বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’
ভারতবর্ষের শিক্ষার ইতিহাস বহু প্রাচীন। ব্রিটিশ শাসনামলে এই শিক্ষাব্যবস্থা ইউরোপের ধাঁচে নতুন করে শুরু হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের চিন্তা এই দেশীয় মননে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার জন্যই তারা ভারতবর্ষে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করে। বিষয়টি কিছুটা নেতিবাচক হলেও, সম্পূর্ণ নেতিবাচক নয়। কিছুটা নেতিবাচক এই কারণে যে, এর মাধ্যমে বৈদেশিক সংস্কৃতি এবং চিন্তা চেতনা কিছুটা অনুপ্রবিষ্ট হতে শুরু করে।
১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ গৃহীত হওয়ার পরে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামীণ অঞ্চলে শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেই শিক্ষা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ১৮৫৫ সালের মে মাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে অতিরিক্ত সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি এবং মেদিনীপুর জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
দুই বছরের মধ্যে তিনি প্রায় বিশটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি এসব স্কুলে পড়ানোর জন্য, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি সাধারণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নিজ গ্রামে নিজ খরচে এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
আরও পড়ুন >>> শতাব্দীর পশ্চাতে নজরুল অবলোকন
বাংলা ভাষায় এই আধুনিক পাঠ্যক্রম রচনার কিংবদন্তি পুরুষ হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশ করা। তবে তার রচিত পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে অবিনশ্বর কীর্তি হলো 'বর্ণপরিচয়' (১৮৫১) গ্রন্থটি।
এই গ্রন্থটি প্রকাশের পূর্বে বাংলা ভাষায় শিশুদের প্রথম শিক্ষার কোনো গ্রন্থ বা আদর্শ পাঠ্যপুস্তক ছিল না। বর্ণপরিচয়ের মান এত উন্নত পর্যায়ের যে, গ্রন্থটি আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। ১৯১২ সংবৎ-এর ১ বৈশাখ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের প্রথম প্রকাশের সময়ে প্রথমভাগের বিজ্ঞাপনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেন—
‘বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ প্রচারিত হইল। বহুকাল অবধি, বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় দীর্ঘ ৠকার ও দীর্ঘ ওকারের প্রয়োগ নাই; এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে। আর, সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে, অনুস্বর ও বিসর্গ স্বরবর্ণের মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না; এজন্য, ঐ দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে পঠিত হইয়াছে। আর, চন্দ্রবিন্দুকে ব্যঞ্জন বর্ণস্থলে এক স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া গণনা করা গিয়াছে।
ড, ঢ, য এই তিন ব্যঞ্জনবর্ণ, পদের মধ্যে অথবা পদের অন্তে থাকিলে—ড়, ঢ়, য় হয়; ইহারা অভিন্ন বর্ণ বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। কিন্তু যখন আকার ও উচ্চারণ উভয়ের পরস্পর ভেদ আছে, তখন উহাদিগকে স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া উল্লেখ করাই উচিত; এই নিমিত্ত, উহারাও স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনবর্ণ বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে। ক ও ষ মিলিয়া ক্ষ হয়, সুতরাং উহা সংযুক্ত বর্ণ; এজন্য, অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে।’ (তীর্থপতি দত্ত ২০০২ : ৯৫৯)
আরও পড়ুন >>> প্যারী মোহন আদিত্য : অল্পশ্রুত মহান দেশপ্রেমিকের প্রতিকৃতি
মাত্র বিশ বছরের মধ্যে ১৯৩২ সংবৎ-এর ১ বৈশাখ এই গ্রন্থটির ষষ্ঠীতম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এতেই অনুমান করা যায় যে, গ্রন্থটি কতখানি জনপ্রিয় ছিল। অবশ্য বর্তমানে শিশুপাঠ্যক্রমে অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হলেও বর্ণ পরিচয়ের আবেদন কমেনি। প্রথম ভাগের ষষ্ঠীতম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে বিদ্যাসাগর বলেন—
‘প্রায় সর্ব্বত্র দৃষ্ট হইয়া থাকে, বালকেরা অ, আ, এই দুই বর্ণস্থলে স্বরের অ, স্বরের আ, বলিয়া থাকে। যাহাতে তাহারা, সেরূপ না বলিয়া, কেবল অ, আ, এইরূপ বলে, তদ্রূপ উপদেশ দেওয়া আবশ্যক।
বাংলা ভাষায় এই আধুনিক পাঠ্যক্রম রচনার কিংবদন্তি পুরুষ হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। শিক্ষাক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশ করা।
যে সকল শব্দের অন্ত্য বর্ণে আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ এই সকল স্বরবর্ণের যোগ নাই, উহাদের অধিকাংশ হলন্ত, কতকগুলি অকারান্ত, উচ্চারিত হইয়া থাকে। যথা, হলন্ত—কর, খল, ঘট, জল, পথ, রস, বন ইত্যাদি। অকারান্ত—ছোট, বড়, ভাল, ঘৃত, তৃণ, মৃগ ইত্যাদি। কিন্তু অনেক স্থানেই দেখিতে পাওয়া যায়, এই বৈলক্ষণ্যের অনুসরণ না করিয়া, তাদৃশ শব্দ মাত্রেই অকারান্ত উচ্চারিত হইয়া থাকে। বর্ণযোজনার উদাহরণ স্থলে যে সকল শব্দ প্রযুক্ত হইয়াছে, তন্মধ্যে যেগুলি অকারান্ত উচ্চারিত হয়, উহাদের পার্শ্বদেশে * এইরূপ চিহ্ন যোজিত হইল। যে সকল শব্দে পার্শ্বদেশে তদ্রূপ চিহ্ন নাই, উহারা হলন্ত উচ্চারিত হইবে।
বাঙ্গালা ভাষায় তকারের ত, ৎ এই দ্বিবিধ কলেবর প্রচলিত আছে। দ্বিতীয় কলেবরের নাম খণ্ডতকার। ঈষৎ, জগৎ প্রভৃতি সংস্কৃত শব্দ লিখিবার সময়, খণ্ডত ব্যবহৃত হইয়া থাকে। খণ্ডতকারের স্বরূপ পরিজ্ঞানের নিমিত্ত, বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষার শেষভাগে তকারের দুই কলেবর প্রদর্শিত হইল।’ (তীর্থপতি দত্ত ২০০২ : ৯৬০)
বর্ণপরিচয় গ্রন্থে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের অন্তর্ভুক্ত সব বর্ণের প্রমিতবর্ণ নির্ধারণ করেন। এই কাজটির গভীরতা হয়তো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা উপলব্ধি করতে পারবেন না। কী অসাধ্য কর্ম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর করেছিলেন। একটু বিশদে বললে তা পরিষ্কার হবে।
পূর্বে যেহেতু ছাপাখানায় গ্রন্থ মুদ্রিত হতো না। তাই বঙ্গদেশের সব গ্রন্থই হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিতে সংরক্ষিত হতো। প্রাকৃতিক উপাদানে কাগজ তৈরি করে, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি তৈরি বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। তাই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিগুলো একেকটি মহাসম্পদ হিসেবে পরিগণিত হতো।
একজন মানুষ চাইলেও অসংখ্য গ্রন্থ তৈরি করতে পারতেন না। যেহেতু প্রত্যেকটি গ্রন্থ হাতে লিখতে হতো। একজন সুদক্ষ লিপিকারও একলক্ষ শ্লোকের মহাভারতের মতো গ্রন্থের প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দশ-পনেরোটির বেশি কপি তৈরি করতে পারতেন না।
আরও পড়ুন >>> অস্ত্র ও ছলনার বিরুদ্ধে মানুষে আস্থা রবীন্দ্রনাথের
মধ্যযুগে বাংলায় যেহেতু তুর্কি শাসন ছিল। তখন রাজভাষা ছিল ফার্সি। যেহেতু শাসক বিদেশি, এদেশীয় ভাষা সংস্কৃতির উন্নয়নের বিষয়গুলো নিয়ে তাদের খুব একটা দৃষ্টি ছিল না। পক্ষান্তরে তাদের বৈরী মনোভাবই ছিল সুতীব্র। অবশ্য বৈদেশিক শাসকদের মধ্যে দুই একজন এদেশীয় লেখকদের উৎসাহিত করেছেন। তাদের মধ্যে পরাগল খাঁ অন্যতম।
তখন যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। বঙ্গের সব জনপদের সাথে সব জনপদের যোগাযোগ ছিল না। তাই অ, আ, ক, খ ইত্যাদি বাংলা বর্ণ বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকারের ছিল। সহস্র বছরের বাংলা পাণ্ডুলিপি যদি দেখি, তবে দেখতে পাবো যে, বাংলার বর্তমান প্রায় সব বর্ণগুলো গড়ে প্রায় পনেরো থেকে বিশ প্রকারের ছিল। কয়েকটি বর্ণ ত্রিশ প্রকারের অধিক পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি বাংলা বর্ণের এত রূপ এবং রূপান্তরের মধ্যে প্রমিত নির্ধারণ করাটা অত্যন্ত দুরূহতম কাজ ছিল। সেই দুরূহতম কাজটিই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর করেছিলেন।
অবশ্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পূর্ববর্তী বাংলা বর্ণের প্রমিত এবং স্থায়ী রূপদানে আরেকজন কৃতি বঙ্গ-সন্তানের অবদান রয়েছে, তিনি হলেন পঞ্চানন কর্মকার। তখন যেহেতু প্রেসে অক্ষর খোদাই করে পরবর্তীতে ছাপাখানায় ছাপানো হতো। বঙ্গাক্ষর কাঠের ছাঁচে খোদাইকরণের অগ্রদূত হলেন পঞ্চানন কর্মকার।
তিনি ১৭৯৯ সালে উইলিয়াম কেরির শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেসে অক্ষর খোদাইকর্মে নিযুক্ত হন। একটি পুরাতন প্রেস ও পঞ্চাননকে নিয়ে শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানার পত্তন হয়। এই শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানাটি কালক্রমে এশিয়ার বৃহত্তম অক্ষর নির্মাণ কারখানায় পরিণত হয়।
বর্ণপরিচয় গ্রন্থে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের অন্তর্ভুক্ত সব বর্ণের প্রমিতবর্ণ নির্ধারণ করেন। এই কাজটির গভীরতা হয়তো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা উপলব্ধি করতে পারবেন না। কী অসাধ্য কর্ম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর করেছিলেন। একটু বিশদে বললে তা পরিষ্কার হবে।
পঞ্চাননের তৈরি অক্ষরে কেরির ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ (১৮০১) প্রকাশ করে। ধাতুর ব্লকে ঢালাই করা একই আকৃতির অক্ষরগুলো একাধিক পাতাতে ব্যবহার করা যায় বলে বাংলা ছাপা অক্ষর একটা স্থায়ী রূপ পেয়েছিল। তাছাড়া ১৮০৩ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে উইলিয়াম কেরির সংস্কৃত ব্যাকরণের জন্য এক দেবনাগরী অক্ষরের ছাঁচ তৈরি করেন।
গ্রন্থ মুদ্রণের জন্য ভারতবর্ষে দেবনাগরী অক্ষরের সম্ভবত এটিই প্রথম ছাঁচ। শেষ জীবনে এসে পঞ্চানন কর্মকারের তৈরি বাংলা অক্ষরগুলো আরও সুস্পষ্ট এবং সুন্দরতম হয়ে ওঠে। শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশন তাকে নিয়ে একটি টাইপ-ঢালাইয়ের কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। ১৮০৪ সালে পঞ্চানন কর্মকার মৃত্যুবরণ করেন।
আরও পড়ুন >>> রবীন্দ্র ভাবনায় তারুণ্য
শুধু অক্ষর সংস্কার নয়, বর্ণ পরিচয় গ্রন্থে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শিশুদের উপযোগী করে ব্যাপক নীতিশিক্ষা প্রদান করেছেন। প্রথম ভাগের ১২তম পাঠে পাওয়া যায়—
‘কখনও মিছা কথা কহিও না।
কাহারও সহিত ঝগড়া করিও না।
কাহাকেও গালি দিও না।
ঘরে গিয়া উৎপাত করিও না।
রোদের সময় দৌড়াদৌড়ি করিও না।
পড়িবার সময় গোল করিও না।
সারা দিন খেলা করিও না।’
(তীর্থপতি দত্ত ২০০২: ৯৬৬)
বর্ণ পরিচয়ের প্রথম ভাগের ১৯তম এবং ২০তম পাঠে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গোপাল এবং রাখাল নামক দুটি শিশুর চরিত্র অঙ্কন করেছেন—‘গোপাল বড় সুবোধ। তার বাপ মা যখন যা বলেন, তাই করে। যা পায় তাই খায়, যা পায় তাই পরে, ভাল খাব, ভাল পরিব বলিয়া উৎপাত করে না। গোপাল আপনার ছোট ভাই ভগিনীগুলিকে বড় ভাল বাসে। সে কখনও তাদের সহিত ঝগড়া করে না, তাদের গায়ে হাত তুলে না। এ কারণে, তার পিতা মাতা তাকে অতিশয় ভালবাসে।
গোপাল যখন পড়িতে যায়, পথে খেলা করে না; সকলের আগে পাঠশালায় যায়; পাঠশালায় গিয়া, আপনার জায়গায় বসে; আপনার জায়গায় বসিয়া, বই খুলিয়া পড়িতে থাকে; যখন গুরু মহাশয় নূতন পড়া দেন, মন দিয়া শোনে।
খেলিবার ছুটি হইলে, যখন সকল বালক খেলিতে থাকে, গোপালও খেলা করে। আর বালকেরা, খেলিবার সময়, ঝগড়া করে, মারামারি করে। গোপাল তেমন নয়। সে এক দিনও, কাহারও সহিত, ঝগড়া বা মারামারি করে না।... গোপাল কখনও লেখা পড়ায় অবহেলা করে না। সে পাঠশালায় যাহা পড়িয়া আইসে, বাড়ীতে তাহা ভাল করিয়া পড়ে; পুরাণ পড়াগুলি দু’বেলা আগাগোড়া দেখে। পড়া বলিবার সময়, সে সকলের চেয়ে ভাল বলিতে পারে। গোপালকে যে দেখে, সেই ভালবাসে। সকল বালকেরই গোপালের মত হওয়া উচিত।’ (তীর্থপতি দত্ত ২০০২ : ৯৬৭-৯৬৮)
আরও পড়ুন >>> সত্যেন সেন : মেহনতি মানুষের মুক্তিসংগ্রামের তূর্যবাদক
আদর্শবালক গোপালের সাথে সাথে আরেকটি দুষ্ট এবং পড়াশোনায় মনোযোগী বালকের চিত্র অঙ্কন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর—‘গোপাল যেমন সুবোধ, রাখাল তেমন নয়। সে বাপ মার কথা শুনে না; যা খুশি তাই করে; সারা দিন উৎপাত করে; ছোট ভাই ভগিনীগুলির সহিত ঝগড়া ও মারামারি করে। এ কারণে, তার পিতা মাতা তাকে দেখিতে পারেন না।
রাখাল, পড়িতে যাইবার সময়, পথে খেলা করে; মিছিমিছি দেরি করিয়া, সকলের শেষে পাঠশালায় যায়। আর আর বালকেরা পাঠশালায় গিয়া পড়িতে বসে। রাখালও দেখাদেখি বইখুলিয়া বসে। বই খুলিয়া হাতে করিয়া থাকে, এক বারও পড়ে না।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পূর্ববর্তী বাংলা বর্ণের প্রমিত এবং স্থায়ী রূপদানে আরেকজন কৃতি বঙ্গ-সন্তানের অবদান রয়েছে, তিনি হলেন পঞ্চানন কর্মকার।
লেখা পড়ায় রাখালের বড় অমনোযোগ। সে একদিনও মন দিয়া পড়ে না এবং এক দিনও ভাল পড়া বলিতে পারে না। গুরু মহাশয় যখন নূতন পড়া দেন, সে তাহাতে মন দেয় না, কেবল এদিকে ওদিকে চাহিয়া থাকে।
খেলিবার ছুটী হইলে, রাখাল বড় খুসী। খেলিতে পাইলে সে আর কিছুই চায় না। খেলিবার সময়, সে সকলের সহিত ঝগড়া ও মারামারি করে; এ কারণে, গুরু মহাশয় তাহাকে সতত গালাগালি দেন।
...রাখালকে কেহ ভালবাসে না। কোন বালকেরই রাখালের মত হওয়া উচিত নয়। যে রাখালের মত হইবে, সে লেখা পড়া শিখিতে পারিবে না।’ (তীর্থপতি দত্ত ২০০২ : ৯৬৮)
তবে দুষ্ট বালক রাখাল চরিত্রটি কারও পছন্দের বা অনুসরণীয় না হলেও, এ চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত পছন্দের ছিল। তিনি তার ‘চারিত্রপূজা’ গ্রন্থের ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ প্রবন্ধে সুবোধ বালক গোপাল এবং দুষ্ট বালক রাখাল বর্ণ পরিচয়ের এই চরিত্রদ্বয় পর্যালোচনা করেছেন।
আরও পড়ুন >>> ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস
সেই পর্যালোচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাখাল নামক চরিত্রটির প্রতি দুর্বলতা বেশি প্রকাশ পেয়েছে। তিনি রাখাল চরিত্রটির সাথে বাল্যকালের শ্রীচৈতন্যদেব এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দুরন্তপনা সমন্বয় করেছেন। তিনি বলেছেন—‘নিরীহ বাংলাদেশে গোপালের মতো সুবোধ ছেলের অভাব নাই। এই ক্ষীণতেজ দেশে রাখাল এবং তাহার জীবনীলেখক ঈশ্বরচন্দ্রের মতো দুর্দান্ত ছেলের প্রাদুর্ভাব হইলে বাঙালিজাতির শীর্ণচরিত্রের অপবাদ ঘুচিয়া যাইতে পারে।
সুবোধ ছেলেগুলি পাস করিয়া ভালো চাকরি-বাকরি ও বিবাহকালে প্রচুর পণ লাভ করে সন্দেহ নাই, কিন্তু দুষ্ট অবাধ্য অশান্ত ছেলেগুলির কাছে স্বদেশের জন্য অনেক আশা করা যায়। বহুকাল পূর্বে একদা নবদ্বীপের শচীমাতার এক প্রবল দুরন্ত ছেলে এই আশা পূর্ণ করিয়াছিলেন।’
তথ্যঋণ : ১. তীর্থপতি দত্ত (সম্পাদিত), বিদ্যাসাগর রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড), তুলি-কলম, কলকাতা : মার্চ ২০০২
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়