অর্থনীতির সুখবর কোথায়?
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এমন একটা খবরে অবাক কিংবা বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি হবে।
খবর আরও আছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয়ে ধস নামার খবরও দিচ্ছে সংবাদমাধ্যম। বলছে সাড়ে তিন বছরের মতো সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরে। প্রবাসী আয় বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা কাজে দিচ্ছে না। আর বিজিএমইএ বলছে, দেশের প্রধান দুই বাজার উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে সামগ্রিক পোশাক রপ্তানি আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
তাহলে অর্থনীতির সুখবরটা কোথায়? আমাদের অর্থমন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে প্রশ্ন দাঁড়ায়—অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার এমন হাল হলো কেন?
আরও পড়ুন
২০২৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে। এতে দায় ও সম্পদের অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু এইটুকুতে পুরো চিত্র পরিষ্কার হয় না।
একটা বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ আদায়ের কোনো কার্যকর ব্যবস্থাপনা ব্যাংক ও আর্থিক খাতে গড়ে ওঠেনি। আইন আছে, কিন্তু তা প্রয়োগের বড় অভাব। ছোট ছোট ঋণ খেলাপিদের নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও বড় বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপিদের কোনোদিন কোনো শাস্তি হয়নি।
যেসব ব্যাংকের সাথে জড়িত থাকে, তাদের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশ ব্যাংককে খুব কড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ফলে ঋণ নিয়ে কোনো ঋণ গ্রহীতার মধ্যেই কোনো ফেরত দেওয়ার বাসনা সৃষ্টি হয় না। আরেকটা বড় কারণ বারবার আইন সংশোধন করে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ এবং পুনর্গঠনের মতো সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
খেলাপি ঋণ আদায়ের কোনো কার্যকর ব্যবস্থাপনা ব্যাংক ও আর্থিক খাতে গড়ে ওঠেনি। আইন আছে, কিন্তু তা প্রয়োগের বড় অভাব। ছোট ছোট ঋণ খেলাপিদের নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও বড় বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপিদের কোনোদিন কোনো শাস্তি হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর বা আগের গভর্নররা কেউই নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে দেখেননি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে যে ক্ষমতা আছে তাতে অনেক কিছু করা সম্ভব। ঋণ বিতরণের সীমা বেধে দেওয়া, যার খেলাপি ঋণ বেশি সেই ব্যাংককে নতুন শাখা খুলতে না দেওয়া, পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া, পরিচালকদের সরিয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেখা যায় না।
আরও পড়ুন
তার এই নীরবতাই একটা দুর্বিনীত চক্র গড়ে উঠেছে ব্যাংকিং খাতে। একজন ব্যক্তির কাছে একসাথে সাত থেকে আটটি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং তাদের হাতেই ভোগ্যপণ্যের বাজার রেখে পুরো সিস্টেমকে ব্যক্তি বিশেষের খেয়ালখুশির জায়গায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে চাপে আছে সরকার, কারণ ডলার সংকট। দুটি বড় উৎস—রপ্তানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। দুটোই যখন চাপে থাকে তখন সংকট থেকে বের হওয়ার পথটা সহজ হয় না। প্রবাসী আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসে, যা আনুষ্ঠানিক প্রবাসী আয় হিসেবে চিহ্নিত হয় না। সরকার ইনসেন্টিভ দিয়েও অনেক প্রবাসীদের ব্যাংক মুখী করতে পারছে না। অনানুষ্ঠানিক পথে টাকা পাঠানোই পছন্দ তাদের। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করা হলে প্রবাসী আয় বাড়বে কি না ভেবে দেখা দরকার।
রপ্তানি আয় কমার খবরটিও উদ্বেগজনক। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে রপ্তানি বাজারে, কারণ বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানির বাজারগুলোয় প্রবল অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। দেশের ভেতরে ডলার, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, যার কারণে আয় কমে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে চাপে আছে সরকার, কারণ ডলার সংকট। দুটি বড় উৎস—রপ্তানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। দুটোই যখন চাপে থাকে তখন সংকট থেকে বের হওয়ার পথটা সহজ হয় না।
রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে একক পণ্য হিসেবে পোশাক খাতের ওপর প্রায় সম্পূর্ণতা এবং বাজার হিসেবে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের ওপর নির্ভরতা বড় সংকট তৈরি করে রেখেছে। এখান থেকে বের হওয়ারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। তৈরি পোশাকের ৭৮ শতাংশই রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে ২৬ শতাংশ এবং ইউরোপে ৫২ শতাংশ। বাকি ২২ শতাংশ যাচ্ছে অন্যান্য দেশে।
আবার রপ্তানি হওয়া পণ্যের বিপরীতে যে পরিমাণ আয় দেশে আসার কথা তার সবটা আসছে না। বিশ্ব পরিস্থিতি খারাপ হলে দুর্বল ও আমদানিনির্ভর দেশগুলোর জন্য পরিস্থিতি কতটা নাজুক হতে পারে তার প্রমাণ আমরা দেখছি এখন।
আরও পড়ুন
জ্বালানি-সংকটের কারণে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে ডলার-সংকটের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শিল্পোদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা, শিল্প টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
তাহলে অর্থনীতি আসলে চলছে কোন পথে? প্রথমেই উল্লেখ করা তিনটি বড় খাতের অবস্থা বলে দিচ্ছে কোনোকিছু ভালোভাবে চলছে না। এই অবস্থায় দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না, নতুন শিল্পকারখানাও প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাহলে পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়াবে সেই ভাবনাটা জরুরি।
অর্থনীতিকে সচল ও সজীব রাখতে বিনিয়োগের বাধাগুলো দূর করার বিকল্প নেই সরকারের কাছে। চিন্তাটা সেইদিকেই নিতে হবে। জিডিপির মোহ ছেড়ে বাস্তবের পথ ধরতে হবে, কারণ জিডিপি এখন অচল।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন