় নির্বাচনকালীন সাংবাদিকতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রতিবেদক বা সংবাদমাধ্যমের কাছে আসা তথ্য বারবার পুনঃনিরীক্ষা করা। আমি বলব, এই নিরীক্ষণ অন্তত তিনবার করতে হবে। আর সবসময়ই মাথায় রাখা প্রয়োজন প্রতিপক্ষ প্রার্থী ঘায়েল করতে কোনো পক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে নেতিবাচক তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে।
ছবি, ভিডিও, গ্রাফিক্স অনলাইনে যাচাই করা
একটা বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। তথ্য শুধু অক্ষর বা লেখা নয়—ছবি, ভিডিও, অডিও, গ্রাফিক্সও তথ্য। আর তাই নির্বাচনের সময়ে সাংবাদিকের কাছে যেকোনো মাধ্যমে আসা ছবি, ভিডিও, অডিও, গ্রাফিক্সও যথাযথভাবে যাচাই করা প্রয়োজন। আর অনলাইনে এই বিষয়গুলো যাচাই করার জন্য এখন অনেক মাধ্যম রয়েছে। যেখানে নির্দিষ্ট কমান্ড দিলেই যাবতীয় তথ্য আসবে।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক—বর্তমান সময়ে সংবাদের বড় একটি মাধ্যম হলো ছবি। একটি ছবিকে প্রয়োজন অনুযায়ী নানাভাবে এডিট করা যেতে পারে। আর চাইলেই, ছবিটির পুরো বৃত্তান্ত বের করে আনা সম্ভব। যেমন; TinEye Reverse Image Search নামের ওয়েবসাইটে ঢুকে যেকোনো ছবি যাচাই করা যেতে পারে। এই রকম ভিডিও যাচাইকরণে অনেক মাধ্যম আছে তা একজন প্রতিবেদককে ব্যবহার করতে হবে।
লেখাটি শেষ করতে চাই শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়কে দিয়ে। বাংলা সাহিত্যের অমর এই কথাশিল্পীর গুরুত্বপূর্ণ একটি সাহিত্য কর্ম পল্লীসমাজ। এই উপন্যাসে রমেশ নামক একটি চরিত্রের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা কতটা জটিল ও কুটিল। নির্বাচন দিতে আমাদের সমাজ যে আরও জটিল-কুটিল সেই বিষয়টি বলাই বাহুল্য। তাই নির্বাচনের দিনে একজন সাংবাদিকের আরও বেশি সতর্কতা প্রয়োজন।
রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]