সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী ছিলেন সময়ের নায়ক
চলচ্চিত্র ‘ঘুড্ডি’ যেদিন প্রথম দেখেছিলাম তখন এই চলচ্চিত্রের নির্মাতা সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না। মনে আছে, প্রথমবার ‘ঘুড্ডি’ দেখেছি ভিএইচএস ফরম্যাটে, তবুও তা ছিল ‘বড় পর্দা’রই প্রদর্শনী। ছবিটি দেখেছিলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চলচ্চিত্র চক্রের আয়োজনে।
‘ঘুড্ডি’র আগে এই চলচ্চিত্রের মতো এবং তা নির্মাণের এত বছর পর বলতে পারি, এর মতো আর কোনো চলচ্চিত্র বাংলাদেশে হয়নি। এর চেয়ে নিখুঁত চলচ্চিত্র বাংলাদেশে হয়েছে, এমনকি এর আগেই হয়েছে এবং পরে তো আরও হয়েছে, কিন্তু ‘ঘুড্ডি’—তবুও, অনন্য একটি চলচ্চিত্র।
কেন? কারণ, ‘ঘুড্ডি’ বাংলাদেশের এমন একটি চলচ্চিত্র যা নির্মাণ প্রকরণের দিক থেকে ফরাসি নবতরঙ্গের মেজাজকে সঙ্গী করেছে, কিন্তু হয়ে উঠেছে শতভাগ দেশীয় চলচ্চিত্র, ছবিটি সমকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রবণতাগুলো চিন্তাশীলভাবে ধারণ করেছে, অথচ ছবিটি ক্লান্ত করে না। ‘বিনোদন’ দেয় এবং সবাইকে মুগ্ধ করে।
‘ঘুড্ডি’র আগে বাংলাদেশের এমন কোনো চলচ্চিত্রের নাম আমরা করতে পারবো না, যে চলচ্চিত্র এতটা সফলভাবে চলচ্চিত্রের ভাষা ও ভঙ্গির এমন নিরীক্ষাপ্রবণ মেজাজ ধারণ করেছে। আশ্চর্য হলো, ‘ঘুড্ডি’র নির্মাতা এই নিরীক্ষার পথে পরবর্তীতে আর হাঁটেননি।
আরও পড়ুন
যে নির্মাতার সক্ষমতা ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে নতুন ভাষা ও ভঙ্গির পথে নেতৃত্ব দেওয়ার, কোনো এক অজানা কারণে পরবর্তীতে তিনি সেই পথের নির্মাতা আর হলেন না, তিনি হলেন শিক্ষক। সেই নির্মাতা ও শিক্ষকের আকস্মিক প্রয়াণের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলছি, তার ছাত্ররা বাংলাদেশে নতুন এক ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা সত্য। কিন্তু তারাও, অর্থাৎ তার ছাত্ররাও কেউই ‘ঘুড্ডি’র নির্মাতার প্রকরণে কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি। ফলে, ইতিহাসে ‘ঘুড্ডি’ আজও উড়ছে, একা!
১.
‘ঘুড্ডি’ দেখার এবং তা নিয়ে উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনার প্রায় ১০ বছর পর আমার সুযোগ হয় নির্মাতা সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর মুখোমুখি হওয়ার। আর এই সংযোগটি যিনি তৈরি করেছিলেন তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আরেকজন কিংবদন্তি, চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান।
….এভাবেই সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী ভাইয়ের সাথে সরাসরি পরিচয় হলো আমার। জাকী ভাই এরপর আমাদের সহযোদ্ধা হয়ে উঠলেন, আমাদেরও করে নিলেন তার যুদ্ধপ্রকরণের প্রকল্পে। হয়ে উঠলেন ম্যুভিয়ানার একজন অভিভাবক।
সময়টি ২০০৯ সাল। আমরা ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির একটি ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স আয়োজন করছিলাম তখন। সেই কোর্সটি উদ্বোধন করার জন্য তখন বাদল ভাইকে অনুরোধ করি। বাদল ভাই বলেন, আমি একা কেন? জাকীকেও বলো। কিন্তু আমি তখন জানতাম জাকী ভাই দেশে নেই। তিনি ২০০১ সালে কানাডা চলে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরেছেন এই খবর তখনো আমার জানা ছিল না। এটা বাদল ভাইকে বলার পর তিনি বললেন, দাঁড়াও, আমিই কল করে তোমার সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।
এভাবেই সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী ভাইয়ের সাথে সরাসরি পরিচয় হলো আমার। জাকী ভাই এরপর আমাদের সহযোদ্ধা হয়ে উঠলেন, আমাদেরও করে নিলেন তার যুদ্ধপ্রকরণের প্রকল্পে। হয়ে উঠলেন ম্যুভিয়ানার একজন অভিভাবক। আর এই বিষয়টি আমাদের জন্য ছিল শক্তির, সাহসের এবং অনুপ্রেরণার। পরিচয়ের পর থেকে প্রয়াণের পূর্বের দিনটি পর্যন্ত আমাদের সব কোর্স, কর্মশালা, চলচ্চিত্র উৎসব, সেমিনারসহ সব আয়োজনে তিনি আমাদের মাঝে উপস্থিত থেকেছেন। যেমনটি আমাদের সাথে ছিলেন চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান।
১১ জুন ২০১০, বাদল ভাই চলে গেলেন। রেখে গেলেন জাকী ভাইকে। বাদল ভাই চলে যাওয়ার ১৩ বছর পর (১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩) জাকী ভাইও চলে গেলেন। এর মাঝে চলে গেছেন আলোকচিত্রী ও সিনেমাটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেন (১ ডিসেম্বর ২০১৮)। বাংলাদেশের প্রথম তিনজন চলচ্চিত্র শিক্ষার্থী, যারা তাদের তৎকালীন ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা ও ক্যারিয়ারকে লাথি মেরে চলচ্চিত্রকে ভালোবেসেছিলেন, স্কলারশিপ নিয়ে গিয়েছিলেন পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে, তারাই ছিলেন প্রথম, সূচনা বিন্দুর মতো শক্তিধর। আজ তারা তিনজনই আজ অন্যলোকের বাসিন্দা হয়েছেন।
বাদল রহমান, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী এবং আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এই তিন দিকপালের অবদান কেবল চলচ্চিত্র নির্মাণে নয়, দেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতি বিকাশে ও নির্মাণে তাদের অবদানকে গভীরভাবে না জানলে তাদের সম্পর্কে আদতে কিছুই জানা হবে না।
২.
কর্ম ও কীর্তির বিচারে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী একজন সফল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ‘সাংস্কৃতিক’ ব্যক্তিত্ব কারণ, সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি এমন এক কালপর্বে এমন সব উদ্যোগ ও প্রয়াসে নিয়োজিত ছিলেন যা আমাদের সাংস্কৃতিক মনীষা বিকাশে বিপুল প্রভাব রেখেছে, প্রভাব রেখেছে সমাজ রূপান্তরে ও রাজনৈতিক চিন্তা ও চেতনায়। সময়কে এভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা কেবলমাত্র সময়ের নায়কদেরই থাকে। সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী ছিলেন তার সময়ের অন্যতম নায়ক।
ষাটের দশকের তুখোড় লিটলম্যাগ সম্পাদক, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সমর্থনে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে দেওয়া, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফিল্ম সোসাইটি ‘সিনে আর্ট সার্কেল’ প্রতিষ্ঠা এবং ঢাকা থিয়েটার-এর জন্মে নেতৃত্ব প্রদানসহ বহুবিধ উদ্যোগে তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
আরও পড়ুন
ঢাকা শহরে কাক ও কবির সংখ্যার আনুপাতিক হার নিয়ে তৈরি যে ব্যঙ্গবিদ্রূপ, সেই ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপের জন্ম যে লিটলম্যাগকে ঘিরে সেই লিটলম্যাগ ‘কাক’-এর সম্পাদক যে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, এই তথ্য চলচ্চিত্রকার সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর নামের আড়ালে যেন বিস্মরণের শিকার। একইভাবে কবি ও গল্পকার সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীও কিন্তু লুপ্ত হয়েছেন।
একজন মানুষের যখন বহুদিক একইরকমভাবে প্রতিভার আলোয় উদ্ভাসিত হয় তখন সেই মানুষের চারপাশে থাকা জনতা বিভ্রান্ত হয়, বুঝতে পারে না তাকে কী অভিধায় চেনা যায়, আর তখন ওই প্রতিভাবান ব্যক্তির কোনো একটি পরিচয় শক্তিশালী হয়ে সামনে এলে ওই পরিচয়ের বাইরে থাকা ব্যক্তির অপরাপর গুণসব হারিয়ে যায়, মানুষের কাছে আর সব পরিচয় মুছে যায়।
কখনো কখনো খোদ ওই ব্যক্তিরও তা হয়। যেমন জাকী ভাইও প্রায় ভুলতে বসেছিলেন যে, লেখাটা তার একটি বড় গুণ ও ক্ষমতা। বহুবছর তিনি লেখালেখির বাইরেই ছিলেন একপ্রকার। নানাভাবে উসকে দিয়ে, খুঁচিয়ে, কয়েক বছরে তাকে দিয়ে কিছু কিছু লেখা লিখিয়ে নিয়েছি, লিখতে উৎসাহিত করেছি।
কারণ আমি জাকী ভাইয়ের লেখার একজন মুগ্ধ পাঠক। আমার ধারণা, জাকী ভাই শুধু যদি লিখতেন, তাহলে তার সক্ষমতার অন্য আরেক পরিচয় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখতাম। এও এক আশ্চর্য ব্যাপার বটে, বহু প্রতিভাবান মানুষ সবচেয়ে বেশি অবহেলা করেন নিজেকেই। জাকী ভাইও বিভিন্নভাবে তা করেছেন।
৩.
পঞ্চাশ বছর আগে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির হাল অত্যন্ত বাজে অবস্থায় ছিল। চলচ্চিত্র যে অত্যন্ত সিরিয়াস একটি মিডিয়াম—এই কথাটি আমাদের কর্তৃত্ববাদী সরকার ও সরকারের আমলাদের বাইরে খুব অল্প মানুষই জানতো এবং বিশ্বাস করতো। আমাদের দেশে চলচ্চিত্র কেবল কাঁচা টাকার ‘বিনোদন’, অথবা মজা, অথবা ছিল রগরগে উত্তেজনার একটা বিষয় মাত্র।
চিন্তাশীল চলচ্চিত্র এই দেশে প্রায় অসম্ভব ছিল, চলচ্চিত্রের চিন্তাশীল তৎপরতাও প্রায় অসম্ভব ছিল। আজকে আমাদের সমাজে চলচ্চিত্রের যে বহুমুখী গ্রহণযোগ্যতা তার পেছনে এই দেশের বহু মানুষের ষাট বছরের লড়াই আছে, আর সেই লড়াইয়ের নাম—চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর ভূমিকা অন্যতম পুরোধার এবং অভিভাবকের। পঞ্চাশ বছরেরও অধিকাকাল ধরে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী এই দেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে তার প্রাণের সম্পর্ক জারি রেখেছেন। সেই সম্পর্ক ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে আর নবায়িত হবে না। কিন্তু এই যে তার পঞ্চাশ বছরের চলচ্চিত্র সংস্কৃতি বিকাশের যাত্রা, এই যাত্রায় তিনি এবং তারা কী অবদান রাখলেন?
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। দেশের বহু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রকে ‘পড়ানো’ হচ্ছে, এটা তাদের এবং আন্দোলনের অবদান। দেশে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৭৩ সালেই পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছেন বাদল রহমান এবং সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী। যদি সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী এবং বাদল রহমান পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউটে পড়তে না যেতেন তাহলে হয়তো আমাদের দেশে আজও ফিল্ম আর্কাইভের প্রতিষ্ঠাই হতো না। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে হাজির ছিলেন সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী।
আরও পড়ুন
আলমগীর কবির, বাদল রহমান এবং সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী হলেন স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এমন তিনজন চলচ্চিত্রকার, যারা ইন্ডাস্ট্রির ভেতরেও ছিলেন সরব, আবার ইন্ডাস্ট্রির বাইরেও ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। ইন্ডাস্ট্রির থাবা তাদের নষ্ট করতে পারেনি।
তারা তিনজন দীর্ঘ সময়জুড়ে চলচ্চিত্র আন্দোলনে যুক্ত তরুণদের এমনভাবে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তাদের ছাত্ররাই পরবর্তীতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গতিমুখ বদলে দিতে সফল হয়েছেন। এই তিনজনই দেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী চলচ্চিত্র সংসদসমূহের ফেডারেটিভ বডি ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন।
৪.
সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী ‘ঘুড্ডি’ ছাড়াও নির্মাণ করেছেন আরও দুটি চলচ্চিত্র। ‘আয়না বিবির পালা’ এবং ‘লাল বেনারসি’। শেষের ছবি দুটি নিয়ে তিনি নিজেই অসন্তুষ্ট ছিলেন। সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর সক্ষমতার ছাপ ‘ঘুড্ডি’তেই আমরা পায়। ‘ঘুড্ডি’ দেখার পর অপর চলচ্চিত্র দুটি দেখলে হতাশ হতে হয়।
এই কারণে আমি মনে করি জাকী ভাইয়ের অপর ছবি দুটি না দেখলেও কারও কোনো কিছু মিস হবে না। এক ‘ঘুড্ডি’ই একজন সালাউদ্দিন জাকীকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু একজন সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর গুরুত্ব কি কেবল ‘ঘুড্ডি’র নির্মাতা হিসেবেই? অথবা, একজন সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীকে আমরা আজ বিচার করতে বসে কেবল কি তার ‘চলচ্চিত্রকার’ পরিচয়কেই মুখ্য করে রাখবো?
আমি মনে করি, আমাদের এই শিশুরাষ্ট্রের জন্ম ও বিকাশপর্বে অনন্য মানুষেরা একটি দেশ শুধু নয়, একটি জাতি গঠনের দায়ভার গ্রহণ করেছিলেন। তাদের জীবনে তাই ব্যক্তিগত সাফল্য ততটা মাইনে রাখেনি, যতটা রেখেছে সামাজিক ও সামষ্টিক সাফল্যের মাইনে।
একজন সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী অথবা বাদল রহমান অথবা আলমগীর কবির নির্মাতা হিসেবে যতটা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের দাবি রাখেন, তারচেয়ে অধিক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন হওয়া উচিত তাদের চিন্তাশীল তৎপর জীবনের সামষ্টিক ইমপ্যাক্ট নিয়ে। আর সেই মূল্যায়ন আমাদের সময় ও সমাজ, এমনকি রাষ্ট্র এখনো করে উঠতে পারেনি।
৫.
বিগত বছরগুলোয় আমি চলচ্চিত্রে আগ্রহী বহু বহু তরুণদের বিভিন্ন কর্মশালা, কোর্স, পাঠচক্র, মাস্টারক্লাসে একত্রিত করে জাকী ভাইকে জোর করে হলেও হাজির করতাম এই তরুণদের সামনে। জাকী ভাই অনেক সময় বলতেন, কী পড়াবো? আমি বলতাম, কিচ্ছু পড়াতে হবে না। আপনি শুধু আপনার গল্প করবেন। চলচ্চিত্রের খুঁটিনাটির তথ্য তো সহজেই পেয়ে যাবে বিভিন্ন সোর্স থেকে, কিন্তু আপনার উপস্থিতি আর আপনার গল্প থেকে ওরা যে শক্তি-সাহস ও স্বপ্ন পাবে তা কোনো বইয়ে পাবে না। জাকী ভাই হেসে বলতেন, ok captain!
৬.
প্রায় ১৪ বছরে জাকী ভাইয়ের সাথে স্মৃতির কোনো সীমা পরিসীমা নেই। কারণ এই ১৪ বছর জাকী ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ, সম্পর্ক, কাজ এত সক্রিয়তার মধ্যে ছিল যে তা আমার নিজের জীবনের জন্য এক অমূল্য অভিজ্ঞান হয়ে থাকবে।
এই পরিসরে শোকের ভার খুব বেশি, তাই লিখবার ফুরসত কম। জাকী ভাইকে নিয়ে লেখার বহু কিছু আছে, লিখতে হবে। আজ এই লেখাটি শেষ করার আগে আর মাত্র দুটি কথা বলবো।
আরও পড়ুন
জাকী ভাই প্রায়ই বলতেন, আমলাদের আমলে নেবে না। কারণ তাদের কাজই হলো বাধাদান। সহযোগিতা করা তাদের কাজ নয়। তিনি বলতেন, চলচ্চিত্রাচার্য আলমগীর কবির তাকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে সচিবালয়ে আমলাদের কক্ষে ঢুকতে হয়। আর তা হলো আমলাদের কক্ষে ঢুকতে হয় হাত দিয়ে দরজা খুলে নয়, ডান কাঁধে দরজায় ধাক্কা দিয়ে আমলার কক্ষে ঢুকতে হয়। বলতেন, শিল্পীকে কারও সামনে হাত কচলাতে হয় না।
ষাটের দশকের তুখোড় লিটলম্যাগ সম্পাদক, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সমর্থনে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে দেওয়া, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফিল্ম সোসাইটি ‘সিনে আর্ট সার্কেল’ প্রতিষ্ঠা এবং ঢাকা থিয়েটার-এর জন্মে নেতৃত্ব প্রদানসহ বহুবিধ উদ্যোগে তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
এইসব জাকী ভাই বলতেন। আর বলতেন নিজেরই আমলা হয়ে দীর্ঘসময় এফডিসি, বিটিভির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনের নামে নিজের ‘সময়’ অপচয়ের কথা। তার সৃজনশীল সামর্থ্যের যে খুব সামান্যই তিনি কাজে লাগাতে পেরেছেন তা তিনি অনুভব করতেন। তা নিয়ে আফসোস করতেন।
আমলাগিরির চাকরির মোহ ত্যাগ করতে না পারাতে তিনি যে নিজের কাছে নিজে পরাজিত হয়েছেন তা বেশ স্পষ্টভাবেই স্বীকার করতেন। এও এক বিরল ব্যাপারই বটে। কারণ তার চাকরিগুলো সবই ছিল উচ্চপদের। কিন্তু তিনি এই উচ্চপদগুলো কখনো তার সৃজনশীল আকাঙ্ক্ষার ওপরে স্থান দেননি।
জাকী ভাইয়ের মা ছিলেন একজন কবি ও চিত্রশিল্পী। বাবা ছিলেন অধ্যাপক। সেই পিতা-মাতার সন্তান সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, যিনি তার শিক্ষাজীবনে কখনো প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হননি। পাণ্ডিত্য, ব্যক্তিত্ব ও রুচিতে যিনি নিজের সময়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল মানুষ। সেই মানুষটির প্রয়াণে এই দেশ, এই শহর এবং আমরা তো শূন্য হলামই। আর সেই শূন্যতা কেবল হারানোতেই সীমিত নয়। জাকী ভাইয়ের প্রয়াণে আমার কেবলই মনে হচ্ছে, আমার প্রিয়জনদের মধ্যে থাকা বাদল রহমান, তারেক মাসুদ, আনোয়ার হোসেনের পর জাকী ভাইও চলে গেলেন।
আমার আগামীর নতুন চিন্তা, নতুন চলচ্চিত্র, নতুন লেখা, নতুন বই প্রকাশিত হলে আর কাকেই বা আগ্রহ নিয়ে বলবো, জাকী ভাই একটু দেখুন, শুনুন, পড়ে বলুন না কেমন হলো? এই শহরে এমন মানুষের সংখ্যা অগনিত, যাদের শ্রদ্ধা করি না। তাদের কাছ থেকে পাওয়া উপহারের বর্ষাও ততটা কাম্য নয়, যতটা মহার্ঘ্য ছিল আমার এই প্রিয়জনদের একটি বাহবা, একটি অভিনন্দন অথবা একটি পরামর্শের গুরুত্ব।
জাকী ভাইয়ের প্রয়াণে এই শহর থেকে আশীর্বাদ ও উৎসাহের ছায়া দেওয়ার বিশাল বৃক্ষ হারিয়ে গেল। এই বেদনার ভার, আর এই শূন্যস্থান আমরা কী দিয়ে ভরবো!
বেলায়াত হোসেন মামুন ।। চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও সংগঠক