ডেঙ্গু চিকিৎসায় মানুষের নিঃস্ব হওয়া ও প্রতিরোধ ব্যর্থতা
বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ চিকিৎসার ব্যয়ভার মেটাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। ২০২১ সালে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা অনুযায়ী 'চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে প্রতিবছর নতুন করে ৮৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্যতার শিকার হচ্ছেন'। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যা আরও বেশি।
করোনা মহামারির কারণে দেশে 'করোনা দারিদ্র্য' বেড়েছে। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু মহামারির শিকার হয়ে চিকিৎসার খরচ বহন করতে গিয়ে নতুন করে আবারও বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে চলে গিয়েছে এবং এই ধারা এখনো চলমান। ডেঙ্গু সংক্রমণ যেমন প্রতিরোধযোগ্য তেমনি ডেঙ্গুর চিকিৎসাজনিত নিঃস্ব হওয়া প্রতিরোধযোগ্য।
২০০০ সাল থেকে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। সেই থেকে প্রতিবছর বিপুল মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। অনেকে মৃত্যুবরণ করেন।
আরও পড়ুন
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এডিস মশা এই ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ডেঙ্গুর ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রথম শর্ত হলো 'এডিস মশা নির্মূল করা'।
২০২৩ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আক্রান্ত, হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা বলতে সেই সংখ্যাকে বোঝানো হয় যে সংখ্যাটি দেশের স্বাস্থ্য বিভাগে রিপোর্ট করা হয়ে থাকে।
প্রতিদিন স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন আকারে ডেঙ্গুর তথ্য দেশবাসীকে জানানো হয়। নতুন শনাক্ত এবং হাসপাতালে নতুন ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দেশের সবগুলো হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে স্বাস্থ্য বিভাগে রিপোর্ট করা হয় না। তাই সত্যিকারের সংখ্যা রিপোর্টকৃত সংখ্যার কয়েকগুণ হবে বলে সঙ্গত কারণেই ধারণা করা হয়।
ডেঙ্গু একটি প্রতিরোধযোগ্য সংক্রামক ব্যাধি। তাই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে একজন মানুষের মৃত্যুও অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রতিরোধযোগ্য প্রতিটি মৃত্যুই আমাদের ব্যর্থতার স্মারক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা হচ্ছে ১৫৭৭ জন, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ লাখ ৫ হাজার ২৬৮ জন মানুষ। অথচ ২০০০ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা হলো মোট ৮৬৮ জন।
ডেঙ্গু একটি প্রতিরোধযোগ্য সংক্রামক ব্যাধি। তাই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে একজন মানুষের মৃত্যুও অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রতিরোধযোগ্য প্রতিটি মৃত্যুই আমাদের ব্যর্থতার স্মারক। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নির্মূল করা হলে মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হবে না। ফলে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর কোনো ঘটনা ঘটবে না।
আরও পড়ুন
ডেঙ্গু প্রতিরোধের দুটি অংশ। প্রথম ও প্রধান অংশ হচ্ছে এডিস মশা নির্মূল করা। এই কাজের দায়িত্ব হলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ এই দায়িত্ব পালন করে থাকে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব হচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা করা হয়।
ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় কেমন ব্যয় হয়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনিস্টিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে পরিচালিত ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে একটি গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
ঢাকার সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুর চিকিৎসায় প্রত্যেক রোগীকে গড়ে ২৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। ঢাকার বাইরে এই খরচের পরিমাণ ১০ হাজার টাকা। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের শেষ নাগাদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীপ্রতি খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ঢাকার সরকারি হাসপাতালে ভর্তি একজন রোগীর গড় খরচ হয়েছে মোট (জনপ্রতি অর্থ ৫০,০০০ + ব্যক্তিগত অর্থ ২৫,০০০) ৭৫ হাজার টাকা।
ঢাকার বাইরে খরচ হয়েছে মোট (৫০ হাজার + ১০ হাজার) ৬০ হাজার টাকা। একই গবেষণায় দেখা গিয়েছে ঢাকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীপ্রতি খরচ হয়েছে ৫০ হাজারের কিছু বেশি। এই হিসাবে চমকে ওঠার মতো তথ্য হলো দেশের সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা খরচ বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেশি। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টির কারণ উদঘাটনের জন্য গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
ডেঙ্গু সংক্রমণের দুই যুগ অতিক্রান্ত হচ্ছে। অথচ এখন পর্যন্ত এডিস মশা নির্মূলে একটি জাতীয় সমন্বিত নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়নি।
২০০০ - ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারা দেশে মশা মারার জন্য মোট কত টাকা খরচ করা হয়েছে তা দেশবাসীর অজানা। ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশন ডেঙ্গু প্রতিরোধে এবং মশক নিধনে বিগত দুই যুগে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তা জানার পূর্ণ অধিকার নগরবাসী ও দেশবাসীর রয়েছে।
২০২৩ সাল শেষ হওয়ার আগেই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বে প্রথম স্থানের অধিকারী হতে পেরেছি। বেদনাবহ এই মৃত্যুর সাথে লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যহানি ও বিপুল সম্পদহানির হিসাব কখনোই করা হয় না। ডেঙ্গুর কারণে এখন পর্যন্ত জাতির কত শত কোটি শ্রমঘন্টা বিনষ্ট হয়েছে তার হিসাব কে করবে!
আরও পড়ুন
ডেঙ্গু সংক্রমণের দুই যুগ অতিক্রান্ত হচ্ছে। অথচ এখন পর্যন্ত এডিস মশা নির্মূলে একটি জাতীয় সমন্বিত নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়নি। এই জাতীয় কার্যক্রমের সাথে জনসাধারণ যুক্ত করা অপরিহার্য। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরীক্ষিত কৌশল। তাও গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের মতো দেশে মশা নির্মূলের জন্য রাসায়নিক ও পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণকে যুগপৎভাবে প্রয়োগ করা উচিত। এবিষয়টিকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
অবশ্য ডেঙ্গু প্রতিরোধে,এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক বক্তৃতাবাজি, শোভাযাত্রা ,সাধারণ মানুষকে দোষারোপ, প্রদর্শনবাদী কাজ কারবার অনেক অনেক হয়েছে। অনেক জীবনহানি, অনেক মানুষের নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, বিপুল ভোগান্তির, জনগণের অর্থের বিস্তর অপচয় হয়েছে। এবার অন্তত কাজের কাজটা হোক অর্থাৎ মশা মারার কাজটি সম্পন্ন হোক, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসুক এবং জীবনহানি,সম্পদহানি বন্ধ হোক।
ডা. লেলিন চৌধুরী ।। চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ