রাজনৈতিক সহিংসতা : ভাঙছে সামাজিক বিশ্বাস, ক্ষতি হচ্ছে প্রগতির
দ্বন্দ্ব সত্য এবং দ্বন্দ্ব প্রগতি। কিন্তু তা হয় ঐক্যের সাধনায়। আমাদের রাজনীতিতে সেই চেষ্টা নেই। সারাক্ষণ গলা ফাটিয়ে, শিরা ফুলিয়ে গালির বক্তৃতা দিয়ে, আস্তিন গুটিয়ে আর পেশি প্রদর্শন করে আক্রমণের জন্য ছুটে চলার বীরগাঁথা রচনা করে চলেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। এতে করে রাজনীতিতে বিদ্বেষ আর জিঘাংসার চর্চা বাড়ছে।
রাজনীতিবিদরা একে অন্যের প্রতি সামান্য আস্থা রাখতে পারছেন না বিধায় সামাজিক বিশ্বাসও একেবারে নেই হয়ে যাচ্ছে। সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি যে সামান্য আগ্রহ যাকে আমরা বলি সেন্স অব বিলঙ্গিং (Sense of Belonging)—তা আর থাকছে না একেবারেই। তার বড় প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অর্থনীতিতেও।
ডলার সংকট, নগদ টাকার সমস্যা, রাজস্ব ঘাটতি এবং দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি অর্থনীতির তত্ত্ব ও যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু, এইসবের ওপর সামাজিক বিশ্বাসের কী প্রভাব পড়ছে, তা পরিসংখ্যান দিয়ে সরাসরি ধরা যাবে না। কিন্তু তা আঁচ করা যায়। যে সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাস বেশি, সেইখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেশি।
আরও পড়ুন
সাম্প্রতিককালে আমাদের রাজনীতিতে বিভেদ আর বিভাজন নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। কিন্তু এই আলোচনা বা কথা তো সত্য যে, আমাদের দেশে হরেক রকম বিভেদ চিরকালই ছিল। এই কারণেই ১৯৭১ এসেছিল, মানুষ লড়াই করে জীবন দিয়ে আলাদা মানচিত্র তৈরি করেছিল।
পাকিস্তানি যাঁতাকল থেকে মুক্ত হওয়ার বাসনার বাইরে বড় চাওয়া ছিল যে আমাদের সবাইকে মিলেমিশে এই দেশকে তৈরি করতে হবে। সেই বোধটাই আমাদের দেশের সঙ্গে মানুষকে সংযুক্ত করে রেখেছিল। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে অভাবনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল যা নিয়ে গোটা দুনিয়ায় আলোচনাও চলছিল।
করোনা আর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এবং অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতায় তা অনেকখানি থেমে গেছে। কিন্তু এই সময়ে দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্বাস একেবারে তলানিতে চলে গেছে। বলতে দ্বিধা নেই, এখন সেই বিশ্বাস একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতায় যে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে, যে সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তার মাশুল গুনছে অর্থনীতি।
গণমাধ্যমের দিকে তাকালে প্রমাদ গুনতে হয়। অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতায় যে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে, যে সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তার মাশুল গুনছে অর্থনীতি।
বিরোধী বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ আরও অসংখ্য রাজনৈতিক দল যেভাবে সহিংস অবরোধ ফিরিয়ে এনেছে এবং সরকারও চরম দমননীতি অনুসরণ করছে, তার কুফল অনিবার্যভাবে এখন চোখের সামনে।
আরও পড়ুন
ইতিমধ্যেই শত শত পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে পতন—এই দুই দুর্যোগে মানুষের জীবন এমনিতেই পর্যুদস্ত। তার ওপর এইরকম সহিংসতা। সাধারণ মানুষ তো বটেই, অনেক বড় ব্যবসায়ী এখন হিমশিম খাচ্ছেন। সংঘাতময় রাজনীতি অর্থনীতিকে বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। নির্বাচনের ব্যাপারে শান্তিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এই পরিস্থিতি হয়তো চলতে থাকবে, যার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিণাম হবে ভয়াবহ।
এমনিতেই অর্থনীতি সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিল, এখন তা আরও বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। রাজনীতির কারণে অর্থনৈতিক দুরবস্থার চিত্রটি প্রকট হচ্ছে।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, আমরা বর্তমানে একেবারে তলানিতে এসেছি। আর তো নিচে নামার পথ নেই। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় প্রধান স্পষ্টত জানিয়ে দিলেন, দৈনন্দিন জীবন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এইভাবে ব্যাহত হতে থাকলে আমাদের অধোগতি আরও ত্বরান্বিত হবে।
বিশৃঙ্খলা এবং হিংস্রতার রাজনীতি অর্থনীতির অগ্রগতি কীভাবে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত করে, তার বহু নমুনা অতীতেও দেখা গেছে। বাংলাদেশের জন্য এই বিপর্যয় বিশেষভাবে বিপজ্জনক। কারণ এলডিসি থেকে বেরিয়ে এলেও আমরা আসলে মূলত দরিদ্র দেশই।
...এমনিতেই অর্থনীতি সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিল, এখন তা আরও বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। রাজনীতির কারণে অর্থনৈতিক দুরবস্থার চিত্রটি প্রকট হচ্ছে।
মনে রাখা দরকার যে, সামাজিকভাবে যদি আস্থা আর বিশ্বাসের জায়গা এভাবে ভাঙতে থাকি আমরা তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। শুধু বড় ব্যবসা নয়, ছোট বা মাঝারি ব্যবসা চালানোর ক্ষেত্রেও আগামীতে সমস্যা হবে।
গোটা অর্থনীতি চলছে এই বিশ্বাসের ভরসায়। সেই সামাজিক বিশ্বাসটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবে অনেক অর্থনৈতিক কাজই আর করা হবে না। কেউ ভরসা করতেই পারবেন না। বাংলাদেশ কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ওপরই এবং তা আমাদের রাজনীতি নষ্ট করছে সহিংস বিদ্বেষের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। শান্তিপূর্ণ রাজনীতি আর সামাজিক স্তরে আস্থা বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে অনেক বছর দ্রুত অর্থনৈতিক গতি ঠিক রাখা গেলে দেশটির গড়পড়তা আয় কিছুটা নিরাপদ স্তরে পৌঁছাবে।
আমাদের রাজনীতিকরা বুঝতে পারেন না যে, এই দরিদ্র দেশটির পক্ষে ধারাবাহিক আয় বৃদ্ধি প্রায় আক্ষরিক অর্থেই জীবনমরণ প্রশ্ন। আর সেই কারণেই উন্নয়নের অনুকুল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
বিপুল জনসংখ্যা, অনুন্নত অবকাঠামো ও দরিদ্রতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রায় দুই দশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। বিশেষত নারী শিক্ষা, নারী ও শিশু স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পুষ্টি এবং মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় অগ্রগতি হয়েছে এই বিশ্বাসের ওপর ভর করেই। এখন তাতে ফাটল ধরতে শুরু করলে বড় বিপদ আছে সামনে।
একটা কথা না বললেই নয় যে, গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর ধর্মনিরপেক্ষতা, এই তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলাম আমরা একাত্তরের লড়াইয়ে। এটা ছিল আমাদের সামাজিক বিশ্বাস তৈরির সম্পদ।
আমরা এগিয়েছিও এই সবকিছুর ওপর ভর করেই, যদিও সংঘাত আর লড়াই কখনো থেমে ছিল না। এই সামাজিক বিশ্বাস আর প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখা খুব জরুরি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা ক্রমেই সহনশীলতার পথ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন