ভিসি যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। আমাদের দেশে ভিসি নিয়োগ হয় পুরোপুরি রাজনৈতিক কায়দায়। আমি অনেক বছর ধরে বলে আসছি, ছাত্রদের দ্বারা শিক্ষকদের মূল্যায়িত হওয়া উচিত। সারা পৃথিবীতে তাই হয়। কিন্তু কেন জানি আমাদের এখানে তা হচ্ছে না বা হয় না।
এখন ভাবছি ভিসিদেরও ছাত্র এবং শিক্ষক দ্বারা মূল্যায়িত হওয়া উচিত। প্রত্যেক ভিসির তার মেয়াদ শেষ করার পরপর সার্জারি করে একটা সালতামামি বা মূল্যায়ন করা উচিত। বিদায়ী ভিসি দায়িত্ব নেওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান, মর্যাদা, র্যাঙ্কিং ইত্যাদি যেই অবস্থায় ছিল তা থেকে আজকের অবস্থা কি ভালো হয়েছে?
শিক্ষার্থীরা কি আগের চেয়ে লেখাপড়া, থাকা-খাওয়া ও গবেষণার ভালো পরিবেশ পাচ্ছে? তাদের হলের পরিবেশ কি আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে? বিদায়ী ভিসির মেয়াদকালে কি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব মানের শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন হয়েছে?
আরও পড়ুন
এইরকম একটা সার্ভে করা উচিত। এতে করে নতুন ভিসি জানবে যে ভালো কাজের মূল্যায়ন হয়, মানুষ উৎসাহ দেয় এবং মন্দ কাজের তিরস্কার করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে টানা ৬ বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান। ২ নভেম্বর ২০২৩ উপাচার্য পদে শেষ কার্যদিবস ছিল তার। অধ্যাপক আখতারুজ্জামান ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে ‘সাময়িকভাবে’ প্রথম নিয়োগ পেয়েছিলেন।
২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ‘সাময়িক’ নিয়োগে তিনি দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। পরে চার বছরের জন্য পূর্ণ নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি। অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের আগে আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকও একইভাবে প্রথমে সাময়িকভাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। অথচ ৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুসারে সিনেটে নির্বাচনের মাধ্যমে ৩ জনের একটি প্যানেল থেকে আচার্য একজনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা।
সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে ভিসি নিয়োগ হলে একটা শক্ত ভিত্তি থাকে। এতে আত্মমর্যাদা জন্মায়। আর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কারও অনুকম্পায় ভিসি নিয়োগ হলে তা সঙ্গত কারণেই থাকে না।
আমাদের এই রাষ্ট্রের বড় বড় পদগুলো নিয়োগ প্রক্রিয়া কেমন যেন একটু উল্টাপাল্টা পথে হচ্ছে। ৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুসারে সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে ভিসি নিয়োগ হলে একটা শক্ত ভিত্তি থাকে। এতে আত্মমর্যাদা জন্মায়। আর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কারও অনুকম্পায় ভিসি নিয়োগ হলে তা সঙ্গত কারণেই থাকে না। দ্বিতীয় পথটাই বর্তমান সরকারের বেশি পছন্দ। এতে দলের লাভ হয় ঠিকই কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়।
আশার কথা হলো, নতুন ভিসি অধ্যাপক মাকসুদ কামাল সুন্দর একটি কথা দিয়ে ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। তিনি বলেছেন, মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে অন্য ভাষা শিখতে হবে। দারুণ একটি কথা।
আরও পড়ুন
আমাদের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর এই কথাটি জানানো উচিত। ইংরেজি মাধ্যমের লেখাপড়া মানে মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা না। বর্তমান ভিসির জন্য শুভকামনা। উনি ভালো করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বাড়বে। উনি ভালো করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সুফল পাবে এবং দেশ ভালো থাকবে।
অধ্যাপক মাকসুদ কামালের নতুন ভিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতারের কথা হঠাৎ আলোচনায় আসে। তিনি এক বক্তব্যে বলেন, ‘আমি বীর মুক্তিযোদ্ধার কন্যা, বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। যে মানুষ সরাসরি যুদ্ধ করেছে, তার স্ত্রী আমি। তাই আমি মাঠ ছাড়ার ভয় পাই না। আমার ওপরে আল্লাহ আছে, নিচে আছে শেখ হাসিনা।
...বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তো দূরের কথা, এটি কোনো শিক্ষিত মানুষের বক্তব্য হতে পারে? এইসব কি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে বা একজন ভিসির বক্তব্যে মানায়?
আমার আছে সাহিত্যপ্রেম। আল্লাহর প্রতি ভক্তি। আমি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়লে সবকিছু ভুলে যাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন চাচ্ছেন না, আপনারা আরও কিছুদিন আমাকে সহ্য করুন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তো দূরের কথা, এটি কোনো শিক্ষিত মানুষের বক্তব্য হতে পারে? তার ওপর তিনি বাংলাদেশের যে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩ এর অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত সেই ৪টির অন্যতম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি কার কন্যা, তিনি কার স্ত্রী, তিনি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন কি না এইসব কি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে বা একজন ভিসির বক্তব্যে মানায়?
আরে টক শো’র টেবিলেও তো এইসব কথা বলা যায় না। কী একটা দেশ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত ধর্মকে বিক্রি করছে। তাহলে আমাদের সরকার কোন লেভেলের, কেমন যোগ্যতার মানুষকে ভিসি বানায় দেখুন।
ভিসি নিয়োগ দেখলে কি মনে হয়, শিক্ষার উন্নতির প্রতি সরকারের বিন্দু মাত্র আগ্রহ আছে? সরকার আসলে কি শিক্ষার মান উন্নয়নে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে?
আরও পড়ুন
এটা শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতারের ব্যাপারে বলছি না। মোটাদাগে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের মান দেখুন, তাদের যোগ্যতা দেখুন। এমন শিক্ষকদের ভিসি বানানো হচ্ছে, যাদের নিজেদের যোগ্যতায় ভিসি হওয়ার যেমন ক্ষমতা নেই আবার পদ পাওয়ার পর পদত্যাগ করার ক্ষমতাও নেই। পদত্যাগ করতে হলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। তাহলে কিভাবে এই দেশের শিক্ষার মান উন্নত হবে?
সরকার তো ভিসি নিয়োগ দেয় না। যেন বিশ্ববিদ্যালয়কে একজন ভিসির কাছে ইজারা দেওয়া হয়। অথচ একজন ভিসির হওয়ার কথা জ্ঞানী, আলোকিত, সাহসী এবং প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। এর কোনোটিই যাদের নেই তাদেরই এখন ভিসি বানানোর জন্য খুঁজে বের করা হয়।
আমার আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, ভিসি হওয়ার জন্য এত দলান্ধ, এত নির্লজ্জ, এত আত্মসম্মান বোধহীন শিক্ষককে এরা খুঁজে পায় কীভাবে? যারা এমন মানুষ খোঁজে তারা কি আসলে দেশকে ভালোবাসে?
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়