৭ জানুয়ারির নির্বাচন কেমন হবে?
অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে, একটা নির্বাচন নির্বাচন খেলা ৭ জানুয়ারি ২০২৪ হয়েই যাবে। অন্যভাবে বললে, খেলাটা শুরু হয়ে গেছে, চূড়ান্ত তামাশাটা হবে জানুয়ারির সাত তারিখ। দুটি আসন বাদ রেখে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ওদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করে ফলেছে।
জোটের শরিকদের কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার জন্য সম্ভবত কয়েকটা আসনে পরিবর্তন আসবে। ধরে নেওয়া যায় যে আওয়ামী লীগ তাদেরই মনোনয়ন দিয়েছে যারা অনায়াসে জিতে আসবে। নির্বাচনে তো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, ওরা জিতবে না তো কে জিতবে।
আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তাদের মধ্যে একটু শক্তি যাদের আছে ওরা হচ্ছে জাতীয় পার্টি। এরশাদের জীবদ্দশায় যতটুকু শক্তি জাতীয় পার্টির ছিল তা এখন আর নেই। এই দলটি একাদশ সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দল ছিল। কিন্তু কার্যত এরা আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রিত একটি পার্টি। তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য ওরা দ্বারস্থ হয় সরকারী দল আওয়ামী লীগের।
রংপুর-৩ আসনটি জাতীয় পার্টির সবচেয়ে সুরক্ষিত আসন আর তাই আসনটি দুইজনের কেউই ছাড়তে চায়নি। স্বাভাবিক প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি কয়টা আসন পাবে তা সকলেই অনুমান করতে পারেন।
এখন জি এম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে তা নিরসনে মধ্যস্থতা করার জন্য সরকারের লোকজন কাজ করছে বলে খবরে এসেছে। নিজেদের শক্তিতে নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে ওদের আস্থা যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তা বোঝা যায় রংপুর-৩ আসনের মনোনয়ন নিয়ে জিএম কাদের ও এরশাদের পুত্রের মধ্যে টানা হেঁচড়া নিয়ে।
রংপুর-৩ আসনটি জাতীয় পার্টির সবচেয়ে সুরক্ষিত আসন আর তাই আসনটি দুইজনের কেউই ছাড়তে চায়নি। স্বাভাবিক প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি কয়টা আসন পাবে তা সকলেই অনুমান করতে পারেন।
জাতীয় পার্টি ছাড়া সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে তৃণমূল বিএনপির। দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দলটি। নাজমুল হুদার জীবদ্দশাতেই দলটি অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল, তার মৃত্যুর পর দলটির অস্তিত্বও বিলীন হওয়ার মতো অবস্থা দাঁড়িয়েছিল।
আরও পড়ুন
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে আগে শমশের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকার দলটির দায়িত্ব গ্রহণ করে দলে প্রাণ সঞ্চার করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তোড়জোড় শুরু করেন। ২৩০টি আসনে মনোনয়ন ঘোষণা করেছেন কিন্তু ভোটের ক্ষেত্রে কয়েকজন প্রার্থীর ব্যক্তিগত প্রভাব ছাড়া ভোটের বাজারে ন্যূনতম প্রভাবও ওরা ফেলতে পারবে কি না তা নিয়ে যুক্তিসঙ্গত সংশয় রয়ে গেছে।
জাতীয় পার্টি ও তৃনমূল বিএনপি ছাড়া আরও একদল ছোট ছোট রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া শুরু করেছে বটে, কিন্তু তা যে নিতান্ত তামাশা সেই কথা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। নিতান্ত যদি সরকারি দল সংসদকে রঙিন করার জন্য এদের মধ্য থেকে দুই একজনকে নানা কায়দায় পাস করিয়ে আনে তাহলে এরা কেউই কোনো আসনে জয় তো দূরের কোথা, উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ভোটও পাবেন না।
আর নির্বাচন যেন ২০১৪ সালের মতো নিতান্ত তামাশায় পরিণত না হয় সেই লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান বলে দিয়েছেন, প্রতিটা আসনে যেন একজন করে ডামি প্রার্থী থাকে। আর সেইসাথে এটাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, দলের মনোনয়ন বঞ্চিতরা কেউ চাইলে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যেতে পারেন, দল ওদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না। তাহলে চিত্রটা কী দাঁড়াবে?
দেখা যাবে, তিনশটা আসনেই আওয়ামী লীগ এবং ওদের জোটের প্রার্থীরা হবে মূল প্রার্থী, দশটা বা বারোটা আসনে হয়তো জাতীয় পার্টি হবে ওদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। ওদের সাথে থাকবে আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আর নির্বাচনে প্রায় সব আসনেই হয়তো আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই জিতে আসবে—অল্প কয়েকটা আসনে জাতীয় পার্টি হয়তো জিতবে, অন্যরা যারা আওয়ামী লীগের আনুকূল্য পাবে কেবল ওরাই জিতবে।
আরও পড়ুন
এই যে অবস্থা, এর ফলাফল হচ্ছে যে, প্রথমত, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া মানেই কার্যত সংসদ সদস্য হয়ে যাওয়ার সমর্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে; আর দ্বিতীয়ত, যেহেতু জনগণের হাতে কোনো কার্যকর বিকল্প থাকছে না, মানুষ বাধ্য হয়েই আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে হবে। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত বা পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি আর বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন থাকছে না। এমনকি দলের মধ্যে কার কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তা বিবেচনারও কোনো প্রয়োজন নেই। প্রতিদ্বন্দ্বীই তো নেই, সুতরাং ভয়ের তো কারণ নেই। যাকে ইচ্ছে তাকে মনোনয়ন দিলেই হয়ে যায়।
এই রকম নির্বাচন যদি হয়, তাহলে দেশ থেকে কার্যকর গণতন্ত্র তো উঠে যাবেই, দলের অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের আর কোনো বালাই থাকবে না—একজন ব্যক্তির হাতে চলে যাবে দলের ভাগ্য, দেশের ভাগ্য আর জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের সর্বময় ক্ষমতা।
এই নির্বাচনে যারা জিতে আসবে, মনোনয়ন থেকে শুরু করে নির্বাচনে জিতে আসা পর্যন্ত ওরা তো জনগণের মতামতের চেয়ে একজন ব্যক্তির পছন্দের ওপরই বেশি নির্ভরশীল ছিল। ফলে ওদের আনুগত্যের কেন্দ্রবিন্দুও হবে একজন ব্যক্তি মাত্র। এইসব এমপিরা আর জনগণের স্বার্থে সরকারের নির্বাহী বিভাগের কোনো কাজের বিরুদ্ধে কোনোদিন সংসদে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না।
এইরকম অভিজ্ঞতা তো আমাদের আগেও হয়েছে। পাঁচ বছরে দেশে গুম এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার হাতে বিনা বিচারে মানুষ হত্যা এইরকম ঘটনা নিয়ে কোনোদিন কোনো কার্যকর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে? কোনো আলোচনা হয়েছে? হয়নি।
নির্বাচনে বিএনপি আসছে না, নির্বাচনের পরিবর্তে ওরা একটা ফলহীন অর্থহীন আন্দোলন করছে এইসব কথা আপনি বলতে পারেন। কথাগুলো একদম হয়তো ভুলও হবে না....
এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে যারা বিরোধী দল, ওরাও তো কার্যত সরকারি দলের অনুমোদিত বিরোধী দল মাত্র। তাহলে গণতন্ত্রের মূল যে লক্ষ্য, দেশের সব নীতি নির্ধারণমূলক সিদ্ধান্ত, সব নির্বাহী সিদ্ধান্ত তাতে জনগণের প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ, সেই কাজটাই তো হবে না।
সংসদ পরিণত হবে কেবল তিনশ তিরিশজন সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষের একটি বৈঠকখানা অথবা সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন একজন সরকার প্রধানের দরবার।
আরও পড়ুন
এইজন্য রাজনীতিতে দেশের যারা মূল বিরোধীদল তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ জরুরি ছিল। আমি বিএনপিকে পছন্দ করি না, কিন্তু একথা তো অস্বীকার করতে পারি না যে ওরাই হচ্ছে দেশের দুইটি বড় রাজনৈতিক দলের একটা। ওরা যদি নির্বাচনে না আসে সেই নির্বাচন কার্যত ক্ষমতা নবায়নের একটি আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়ে যায়, যা আর নির্বাচন থাকে না।
নির্বাচনে বিএনপি আসছে না, নির্বাচনের পরিবর্তে ওরা একটা ফলহীন অর্থহীন আন্দোলন করছে এইসব কথা আপনি বলতে পারেন। কথাগুলো একদম হয়তো ভুলও হবে না। কিন্তু সরকারি দল কি ওদের নির্বাচনে নিয়ে আসতে বিশেষ কোনো উদ্যোগ আয়োজন করেছিল? সংলাপ আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে বিএনপি সাড়া দেয়নি।
আর এখন তো এমন অবস্থা হয়েছে, বিএনপির শীর্ষ নেতাসহ ষোল-সতের হাজার বিএনপির নেতাকর্মী কারাগারে, অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিন ঝাঁকে ঝাঁকে বিএনপি নেতাকর্মীদের কোনো না কোনো মামলায় সাজা দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি তো এখন চাইলেও আর নির্বাচনে আসতে পারবে না। পারবে?
আনুষ্ঠানিক একটা নির্বাচন হয়তো জানুয়ারির সাত তারিখে হয়ে যাবে, আওয়ামী লীগ জিতে যাবে কিন্তু হেরে যাবে গণতন্ত্র। আইনত নির্বাচন একটা হবে বটে, কিন্তু কার্যত কোনো নির্বাচন আর হচ্ছে না।
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট