সরল অঙ্ক ভালোই কষেছিল, শুধু উত্তরটা ভুল লিখল!
‘যো ডার গ্যায়া, সমঝো মার গ্যায়া!’
‘শোলে (১৯৭৫)’-তে গাব্বার সিংয়ের বিখ্যাত ডায়ালগ এটা। সেই ভয়ে ডুবেই যে ফাইনালে হারল ভারত। পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে টানা দশ ম্যাচে দাপুটে ব্যাটিং দেখানো দল ফাইনালে এসে খেলল নরম ও ভয় পাওয়া ক্রিকেট!
ফাইনালের উইকেটে ওভার প্রতি পাঁচের ওপর রান জমা করা যাবে না—এমন কোনো মাইনফিল্ডও হয়ে পড়েনি আহমেদাবাদের ২২ গজে। অস্ট্রেলিয়ার রিভার্সসুইং, শর্টপিচ প্রেসক্রিপশন, চমকপ্রদ ফিল্ডিং, ড্রাই উইকেট—এসব অনুষঙ্গের উপস্থিতি ফাইনালে ছিল।
ভারত এই বিষয়গুলো মগজে একটু বেশিই নিয়ে ফেলে। আর অতিমাত্রায় সতর্কও ছিল। কিন্তু অতি সতর্কতায় শামুকের মতো গুটিয়ে গেলে কখনোই সূর্যোদয় দেখা হবে না।
আরও পড়ুন
প্রথম ১০ ওভার তো ভালোই শুরু করে ভারত। ১ উইকেট হারালেও স্কোরবোর্ডে ১০ ওভারের মধ্যেই জমা ৮২ রান! ভালো স্কোরের ভিত্তি পেলেও উইকেট বাঁচাতে গিয়ে বাকি সময়ের ব্যাটিং যে চুপসে যাওয়া বেলুন।
মানছি বাকি ৪০ ওভার অস্ট্রেলিয়া ভালো বোলিং করেছে। ফিল্ডিং দুর্দান্ত হয়েছে। কিন্তু তাই বলে পরের প্রতি ১০ ওভারের ধাপে ভারত কেন এত নুইয়ে পড়া ব্যাটিং করবে?
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের নিয়মটাই হলো প্রতিপক্ষ যখনই চাপে পড়বে তখনই চাপ আরও বাড়াতে হবে, যাতে প্রতিপক্ষ ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়।
অ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স—এই দীক্ষার শিক্ষা ছড়িয়েই তো ভারত বিশ্বকাপের শুরুর ১০ ম্যাচে ছড়ি ঘুরিয়েছিল। কিন্তু ফাইনালে এসে নিজের স্টাইল থেকেই সরে আসে তারা।
ফাইনালে ডোবার শুরু ওতেই!
একটা বর্ণনা শুনুন।
১ থেকে ১০ ওভার, ৮২/১। ১১ থেকে ২০ ওভার, ৩৫/১। ২১ থেকে ৩০ ওভার, ৩৭/১। ৩১ থেকে ৪০ ওভার, ৪৫/১। ৪১ থেকে ৫০ ওভার, ৪৩/৫।
শুকনো, মন্থর উইকেট। বল একটু দেরিতে ব্যাটে আসছে। স্পিন ধরবে। অস্ট্রেলিয়া টসে জিতেও আগে বোলিং নিয়েছে। এমন সব চিন্তায় ভারত তাদের চিরায়িত আক্রমণাত্মক ব্যাটিং থেকে সরে আসে।
না হয় ৬৬ রানের ইনিংসের জন্য কেন কেএল রাহুলকে ১০৭ বল খেলতে হবে? যে উইকেটে শুরুর চার ওভারে রান উঠেছে ৩০। প্রথম ১০ ওভারে ৮২। যেখানে রোহিত ফাটিয়ে খেলে ৩১ বলে করলেন ৪৭।
আরও পড়ুন
সেই একই উইকেট ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নিশ্চয়ই পুরোদস্তুর চরিত্র বদলে ফেলবে না। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের নিয়মটাই হলো প্রতিপক্ষ যখনই চাপে পড়বে তখনই চাপ আরও বাড়াতে হবে, যাতে প্রতিপক্ষ ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়।
ফাইনালে সেই অতি চেনা অস্ট্রেলিয়ান কৌশলেরই দেখা মিলল। আর ভারত অতিরিক্ত পরিমাণ সর্তকতা তথা ডিফেন্স আঁটোসাঁটো করতে গিয়ে আক্রমণ করাই যে ভুলে গেল!
শেষের ১০ ওভারের জন্য আক্রমণের সময় ঠিক করেছিল ভারত। কিন্তু ততক্ষণে যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিশ্বকাপের আগের ম্যাচগুলোয় ভারতের ব্যাটিংয়ের শরীর ছিল হারকিউলিস বা হীম্যান ঘরানার। ফাইনালে এসে তা হয়ে গেল পুষ্টি হারানো কঙ্কালসার! ভুলচুকের যা কিছু, তা ভারত ফাইনালের ব্যাটিং পর্বেই করেছে। এবং সেইখানেই হেরেছে।
৫০ ওভার পুরোটা খেলেছে ভারত। কিন্তু এর মধ্যে ১৩৮ বল থেকে কোনো রান নিতে পারেনি। কী বুঝলেন, ৫০ ওভারের মধ্যে ২৩ ওভারই ডটবল! পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে ভারতের শুরুর এবং মাঝের অর্থাৎ এক থেকে ছয় নম্বর পর্যন্ত ব্যাটসম্যানরা রান তোলার আসল কাজটা সেরেছেন।
প্রশ্ন ছিল কেবল একটাই—যেদিন এই ‘ছয়কর্তা’ বড়-কিছু সঞ্চয় দিতে পারবেন না, সেইদিন ভারতের স্কোরবোর্ডেও স্বাস্থ্যকে সবল করবে কে?
উত্তরে কেবল একটাই নাম ছিল—সূর্যকুমার যাদব। ফাইনালে সূর্যকুমার সেই সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু এইদিন আসল ম্যাচে এসে তার ব্যাটেও যে কিরণ ছড়াল না!
সন্দেহ নেই ভারত এই টুর্নামেন্টের সেরা দল কিন্তু ফাইনালের সেরা দল হয়ে ট্রফি জিতল অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালে না জিতলে আগে কী সাফল্য পেয়েছিলেন তা শুধু আলোচনায় থাকে, গণনায় আসে না।
মূলত বোলিংয়ের গতিকে কাজে লাগিয়ে টাইমিং নির্ভর ব্যাটিংয়ে বিশ্বাসী সূর্যকুমার। টি-টোয়েন্টিতে সেই ফর্মুলা মেনেই বেশুমার রান পেয়েছেন। তবে অস্ট্রেলিয়া ফাইনালের জন্য ভারতের প্রত্যেক ব্যাটসম্যানের জন্য পৃথক ফর্মুলার দুর্দান্ত পরিকল্পনা করেছিল।
স্লোয়ারের পর স্লোয়ার দিয়ে সূর্যকুমার ব্যাটিং আটকে দেন হ্যাজেলউড। ২৮ বলে মাত্র ১৮ রান করে বেচারা ভঙ্গিতে আউট হন সূর্যকুমার। শেষের দিকে তার আউটেই মূলত ভারতের ইনিংসের সূর্যডুবি!
আরও পড়ুন
বোলিংয়ে ভারত কিছুটা চোখরাঙানি দিয়ে শুরু করলেও বিগম্যাচ কীভাবে নিজেদের করতে হয় তা অস্ট্রেলিয়ার বেশ ভালোই জানা। ট্রাভিস হেড ও মারনাস লাবুশেন আজীবন গল্প করতে পারবেন এমন একটা ব্যাটিং জুটি গড়ে অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্বকাপ জেতালেন।
সন্দেহ নেই ভারত এই টুর্নামেন্টের সেরা দল কিন্তু ফাইনালের সেরা দল হয়ে ট্রফি জিতল অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালে না জিতলে আগে কী সাফল্য পেয়েছিলেন তা শুধু আলোচনায় থাকে, গণনায় আসে না।
আর তাই সেরা’র ট্রফি হাতে নিয়েও বিরাট কোহলি হাসতে পারছেন না।
বিশ্বকাপের সরল অঙ্কটা বেশ ভালোই কষেছিল ভারত। শুধু শেষ লাইনে এসে উত্তরটা ভুল লিখল!
এম. এম. কায়সার ।। সম্পাদক, স্পোর্টস বাংলা