বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম আইন ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা
সংবাদমাধ্যম গণমানুষ ও গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। এর প্রধান লক্ষ্য জনকল্যাণ নিশ্চিত করা। একজন সাংবাদিকের প্রধান কাজ সত্য, ষড়যন্ত্র ও সম্ভাবনার বিষয়গুলো বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রচার বা প্রকাশ করা। যাতে মানুষ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যথাযথভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর এই কাজ করতে গিয়ে যুগে যুগে সাংবাদিকরা নানা শ্রেণি, পেশা, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের শত্রু বলে চিত্রিত হয়েছেন।
কখনো আখ্যায়িত হয়েছেন গুপ্তচর, মাকরেকার, রাজদ্রোহী, কুচক্রী, অপপ্রচারকারী অথবা কখনো ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে। আর তাই ক্ষমতাসীনরা বরাবরই সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ, দমন বা নির্মূল করতে তৈরি করেছেন নানা ধরনের আইন-কানুন।
অন্যদিকে সেনা বা স্বৈরশাসকের ক্ষমতা গ্রহণের সময় তারা প্রথম যে কাজটি করে তা হলো গণমাধ্যমের ওপর কর্তৃত্ব আরোপ বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেই গণমাধ্যমের ওপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন ইয়াহিয়া খান। আর ২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহ ক্র্যাকডাউনের পরে আরেক দফা জারি হয়েছিল গণমাধ্যম সংক্রান্ত নতুন সামরিক বিধি।
আরও পড়ুন
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, সাংবাদিকদের দেশি-বিদেশি সংগঠনের উদ্বেগের মধ্যেই ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩। এই আইনটি সরাসরি সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট না হলেও এই আইনের সাথে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সম্পর্ক রয়েছে।
ভারতবর্ষ তথা এশিয়ায় আধুনিক গণমাধ্যমের অগ্রযাত্রায় একজন আইরিশ নাগরিকের নাম জড়িয়ে আছে। তিনি হলেন জেমস অগাস্টাস হিকি। ভাগ্য বিড়ম্বিত, খানিকটা খ্যাপাটে এই হিকিই ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রকাশ করেছিলেন ‘হিকিস বেঙ্গল গেজেট’। দিনটি ছিল শনিবার, পত্রিকার দাম এক টাকা।
বর্ধিষ্ণু কলকাতার ৬৭, রাধাবাজারের ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এই সাপ্তাহিক সংবাদপত্রটি। ভারতবর্ষের প্রথম গণমাধ্যম হিসেবে ‘হিকিস বেঙ্গল গেজেট’ একটি মাইলফলক হলেও এর আধেয় কিন্তু খুব একটা মানসম্মত ছিল না।
চারপাতার এই সংবাদপত্রে থাকতো ইংরেজ সাহেবদের যৌন জীবনের নানা ধরনের রগরগে কেচ্ছা-কাহিনি। থাকতো সমকামিতার ইঙ্গিত। অকল্পনীয়-অবাস্তবসব গল্পসহ থাকতো নানা ধরনের মানহানিকর সংবাদ। এছাড়া এই সংবাদপত্রের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল নির্দিষ্ট ব্যক্তির চরিত্রহনন। যার প্রধান লক্ষ্য ছিলেন বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেই গণমাধ্যমের ওপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন ইয়াহিয়া খান...
হিকি তার সংবাদপত্রে লিখেছিলেন, যুদ্ধের চাপে যৌন ক্ষমতা হারিয়েছেন হেস্টিংস! এছাড়া খবরের লাইনে লাইনে থাকতো কড়া বিদ্রূপ, শ্লেষ আর কৌতুক। তবে একইসাথে বিভিন্ন বিষয়ে দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষও নিয়েছিলেন হিকি।
কোম্পানির অযৌক্তিক কর আরোপের বিরুদ্ধে ছিল সংবাদপত্রটির অবস্থান। যার ফলে তার সংবাদপত্রের জনপ্রিয়তাও বাড়ছিল। আর এতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রোষানলে পড়েন হিকি। একইসাথে হিকি খেপিয়ে তুলেছিলেন কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এলাইজা ইম্পিকে।
সংবাদপত্রের আধেয় সংক্রান্ত এবং নানা বিষয়ে বিরোধে জড়িয়ে ১৭৮২ সালেই বন্ধ হয়ে যায় ‘হিকিস বেঙ্গল গেজেট’। জেলের ঘানি টানতে হয় সম্পাদক জেমস অগাস্টাস হিকিকে।
আরও পড়ুন
১৭৮২ সালে জেমস অগাস্টাস হিকির সংবাদপত্র বন্ধ ও জেল-জরিমানা হয়েছিল প্রচলিত আইনে। যদিও পরে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে ভারতবর্ষে বেশ কয়েকটি আইন প্রচলিত হয়েছিল।
ভারতবর্ষ তথা ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলগুলোয় গণমাধ্যম সংক্রান্ত প্রথম আইনটি প্রবর্তিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর। এই আইনটির নাম ছিল গ্যাগিং আইন ১৮৫৭ (Gagging Act,1857)। এটি ছিল সাংবাদিকদের জন্য চরম একটি নিবর্তনমূলক আইন।
এই আইনে সাংবাদিকদের হয়রানি, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত এমনকি জেলে পাঠানো হতো। এই আইনে বলা হয়, কোনো সংবাদপত্র বা প্রকাশনায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। শাসকদের প্রশান করা যাবে না।
এই আইনে সংবাদপত্র বা প্রকাশনাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় নতুন আরেকটি নিবর্তনমূলক আইন পাস করে ব্রিটিশ সরকার। এর নাম কুখ্যাত ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট, ১৮৭৮ (Vernacular Press Act, 1878)। এটি ছিল সরাসরি সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের একটি ভীতিকর হাতিয়ার।
ভারতবর্ষ ছাড়াও ব্রিটিশদের অধীন সব সাম্রাজ্যে এই আইন কার্যকর হয়। বহুল বিতর্কিত এই আইনটির লক্ষ্য ছিল দেশীয় বা স্থানীয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা। চরিত্রগত দিক থেকে এই আইনটিই ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের প্রথম সরাসরি আইন।
এই আইনের একটি প্রেক্ষাপট ছিল। ব্রিটিশ অপশাসনে ভাইসরয় লর্ড লিটনের সময় ভারতবর্ষে ১৮৭৬-৭৭ ভারতবর্ষে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যদিও এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেই ব্রিটিশদের বিলাসী জীবন বজায় থাকে। যা নিয়ে সংবাদপত্রের পাতা ও অন্যান্য প্রকাশনায় তীব্র সমালোচনা শুরু হয়।
আরও পড়ুন
এই সমালোচনাকে রোধ করার জন্যেই প্রবর্তন করা হয় কুখ্যাত ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট। যে আইন প্রবর্তনের সময় লর্ড লিটন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের উল্লেখ করেছিলেন কুচক্রী, বাজে লেখক হিসেবে। আর সংবাদপত্রগুলো আখ্যায়িত করেছিলেন ‘রাজদ্রোহ’ আন্দোলনের সংগঠন হিসেবে। এই আইনে বিধান ছিল প্রকাশের আগে সংবাদপত্রের আধেয় পুলিশের কাছে জমা দিয়ে অনুমোদন নিতে হবে।
এছাড়া কোনো সংবাদ বা প্রকাশনা রাজদ্রোহমূলক কি না তা নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল ব্রিটিশ পুলিশের হাতে, আদালতের নয়। এছাড়া সম্পাদককে জরিমানা ও কারাদণ্ড দেওয়ার মতো ধারাও ছিল চরম নিবর্তনমূলক এই আইনে। এই কালাকানুনটি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করেছিল সোমপ্রকাশ, সুলভ সমাচার, হালিশহর পত্রিকা, অমৃতবাজার পত্রিকা, ভারত মিহির, ঢাকা প্রকাশ, সাধারণী ও ভারত সংস্কার সংবাদপত্রকে।
ভারতবর্ষ ছাড়াও ব্রিটিশদের অধীন সব সাম্রাজ্যে এই আইন কার্যকর হয়। বহুল বিতর্কিত এই আইনটির লক্ষ্য ছিল দেশীয় বা স্থানীয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা। চরিত্রগত দিক থেকে এই আইনটিই ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের প্রথম সরাসরি আইন।
ঊনবিংশ শতকে বৃটিশরা বিশ্বব্যাপী তাদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে যেসব আইন করেছিল তারই ধারাবাহিকতা দেখতে পাওয়া যায় বর্তমান বিশ্বের কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রসমূহে। যার শীর্ষে রয়েছে উত্তর কোরিয়া, ইরান, উজবেকিস্তান, মঙ্গোলিয়া ও ফিলিপাইন।
একবিংশ শতাব্দীতে গণতান্ত্রিক যে দেশে গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছে ঐ দেশটির নাম ফিলিপাইন। রদ্রিগো দুর্তাতের আমলে দেশটিতে সাংবাদিকদের জাতির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। দেশের জনপ্রিয় গণমাধ্যম এবিএস-সিবিএন (ABS-CBN) এর ওপর নেমে এসেছিল নিষেধাজ্ঞার খড়গ।
যদিও ২০২১ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সাংবাদিক মারিও রেসার অনলাইন গণমাধ্যম রাফলার (Rappler) এর মাধ্যমে দুর্তেতের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা করে গেছেন। তুলেছন যৌক্তিক প্রশ্ন। যদিও এর প্রেক্ষাপটে মারিও রেসার সহকর্মীদের মোকাবিলা করতে হয়েছে মামলা, লাইসেন্স বাতিলের হুমকিতে পড়তে হয়েছে, সামলাতে হয়েছে কর ফাঁকির মামলা, এমনকি মোকাবিলা করতে হয়েছে সাইবার পরিসরে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও।
আরও পড়ুন
সর্বশেষ সরকারের মামলায় সাজা হয়েছে মারিও রেসা ও তার সহকর্মীর। এদিকে দুর্তাতেরর পতন হলেও দেশটিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত আছে।
২০২২ সালে দেশটিতে পাস হয়েছে নতুন আইন। ফেসবুক, টুইটার (বর্তমানে এক্স) ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ এই আইনের বিরোধিতা করলেও তাতে কেউ কর্ণপাত করেনি।
এদিকে চলতি বছর মধ্য এশিয়ার দেশ মঙ্গোলিয়াতে পাস হয়ে মানবাধিকার রক্ষা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সুরক্ষা বিষয়ক নতুন এক আইন। যা দেশটিতে সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নতুন করে বাধা সৃষ্টি করেছে। একই রকম প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করছে চীন, রাশিয়াসহ তাদের প্রভাবভূক্ত দেশগুলোয়।
রাশিয়ার প্রভাববলয়ে থাকা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষয়িষ্ণু হলেও ইউরোপের জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলোয় এর অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। যেমন—গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে উদার ও পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেন নরওয়ের সাংবাদিকরা। এরপরের অবস্থানে রয়েছে আয়ারল্যান্ড ও অন্যান্য নর্ডিক দেশসমূহ।
রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]