গণতান্ত্রিক উত্তরণ ছাড়া ব্যাংকিং সেক্টরে সমস্যার সমাধান নেই
বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি ব্যাংক মিলিয়ে, বিশেষায়িত ও বিদেশি ব্যাংকসহ, মোট তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। দেশের জনসংখ্যা ও অর্থনীতির আকৃতি বিবেচনায় এই সংখ্যাটি হয়তো খুব বেশি নয় আবার অপর্যাপ্তও নয়।
আদর্শ পরিস্থিতিতে এত সংখ্যক ব্যাংক দেশে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত পুঁজির জোগান দিতে সক্ষম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, এইসব ব্যাংকের বেশিরভাগই ভুগছে নিদারুণ তারল্য সংকটে এবং বাংলাদেশের দেশি ব্যাংকসমূহ থেকে খুব বড় মাপের বিনিয়োগের জন্য অর্থ জোগাড় করা কঠিন।
২০২৩ সালের আগস্ট মাসে দ্য ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, দেশের বেশিরভাগ ব্যাংকই তারল্য সংকটে ভুগছে—সরকারি ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক, শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক কোনো ধরনের ব্যাংকই এই সংকটের বাইরে নয়। ব্যাংকসমূহের এইরকম হাল নিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি কী উপায়ে সম্ভব তা একটা অমীমাংসিত প্রশ্নই থেকে যাবে।
ব্যাংকগুলোর এইরকম হাল কী করে হলো। প্রথম যে সমস্যাটার কথা সকলেরই মাথায় আসে তা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে প্রতিদিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র দিয়ে গণমাধ্যমগুলো প্রতিবেদন করছে, ২০২৩ সালের এপ্রিল-জুন সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২৪,৪১৯ কোটি টাকা, আর জুনের শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,৫৬,০৩৯ কোটি টাকা।
বৃহৎ আকারে নতুন বিনিয়োগ তো কঠিন হয়েছেই, ব্যাংকগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই ওদের নৈমিত্তিক ব্যবসা পরিচালনাও করতে পারছে না ঠিকমতো। দেশের প্রতি চারটি ব্যাংকের মধ্যে একটি ব্যাংক এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিতে চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক আছে যাদের বোর্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে, আর কয়েকটি আছে যাদের দৈনন্দিন কাজ চলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত তদারককারী কর্মকর্তার তদারকিতে। এইসব করেও দৃশ্যমান কোনো লাভ হচ্ছে না।
একদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, অপরদিকে আমানত হ্রাস পাওয়া এই দুই মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানের ক্ষমতা কমেছে নাটকীয়ভাবে।
প্রথম আলোর ০৮ অক্টোবর ২০২৩ তারিখের প্রতিবেদন বলছে, এইরকম ১৫টি দুর্বল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হাল গত এক বছরে আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে। এই পনেরটি ব্যাংক মিলে ২০২২ সালের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৬,৬৯২ কোটি টাকা আর ২০২৩ সালের জুনে এসে তা দাঁড়িয়েছে ১,০৮,৯৫২ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র দিয়ে পত্রিকাটি বলছে তদারকিতে থাকা ১৫টি দুর্বল ব্যাংকের অনেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিয়মিত যেটুকু তারল্য জমা রাখার কথা তা রাখছে না আবার ওদের প্রদত্ত ঋণের ক্ষেত্রেও অনিয়ম মোটেই কমছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ইঙ্গিত ছাড়া এই অব্যবস্থাপনা থেকে বের হওয়া যাবে না। এইসব ব্যাংকের অধিকাংশ মালিক পক্ষ এবং বড় বড় গ্রাহকরা বেশিরভাগ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এবং ক্ষমতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। ফলে এইসব ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওদের নীতিগত সিদ্ধান্ত কঠিন হাতে প্রয়োগ করতে পারছে না। এর ফলে এই ব্যাংকগুলো মারাত্মক বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে রয়েই যাচ্ছে। এর মধ্যে আমানতের প্রবৃদ্ধির হারও কমেছে।
২০২২-২৩ অর্থ বৎসরে ব্যাংকগুলোর আমানত বৃদ্ধির হার বেড়েছে ৮.৪০ শতাংশ যেখানে এর আগের বছর বৃদ্ধি পেয়েছিল ৮.৯০ শতাংশ। আমানত বৃদ্ধির হার কমার কারণ হিসেবে নানাপ্রকার আকর্ণের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতির কারণে ও সাধারণভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের পরিমাণ কমেছে। একদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, অপরদিকে আমানত হ্রাস পাওয়া এই দুই মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানের ক্ষমতা কমেছে নাটকীয়ভাবে। ফলে এখন যদি কেউ চায়, তাহলে ব্যাংকগুলোর ইচ্ছে থাকলেও বড় অঙ্কের কোনো শিল্প বা অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে না।
ব্যাংকগুলো তাদের নিয়মিত ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানোর জন্যেই মানি মার্কেটের দিকে হাত বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। এর মাধ্যমে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের কাছ থেকে স্বল্প মেয়াদের জন্য ঋণ গ্রহণ করে—কিন্তু মানি মার্কেট থেকে এইরকম ঋণ গ্রহণ করে জরুরি সমস্যার সমাধান সেইটা নিতান্তই স্বল্প মেয়াদের একটি সমাধান মাত্র, এর মাধ্যমে ব্যাংকের তারল্য সংকট কমিয়ে আনা যায় না।
এই সমস্যার সমাধান কী করে হবে? অর্থনীতিবিদরা ব্যাংকিং সেক্টরের এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নানা প্রকার ব্যবস্থাপত্র দিতে পারেন। সমাধানের যে প্রেসক্রিপশনই আপনি গ্রহণ করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে থাকতে হবে এইসব সমাধানের কেন্দ্রে। কিন্তু সমাধানের কোনো প্রেসক্রিপশনই বিদ্যমান সমস্যা থেকে দেশকে বের করে আনতে পারবে না যদি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও আন্তরিক সদিচ্ছা না থাকে। কেননা ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলো যতদিন সরকারের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করবে ততদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পক্ষে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছার বিপরীতে গিয়ে কঠোর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা কার্যত সম্ভব হবে না। এটাই বাস্তবতা।
ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলো যতদিন সরকারের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করবে ততদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পক্ষে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছার বিপরীতে গিয়ে কঠোর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা কার্যত সম্ভব হবে না।
একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে বাস্তবে ব্যাংকের মালিকানাই রাখা সম্ভব হয় না যদি মালিকপক্ষ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না পায়। আমাদের এখানে বিগত সময়ে দেখা গেছে নতুন ব্যাংকিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে এবং সেইসাথে বিদ্যমান ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অনানুষ্ঠানিকভাবে তবে অনিবার্যভাবে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে।
সেই সাথে দেশে কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর করতে হয়। কেননা কেবল মাত্র একটি শক্তিশালী কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাদি সব ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে। সেইসাথে একটি কার্যকর বিচার বিভাগ যার ওপর সব নাগরিক আস্থা স্থাপন করতে পারে সেইটাও নিশ্চিত করা যায় না যদি দেশে কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকে।
সরকারের জবাবদিহিতা, সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও স্বাধীন শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা যে দেশে থাকে না, সেই দেশে বিনিয়োগ করতে সাধারণত কোনো ভালো কর্পোরেশন উৎসাহিত হবে না। আর যারা এইরকম ঘোলা পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করতে চায়, ওরা সার্বিকভাবে ওদের মুনাফা নিশ্চিত করার জন্যে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও অস্বচ্ছতাকেই ব্যবহার করে এবং এতে করে দেশের আসলে খুব বেশি লাভ হয় না।
এক দশকে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য বড় অঙ্কের কোনো প্রকৃত বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়নি। সরকার থেকেই স্বীকার করা হচ্ছে যে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এখন খুবই কঠিন হয়ে গেছে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, আমরা এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের বিরাজমান সংকট নিয়ে কথা বলছি, সেই সংকট থেকে উত্তীর্ণ হওয়া আর দেশে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এই দুইটাই একই সূত্রে গাঁথা।
এর অর্থ হচ্ছে, খুব শিগগিরই আমরা ব্যাংকিং সেক্টরের বিদ্যমান সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারবো সেইরকম নিশ্চয়তা কারও পক্ষেই দেওয়া সম্ভব না। আশু কোনো নাটকীয় সমাধানের আশা করলে ভুল হবে। সুতরাং এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্যে একদিকে দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণ করতে হবে, আরেকদিকে বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যেই যতটুকু সম্ভব নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনতে হবে ব্যাংকিং সেক্টরে। এইটুকুও যদি আমরা করতে না পারি, যে কোনোদিন দেখা দিতে পারে বড় কোনো সংকট।
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট