সংস্কৃতির অনুশীলনে ফিরব কবে?
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয়নি। কারণ এমন ঘটনা ঘটতে আগেও দেখেছি, বাড়বে সেই পূর্বাভাসও দেখতে পাচ্ছিলাম।
এখানে কেউ কেউ বা অনেকেই বলতে পারেন, বাংলাদেশের উত্তরের এক অজপাড়া গাঁয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে। ঐ গণ্ড মূর্খের এলাকায় এমন কাণ্ড ঘটতেই পারে। ওখানকার মানুষ স্বভাব বা চারণ কবির মর্যাদা দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন না।
গ্রাম এলাকায় মৌলবাদী চিন্তার বিকাশ ঘটেছে, তারই বহিঃপ্রকাশ এটি। এমন ধারণা যদি কেউ করে থাকেন, তার সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ নাগেশ্বরী ও অবশিষ্ট বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখি না।
আরও পড়ুন
দীর্ঘ সময় ধরেই, দুই-আড়াই দশক তো বটেই লক্ষ্য করছি, বাংলাদেশের বদলে যাওয়া। গ্রাম-শহর, নিম্নবিত্ত-উচ্চবিত্ত, সকলেই অসহিষ্ণু অন্যের মতামত—বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির প্রতি। আমরা যারা শিক্ষিত, বসে ভঙ ধরে আছি, পত্রিকা-টিভি বা মঞ্চে নিজেদের সংস্কৃতির ডিলার বলে চিৎকার করে যায়, তাদের মধ্যে এই অসহিষ্ণুতা আরও গাঢ়। বিশ্বাসের অন্ধত্ব তীব্র।
গ্রাম-গঞ্জ-শহরের বদলে যাওয়ার সঙ্গে প্রযুক্তির সম্পর্ক আছে। এক সময় তথ্য ও বিনোদনের জোগানদাতা ছিল পত্রিকা, বেতার, টিভি। পরে ভিসিআর, ভিসিপি শেষে এলো ক্যাবল টিভি। এখন তারও বুঝি দিন ফুরাচ্ছে।
ডিজিটাল মাধ্যম এখন মানুষের তথ্য ও বিনোদনের উপযোগকে উসকে দিচ্ছে বা নিয়ন্ত্রণ করছে। লক্ষ্য করে দেখেছি—গান, নাটক, সিনেমা দেখার চেয়ে সব ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষেরা ধর্মীয় বয়ান শুনছেন।
...কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর স্বভাব কবি রাধাপদ রায় যে শুধু রক্তাক্ত হচ্ছে তা নয়, রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত সব মানুষের।
মুশকিল হলো, এসব বয়ান যে ঐ সব ধর্মের সঠিক জ্ঞানী ও বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের দেওয়া তা নয়। বরং এক প্রকার বাণিজ্যিক ও উগ্রতা ছড়ানোর মতলবই লক্ষ্য করা যায়। ইউটিউবে ছড়ানো ছিটানো বয়ানে চোখ-কান দিলেই তা লক্ষ্য করা যাবে।
এই বয়ানগুলো সব ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষের যাপনে পরিবর্তন এনেছে। যাপন মানেই সংস্কৃতি, আমাদের গ্রাম ও শহরের মানুষের যে যাপন ছিল, তা এখন আর আগের অবস্থানে নেই। ঘরে, পথে সব আর্থিক শ্রেণির মানুষের মধ্যেই এই পরিবর্তন ঘটেছে।
আরও পড়ুন
বদলে গেছে বিনোদন ও তথ্যের রুচিও। আমি গ্রাম-শহর যেখানেই যাই, চোখ রাখি বাড়ি-অফিস আদালতের অন্দর বাহিরের সাজসজ্জা, পরিধান থেকে শুরু করে খাবারের দিকে।
দেখতে পাচ্ছি সেইখান থেকে বাংলা হারিয়ে গেছে প্রায়। সন্তানের নাম রাখার বেলাতে তাই। বাংলা সংস্কৃতি থেকে দূরে যাওয়া, বিচ্ছিন্ন হওয়াতে এই সংস্কৃতির এক প্রকার বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে। ফলে পরিবার ও সমাজ থেকে গান, নাচ, নাটক, যাত্রার যে চর্চা, অনুশীলন তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
...বলতে পারছি না বলেই রাধাপদ রায়কে সইতে পারে না সমাজ। হয়তো সইতে পারে না আপনাকেও, কারণ মানুষের শক্তির কথা উচ্চারিত হলে, তা সইবার সাধ্য সমাজ হারিয়েছে বেশ আগেই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা দেখি, তা অনেকাংশেই রুচিহীন এবং ব্যক্তির তারকা হওয়ার লিপ্সার প্রকাশ। এখানে গোষ্ঠী বা সম্মিলিতের সাংস্কৃতিক চর্চায় যুক্ত হওয়ার প্রয়াস কম।
এই যে সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হওয়া। তাই কিন্তু মানুষকে অসহিষ্ণু করেছে। মানুষের মধ্যে নিজের মতকে জোর পূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা বা লক্ষ্য থেকে সরে এসে রাজনৈতিক বা ক্ষমতার স্বার্থ রক্ষার মতলবকে প্রোপাগান্ডা হিসেবে ছড়ানোর মানসিকতা নেমে এসেছে ব্যক্তি অবধি। ফলে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর স্বভাব কবি রাধাপদ রায় যে শুধু রক্তাক্ত হচ্ছে তা নয়, রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত সব মানুষের।
আরও পড়ুন
আমরা সংস্কৃতি ও বিনোদনের মাধ্যম একাকার করে যেমন অপরাধ করেছি, তেমনি অন্যায় করেছি সংস্কৃতির মানুষেরা নিজেদের মধ্যে বিভেদের ফাটল বাড়তে দিয়ে। যাদের হাতে তৈরি ফাটল, তাদের প্রতি বরং নতজানু হয়ে সর্বনাশ ঘটিয়েছে।
আমরা চিৎকার করে আজও বলতে পারছি না, সংস্কৃতি কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বা বিশ্বাসের নয়। মানুষ সংস্কৃতির স্বভাব সভ্য। বলতে পারছি না বলেই রাধাপদ রায়কে সইতে পারে না সমাজ। হয়তো সইতে পারে না আপনাকেও, কারণ মানুষের শক্তির কথা উচ্চারিত হলে, তা সইবার সাধ্য সমাজ হারিয়েছে বেশ আগেই। সংস্কৃতির অনুশীলনে ফেরা ছাড়া আমাদের মুক্তির পথ নেই আর।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী