প্যালেস্টাইন : ইতিহাসের ‘ক্লাস’, ইতিহাসের ‘ক্ল্যাশ’
ইসরায়েল ভূখণ্ডে ইহুদি জনগোষ্ঠীর রয়েছে দীর্ঘ ৩৫০০ বছরের ইতিহাস। মূলত এই ভূখণ্ডেই আজকের ‘ইহুদি’ নামক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সত্তা গঠিত হয়। আনুমানিক ২০০০ বছর আগে প্রথম এই ভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ভূমিতে ইহুদিদের ইতিহাস এবং উপস্থিতি ছিল ধারাবাহিক ও অভগ্ন। তবে ২০০০ বছর আগে ইতিহাসের সেই মর্মান্তিক সময়ে ইসরায়েল ভূখণ্ড থেকে অধিকাংশ ইহুদিকে চির বিতাড়িত করা হয়।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হলেও ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন তথা ইহুদি-আরব প্রশ্নে রয়েছে প্রচুর মতভেদ ও তর্ক-বিতর্ক। ইতিহাসের তথ্যভিত্তিক, নিরপেক্ষ ও নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে শুধু ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বের কিছু সময়রেখাই নিচে তুলে ধরা হলো।
অতীত ইতিহাস : ইসরায়েলের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত
প্রথম শতকে যখন ইসরাইলে ইহুদি সভ্যতার ইতিহাস ১০০০ বছর পেরিয়েছে, তখন রোম জেরুজালেমের পবিত্র মন্দির ধ্বংস করে এবং ইহুদি জাতি হারিয়ে বিজয় অর্জন করে। সেইসময় রোমকরা এই অঞ্চলের নতুন নাম দেয় ‘প্যালেস্টাইন’ বা ‘ফিলিস্তিন’। ইহুদি জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে তাদের মাতৃভূমি থেকে চির নির্বাসনে পাঠানো হয়।
তবে, কিছু ইহুদি রয়ে যায়। রোমক বিজয়ের পর এই অঞ্চলে অন্য কোনো রাষ্ট্র বা জনগোষ্ঠী আর বিকশিত হয়নি। পরিবর্তে নানা সাম্রাজ্য এবং সেইসব সাম্রাজ্যের মানুষেরা এসেছে, এই ভূখণ্ডকে উপনিবেশিত করেছে, শাসন করেছে এবং হারিয়ে গেছে।
আরও পড়ুন
এই যাবতীয় উত্থান-পতনের ভেতরেও কিছু ইহুদি চিরদিনই তাদের মাতৃভূমিতে থেকে গেছেন। আর অন্য যে সংখ্যাগুরু ইহুদিদের জীবনে বাঁচার দায়ে পৃথিবীর নানা দেশ ও মহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে হয়েছিল, কোনো একদিন তাদের হারানো জন্মভূমিতে ফেরার স্বপ্নকে নিজ অস্তিত্বের অংশ এবং আশার দ্বীপ হিসেবে জ্বালিয়ে রেখেছিল।
প্যালেস্টাইন কবে থেকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হয়ে উঠলো?
১৫১৭ থেকে ১৯১৭ সাল নাগাদ প্যালেস্টাইন ছিল তদানীন্তন অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। শুরুতে অটোমান শাসনাধীনে এই এলাকা সমৃদ্ধ হয়ে উঠলেও অটোমানদের পতনের পর প্যালেস্টাইন হয়ে ওঠে খানিকটা জনবিরল, দরিদ্র এবং নিষ্ফলা ও বন্ধ্যা এক ভূমি। ইতিমধ্যে উনিশ শতকের শেষ নাগাদ গোটা ইউরোপ জুড়ে ক্রমবর্ধমান ইহুদি বিদ্বেষ এবং ইহুদিদের প্রতি নানা ধরনের সন্ত্রাসী আচরণ বাড়তে থাকায় ইহুদিদের ভেতরেও জায়নবাদী আন্দোলন বাড়তে থাকে।
জায়নবাদী ইহুদিরা যাদের লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ইহুদিদের একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, তারা প্যালেস্টাইনে বর্ধিত হারে ইহুদি অভিবাসন বাড়িয়ে তুললেন এবং তদানীন্তন প্যালেস্টাইন বা অতীতের ইসরায়েল নামের ভূখণ্ডে ইহুদি অধিকারের জন্য আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমর্থন প্রত্যাশা করতে থাকেন।
প্রথম মহাযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে, এর আওতাভুক্ত ভূখণ্ডসমূহ বিজয়ী মিত্র শক্তিদের দেওয়া হয় যারা অটোমানদের বিজিত ভূখণ্ডে নতুন কিছু জাতি-রাষ্ট্রের সূচনা ঘটায়। এদের ভেতর ছিল ইরাক, লেবানন এবং সিরিয়া।
১৯১৭-১৯৪৭
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর আজকের ‘প্যালেস্টাইন’ বা ‘ফিলিস্তিন’ ভূখণ্ডকে ‘লীগ অফ নেশনস’-এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্রিটিশ শাসনের অধীনস্থ করা হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের আওতাভুক্ত অধিকাংশ ভূখণ্ডেই নতুন এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন নানা রাষ্ট্র গঠিত হলেও প্যালেস্টাইনে তা হয়নি এবং সেইখানে ‘প্রশাসনিক সাহায্য ও পরামর্শ দান’ ব্যতীতও ব্রিটিশ আদেশপত্রে ১৯১৭ সালের ‘বেলফোর ঘোষণা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ‘প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্য একটি নতুন স্বদেশভূমি প্রতিষ্ঠা’র জন্য সমর্থন ঘোষণা করা হয়।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হলেও ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন তথা ইহুদি-আরব প্রশ্নে রয়েছে প্রচুর মতভেদ ও তর্ক-বিতর্ক।
আর এই ব্রিটিশ আদেশপত্র অনুযায়ীই ১৯২২ থেকে ১৯৪৭ সাল নাগাদ প্যালেস্টাইন অভিমুখে এক বিশাল মাত্রায় ইহুদি অভিবাসন শুরু হয়। মূলত পূর্ব ইউরোপ থেকেই এই বিশালায়তন অভিবাসন শুরু হয়। আর ১৯৩০-এর দশকে নাজি নিপীড়নের সময়ে ইহুদি অভিবাসনের সংখ্যা ফুলে-ফেঁপে বাড়তে শুরু করে। কিন্তু অতীতে ইহুদিদের বাসভূমি হলেও ১৫১৭ থেকে ১৯১৭ সাল নাগাদ অটোমান সাম্রাজ্যের দুইশ বছরে বিতর্কিত এই ভূখণ্ডে স্থায়ী বসতি গড়া আরবরাও এই বিপুল পরিমাণ ইহুদি অভিবাসনের মুখে নিজস্ব স্বাধীনতা ও প্রতিরোধের দাবি তুললে ১৯৩৭ সালে সূচিত হয় এক আরব বিদ্রোহের এবং তারপর উভয় পক্ষ থেকেই চলছে লাগাতার যুদ্ধ, প্রাণহানি ও ক্ষয়-ক্ষতি।
দুইপক্ষেরই লাগাতার সন্ত্রাসে ক্ষত-বিক্ষত এই ভূমিতে কোনো সমাধানের লক্ষ্যে ব্রিটেন নানা রকম সমাধান সূত্রের কথা ভাবলেও কোনো সূত্রই কার্যকর হয়নি। অবশেষে ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন প্যালেস্টাইনের সমস্যাকে জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তরিত করে।
১৯৪৭-১৯৭৭ : ‘পার্টিশন’ বা দেশভাগের পরিকল্পনা, ১৯৪৮, ১৯৬৭, ১৯৭৩-এর যুদ্ধ, অবিভাজ্য অধিকার
ইসরায়েল তথা প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডের সমস্যা কাঁধে নিয়ে এবং সমস্যার সম্ভাব্য সব বিকল্প সমাধানের দিকে লক্ষ্য রেখে জাতিসংঘ ব্রিটিশ আদেশপত্র বাতিল করে এবং বিতর্কিত ভূমিতে দুটো পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা ঘোষণা করে, একটি ফিলিস্তিনি আরবদের জন্য এবং অন্যটি ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য হবে, আর একইসাথে জেরুজালেম নামের পবিত্র ভূখণ্ডটি হবে আন্তর্জাতিক বা সব ধর্ম ও জাতির মানুষের জন্য উন্মুক্ত (জাতিসংঘের রেজল্যুশন ১৮১ (২), ১৯৪৭)।
এভাবেই জাতিসংঘ প্রস্তাবিত দুটো রাষ্ট্রের ভেতর ‘ইসরায়েল’ রাষ্ট্র হিসেবে তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৯৪৮ সালে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে যুদ্ধে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ৭৭ শতাংশ এলাকায় নিজস্ব সীমা বিস্তার করে, জেরুজালেমেরও বৃহত্তর অংশ ইসরায়েল এইসময় দখল করে নেয়। ফিলিস্তিনি আরব জনগণের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ তখন এলাকা ত্যাগ করে এবং অনেকেই নির্বাসিত হয়।
আরও পড়ুন
জাতিসংঘের ১৮১ নম্বর রেজল্যুশন অনুযায়ী আরব রাষ্ট্রগুলোকে দেওয়া বাকি ভূখণ্ড মিশর এবং জর্ডান নিয়ন্ত্রণে নেয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেমসহ গাজা এবং পশ্চিম তীরের ভূখণ্ড সমূহ অধিকার করে এবং পরবর্তী সময়ে ইসরায়েল এই ভূখণ্ডগুলো নিজ মানচিত্রে সংযুক্ত করে।
এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের জীবনের দ্বিতীয় দেশত্যাগ সূচিত হয় এবং প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ দেশত্যাগ করে। ১৯৬৭ সালের ‘রেজল্যুশন ২৪২ (১৯৬৭)’ অনুযায়ী জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ন্যায্য ও চিরস্থায়ী শান্তির নীতিমালা গঠন করে আর এর আওতায় সংঘাতে অধিকৃত সব এলাকা থেকে ইসরায়েলের প্রত্যাহার দাবি করার পাশাপাশি উদ্বাস্তুদের জন্য ন্যায্য আবাসন গঠন এবং যাবতীয় যুদ্ধ পরিস্থিতি বা রাষ্ট্রসমূহের সব দাবি-দাওয়ার অবসানের কথাও তোলা হয়।
১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজল্যুশন ৩৩৮ অনুযায়ী ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটে জড়িত সব পক্ষের ভেতর শান্তির জন্য পারস্পরিক আলোচনার আহ্বান জানানো হলে উল্টো পারস্পরিক বৈরিতার সূচনা হয়।
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং স্ব-ভূমে ফেরার অধিকারের অবিভাজ্য অধিকারের প্রশ্নে পুনরায় তার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। পরবর্তী বছরে, সাধারণ পরিষদ ‘ফিলিস্তিনি জনগণের অবিভাজ্য অধিকার অনুশীলন বিষয়ক কমিটি’ গঠন করে এবং ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-কে’ সাধারণ পরিষদ এবং জাতিসংঘের সম্মেলনগুলোয় ‘পরিদর্শকের মর্যাদা’ দান করা হয়।
১৯৭৭-১৯৯০ : লেবানন, ইন্তিফাদা
ইসরায়েল ১৯৮২ সালের জুনে পিএলও-কে ধ্বংস করার ঘোষিত উদ্দেশ্য নিয়েই লেবাননে হামলা চালায়। একটি যুদ্ধ-বিরতির ব্যবস্থা করা হয়। বৈরুত থেকে পিএলও-র বাহিনী প্রত্যাহার করা হয় এবং প্রতিবেশী দেশগুলোয় পাঠানো হয়। পেছনে ফেলে আসা ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকলেও এইসময় সাবরা এবং শাতিলের উদ্বাস্তু শিবিরগুলোয় বড় আয়তনের গণহত্যা সংঘটিত হয়।
১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন দ্য কোয়েশ্চেন অব প্যালেস্টাইন’ নিম্নলিখিত নীতিমালা গ্রহণ করে, জেরুজালেমের অবস্থান বদলে দেওয়ার জন্য ইসরায়েলি সব বসতি এবং ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করা, নিরাপদ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমারেখার ভেতর রাষ্ট্রসমূহের অস্তিত্ব বজায় রাখার অধিকার এবং ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার অর্জন।
২০১১ সালে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘে প্যালেস্টাইনের সদস্যপদের জন্য আবেদন জমা দেয়। জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি জানায়।
১৯৮৭ সালে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে এক গণজাগরণের সূচনা হয় আর এটাই ইতিহাসে ‘ইন্তিফাদা’ নামে পরিচিত। এই ইন্তিফাদা আন্দোলনের বিস্তার রোধে ইসরায়েলি বাহিনী যেসব কৌশল অবলম্বন করেছিল তা বেসামরিক, ফিলিস্তিনি জনগণের ভেতর গণ ক্ষয়ক্ষতি এবং বিপুল জীবনহানি ঘটায়।
১৯৮৮ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স-এ ‘প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল কাউন্সিল’ তার বৈঠকে ‘প্যালেস্টাইন’ রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেন। ১৯৮৮ সালের ২৭ জুন জাতিসংঘের তদানীন্তন মহাসচিব হাভিয়ের পেরেস দে কুয়েইয়ার জেনেভায় ইয়াসির আরাফাতের সাথে দেখা করেন।
১৯৯০ সালের শান্তি প্রক্রিয়া
১৯৯১ সালে মাদ্রিদে একটি শান্তি সম্মেলন ডাকা হয় যেখানে দুই স্তরে সরাসরি আলাপের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্য স্থির করা হয়, নিরাপত্তা পরিষদের রেজল্যুশন নম্বর ২৪২ (১৯৬৭) এবং ৩৩৮ (১৯৭৩)-এর ভিত্তিতে এই দুই স্তরের সরাসরি আলাপের ভেতর একটি ইসরায়েল এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর ভেতরে এবং অন্যটি ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের ভেতরে হওয়ার কথা ছিল।
এই বহু-পাক্ষিক আলোচনা মূলত আঞ্চলিক স্তরে পরিব্যাপ্ত বিষয় সমূহ যেমন পরিবেশ, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, উদ্বাস্তু বা শরণার্থী সমস্যা, পানি এবং অর্থনীতি বিষয়ে কেন্দ্রীভূত হওয়ার কথা ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বেশকিছু আলোচনার প্রেক্ষিতে ইসরায়েল সরকার এবং ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধি স্থানীয় সংগঠন পিএলও-র ভেতরে “দ্য ডিক্লারেশন অব প্রিন্সিপলস অন ইন্টেরিম সেলফ-গভর্নমেন্ট অ্যারাঞ্জমেন্টস (ডিওপি অথবা ‘অসলো চুক্তি’)” চুক্তি স্বাক্ষর এবং আরও কিছু চুক্তির বাস্তবায়ন সাধিত হয় যা অধিকৃত ভূখণ্ডসমূহ থেকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর আংশিক প্রত্যাহার, ফিলিস্তিনি কাউন্সিল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ কারাবন্দিদের আংশিক মুক্তি ও ফিলিস্তিনি স্ব-শাসনের আওতাভুক্ত এলাকাগুলোয় একটি সক্রিয় প্রশাসন প্রতিষ্ঠার সূচনা করে।
আরও পড়ুন
সামগ্রিকভাবে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংকটে জাতিসংঘের সংলগ্নতা আন্তর্জাতিক বৈধতার অভিভাবক হিসেবে এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার সাংগঠনিক কাজে খুবই জরুরি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৯৩ সালের ডিওপি বা অসলো চুক্তি কিছু বিষয়কে আবার পরবর্তী স্থায়ী মর্যাদা বিষয়ক আলোচনার জন্য আপাত স্থগিত করে রাখে যা আর ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিড এবং ২০০১ সালে তাবায় আলোচিত হয়, তবে সেইসব আলোচনায় কিছুই প্রমাণিত হয়নি।
প্যালেস্টাইনের অংশগ্রহণ বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের ভোট
১৯৯০ সালের ৫ অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে পরিষদের আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্যালেস্টাইনকে পর্যবেক্ষক হিসেবে অনুমতি দানের পক্ষে ভোট দেয়।
২০০০-বর্তমান : দ্বিতীয় ইন্তিফাদা, বিচ্ছিন্নকারী দেয়াল, রোড ম্যাপ প্রভৃতি
২০০০ সালে ইসরায়েলের ডানপন্থী রাজনৈতিক দল লিকুদ পার্টির অ্যারিয়েল শ্যারন জেরুজালেমের আল-হারাম আল-শরিফ এলাকা বা ‘টেম্পল মাউন্ট’ এলাকা পরিদর্শনে গেলে আরবদের পক্ষ থেকে দ্বিতীয় দফা ‘ইন্তিফাদা’ বা প্রতিরোধ পর্ব শুরু হয়। পশ্চিম তীরে ইসরায়েল এক বিচ্ছিন্নকারী দেয়াল বা প্রাচীর নির্মাণ করতে থাকে এবং এই প্রাচীরের অধিকাংশই ছিল অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ভেতরে যা আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক ‘অবৈধ’ ঘোষিত হয়।
২০০২ সালে নিরাপত্তা পরিষদ ইসরায়েল এবং প্যালেস্টাইন নামে দুটো রাষ্ট্রের রূপকল্পনায় সমর্থন ব্যক্ত করে। ২০০২ সালে আরব লীগ ‘আরব শান্তি উদ্যোগ’ গ্রহণ করে। ২০০৩ সালে ‘কোয়ার্টেট (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, রাশিয়া এবং জাতিসংঘ)’ দুটো রাষ্ট্রের ভিত্তিতে সমাধানের লক্ষ্যে একটি ‘রোড ম্যাপ’ অবমুক্ত করেন।
২০০৩ সালে বিখ্যাত ও প্রভাবশালী ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মাধ্যমে একটি অ-দাপ্তরিক জেনেভা শান্তি চুক্তি প্রচারিত হয়। ২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা থেকে তার সব অধিবাসী এবং সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে যদিও সীমান্ত, সমুদ্রতীর এবং মহাশূন্যে তার নিজস্ব এলাকাসমূহের ওপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখে।
২০০৬ সালে ফিলিস্তিনি সংসদ নির্বাচনের পর ‘কোয়ার্টেট’ ফিলিস্তিনিদের সংগঠন পিএকে অহিংসা, ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদান এবং অতীতের চুক্তিগুলো গ্রহণের ভিত্তিতে শর্তসাপেক্ষ সহায়তা দিতে রাজি হয়। ২০০৭ সালে হামাস কর্তৃক গাজায় সশস্ত্র দখল সম্পন্ন হওয়ার পর ইসরায়েল এক অবরোধ আরোপ করে।
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের জনসংখ্যা বেড়েছে অন্তত দশ গুণ। আট লক্ষ ছয় হাজার জনসংখ্যা নিয়ে ইসরায়েল শুরু হয়েছিল আর আজ সেইদেশে মোট জনসংখ্যা আট কোটি পঞ্চাশ লক্ষ যার ৭৫ শতাংশই ইহুদি।
২০০৭-০৮ নাগাদ ‘আন্নাপোলিস’ প্রক্রিয়া কোনো স্থায়ী, স্থিতিশীল চুক্তি অর্জনে ব্যর্থ হয়। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান ‘কাস্ট লিড’ যেন ছিল অসংখ্য রকেট ফায়ার এবং বিমান হামলার মুহুর্মুহু আক্রমণের সমষ্টিগত ফলাফল। এই প্রেক্ষিতেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ‘রেজল্যুশন নম্বর ১৮৬০’ গ্রহণ করে।
গাজা সংকটের সময় আন্তর্জাতিক আইনের নানা লঙ্ঘনের ঘটনায় জাতিসংঘ এইসময় তদন্তও করে যা ‘গোল্ডস্টোন প্রতিবেদন’-এ উল্লিখিত। ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানাদি গড়ার জন্য ফিলিস্তিনি কর্মকাণ্ড সারা পৃথিবীতেই বিপুল সমর্থন পায়। ২০১০ সালে ইসরাইলি বন্দোবস্ত স্থগিতের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আলোচনার নতুন বৃত্ত ভেঙে যায়।
২০১১ সালে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘে প্যালেস্টাইনের সদস্যপদের জন্য আবেদন জমা দেয়। জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি জানায়। ২০১২ সালের শুরুতে আম্মানে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। নভেম্বরে ইসরায়েল এবং গাজার ভেতর আরেক দফা সন্ত্রাসের আবর্তন অনুষ্ঠিত হয় আর শেষমেশ মিশরের মধ্যস্থতায় অস্ত্র-বিরতির মাধ্যমে শেষ হয়।
আরও পড়ুন
২৯ নভেম্বর ২০১২ প্যালেস্টাইনকে জাতিসংঘে ‘অ-সদস্য পর্যবেক্ষক’-এর মর্যাদা দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে ‘সহমর্মিতার আন্তর্জাতিক বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৩ সালে নতুন এক দফা আলোচনা শুরু হলেও ২০১৪ সালে ফিলিস্তিনি জাতীয় ঐক্যমত্যের সরকার ঘোষিত হওয়ার প্রেক্ষিতে ইসরায়েল ২০১৪ সালের এপ্রিলে এই আলোচনা বাতিল করে। ২০১৪ সালের জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত ইসরায়েল ও গাজার ভেতরে আরও এক দফা লড়াই হয়।
২০১৬ সালে নিরাপত্তা পরিষদ ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের সমস্যা নিষ্পত্তি বিষয়ে রেজল্যুশন ২৩৩৪ গ্রহণ করে। ২০০৭ সালে মার্কিনি প্রশাসন ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেয় এবং দ্রুতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কিছু দেশের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরিত হয়। ২০২০ সালে ইসরায়েল এবং আমেরিকা, বাহরাইন, সুদান এবং মরক্কোর ভেতরে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য চুক্তির মাধ্যমে মধ্যস্থতার প্রয়াস চালায় (আব্রাহাম এ্যাকোর্ডস)।
২০২২ সালে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আইসিজে বা ‘আন্তর্জাতিক আদালত’-কে সেই ১৯৬৭ সালে শুরু হওয়া দীর্ঘ ইসরায়েলি দখলদারিত্বের আইনগত দিক নিয়ে উপদেষ্টার পরামর্শ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। ২০২৩ সালে সারা পৃথিবী আবার রুদ্ধশ্বাস বিস্ময় ও বেদনায় প্রত্যক্ষ করছে ইসরায়েল ও হামাসের ভেতর মরণপণ লড়াই।
২০২৩ সালের ১৫ মে সাধারণ পরিষদের অনুরোধে জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো ‘নাকবা’র ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সূচনা উদযাপন করে। উল্লেখ্য ‘নাকবা’ অর্থ হলো ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর যে অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে স্থানচ্যুত হতে হয়েছিল, সেই দুঃসময়কেই ফিলিস্তিনি জনমানসে ‘নাকবা’ হিসেবে পরিচিত।
অনেকটা কাপ্তাই বাঁধের পর লক্ষাধিক চাকমাকে যখন দেশান্তরী হতে হয়েছিল, সেই দেশান্তরী হওয়াকে চাকমা ভাষায় ‘বরপরণ’ বা ‘চির বিদায়’ বা বাংলাভাগকে আজও ‘দেশভাগ’ বা ‘পার্টিশান’ হিসেবে যে অনন্ত বেদনার সাথে স্মরণ করা হয়, ‘নাকবা’-ও তাই।
৭ অক্টোবর ২০২৩ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র বাহিনী হামাস বেসামরিক ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তু অভিমুখে হাজার হাজার রটে হামলা করে এবং গাজার বেশকিছু এলাকায় ইসরায়েলের তোলা শক্ত প্রতিরক্ষা ভেদ করে ইসরায়েলি শহরগুলোয় ঢুকে পড়ে এবং ইসরায়েলি বাহিনীদের ধৃত করাসহ বেসামরিক নাগরিক হত্যা ও গ্রেপ্তার করা শুরু করে।
এর উত্তরে ইসরায়েলি বাহিনীও ‘যুদ্ধাবস্থার সংকেত জারি করা’ ঘোষণা করে এবং গাজার নানা লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করে যার ভেতর রয়েছে আবাসিক নানা ভবন এবং স্বাস্থ্য সেবা সুবিধা। প্রত্যাঘাত হিসেবে ইসরায়েলি হামলায় ইতিমধ্যে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে এবং দশ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তচ্যূত হয়েছে এবং গাজার নানা অংশ ইতিমধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত।
তবে জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ইসরায়েল ও গাজার ভেতরে সংঘর্ষের এই বিস্তার নিয়ে তার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের গোটা অঞ্চলে এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যবর্তী ‘ব্লু লাইন’ বা ‘নীল রেখা’ বরাবর সংঘর্ষ বিষয়েও তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন আরও যেহেতু দক্ষিণ লেবানন থেকে আক্রমণের খবর আসছে।
আরও পড়ুন
সাম্প্রতিকতম এই সহিংসা সম্পর্কে গুতেরেসের মন্তব্য হচ্ছে ‘এই সন্ত্রাস শূন্য থেকে তৈরি হয়নি, বরং এক দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা থেকে এই সন্ত্রাসের জন্ম, যার মূলে রয়েছে ৫৬ বছর ব্যাপী দখল এবং সমস্যার সমাধানে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য দৃষ্টিসীমার ভেতরেও না থাকা।’
তবে একইসাথে ইসরায়েলের বেসামরিক অনেক নাগরিককে ‘হামাস’ কর্তৃক জিম্মি হিসেবে আটক রাখার বিষয়ও তিনি সমালোচনা করেছেন এবং বলেছেন যে কোনোভাবেই ‘হামাস’ কর্তৃক এই বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা-জখম-অপহরণ করাকে সমর্থন করা যায় না।
এক নজরে বর্তমানের ইসরায়েল রাষ্ট্র
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের জনসংখ্যা বেড়েছে অন্তত দশ গুণ। আট লক্ষ ছয় হাজার জনসংখ্যা নিয়ে ইসরায়েল শুরু হয়েছিল আর আজ সেইদেশে মোট জনসংখ্যা আট কোটি পঞ্চাশ লক্ষ যার ৭৫ শতাংশই ইহুদি। অন্য আর দশটি গণতান্ত্রিক, নানা নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর দেশ হিসেবে ইসরায়েলও নানা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সাথে সংগ্রামরত। দেশটিতে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র বিদ্যমান।
অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক