সন্তানদের কেন প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামাতে হবে?
সন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা প্রত্যেক অভিভাবকের দায়িত্ব। সে যদি ভালো মানসিকতার মানুষ হয়, ভালো চিন্তা করতে পারে এবং তার নিজের সম্পর্কে ভালো ধারণা অর্জন করতে পারে, তখন অভিভাবক হিসেবে আপনি সফল।
সন্তানকে পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় করা, এটা সফলতার মাপকাঠি নয়। এর কারণ, পরীক্ষা দিলে কেউ-না-কেউ প্রথম অথবা দ্বিতীয় হবেই—তা নিয়ে এত হইচই করার কিছু নেই। আজকে যে প্রথম বা দ্বিতীয়, দশ বছর পর হয়তো কোনো র্যাঙ্কিংয়ে তাকে দেখা যাবে না। দশ বছর পর গিয়ে হয়তো তাকে কেউ চিনবেই না, সে হারিয়েও যেতে পারে।
অভিভাবক হিসেবে সন্তানকে আপনি যে শিক্ষা বা গাইডলাইন দিচ্ছেন, তা ভালো হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। যে প্রক্রিয়ায় আপনি সন্তানদের শেখাচ্ছেন, যদি সন্তান সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, তবে আপনাকে ধরে নিতে হবে, আপনি ভুল পথে হাঁটছেন বা তার উপযোগী শিক্ষা বা গাইডলাইন দিতে পারছেন না।
আরও পড়ুন >>> শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত?
আপনি হয়তো রেগে গিয়ে তাকে বকাঝকা করছেন, তার ওপর দোষ চাপাচ্ছেন; সে ছোট, তাই আপনাকে বলতে পারছে না বা তার অনুভূতি সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারছে না। অভিভাবক হিসেবে, আমাদের সন্তানের জায়গায় গিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে হবে।
একজন শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, তার বেসিকটা কতটা শক্ত, সেইদিকে নজর দেওয়া। সে কতটুকু জানে, পরিস্থিতির সাথে সে কতটুকু নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, তা অধিক জরুরি। তার মানসিক পরিপক্বতা কতটুকু, তাও গুরুত্বপূর্ণ। সে কতটা সিদ্ধান্ত নিয়ে পারে বা দিতে পারে, সে কতটা অ্যানালিটিক্যালি ভাবতে পারে, তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
একজন শিক্ষার্থীর প্রধান কাজ পড়াশোনা, কিন্তু একমাত্র কাজ পড়াশোনা নয়, আরও অনেকগুলো বিষয় থাকে। আপনার সন্তান ক্লাসে প্রথম, কিন্তু কারও সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না, সে সামাজিক নয়; এটা নিশ্চয় কাম্য নয়।
আমি অনেক প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীদের চিনি, যারা পড়াশোনার বাইরে আর কিছুই জানে না! কারও সাথে স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারে না, কোনো সৃজনশীল কাজে যুক্ত নেই, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত নেই, বইয়ের বাইরে তেমন কোনো আউট নলেজ নেই, বেসিকটাও তেমন শক্ত নয়। সে শুধু ততটুকুই জানে, যা তার প্রথম হওয়ার জন্য জরুরি। আপনার সন্তানকে সেই প্রক্রিয়ায় গড়ে তুলবেন না। আপনি তাকে প্রয়োজনীয় সবদিক দিয়ে পরিপূর্ণ করার চেষ্টা করুন।
সে এখন হয়তো প্রথম বা দ্বিতীয় হতে পারছে না, কিন্তু তার ভেতরে একাগ্রতা থাকলে সেও নিশ্চয়ই ভালো জায়গায় যেতে পারবে। আজ থেকে দশ বছর, পনেরো বছর, বিশ বছর পরে সে কোথায়, কোন অবস্থানে থাকবে, সেটাই মূলত বিবেচ্য। সেইখানে পৌঁছাতে হলে তাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে, তার মানসিক পরিপক্বতা থাকতে হবে, বেসিকটা দৃঢ় করতে হবে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে, শারীরিক সক্ষমতা লাগবে, আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে।
আপনি আপনার সন্তানকে যদি সবসময়ই বকাঝকা করেন, মূর্খ বলেন, গাধা বলেন, তাহলে কিন্তু তার আত্মবিশ্বাস কমতে থাকবে। যে মানুষটার আত্মবিশ্বাস কম, সে জীবনে কখনো ভালো কিছু করতে পারে না। So confidence is sometimes more important than knowledge—হ্যাঁ, জ্ঞান থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো আত্মবিশ্বাস।
আরও পড়ুন >>> শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার প্রধান উৎস হচ্ছেন আপনি, আপনারা মানে সন্তানের অভিভাবক। এই জায়গায় আপনি স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করুন। সে কোথায় যাবে কোথায় যাবে না, তার ভবিষ্যৎ কেমন হবে কেমন হবে না, তা নিয়ে ভাবুন। সে আজকে প্রথম হলো, না দ্বিতীয় হলো, তার গুরুত্ব থাকলেও তা জীবনের সবকিছু নয়।
আপনি দেখুন, আপনার সন্তান কি ফ্রিহ্যান্ড-রাইটিং পারে! আপনি দেখুন, আপনার সন্তান সঠিক গ্রামারে লিখতে পারে কি না, সঠিক স্পেলিংয়ে লিখতে পারে কি না, অঙ্কে ভালো কি না, বিজ্ঞানে ভালো কি না, তার উপস্থিত বুদ্ধি আছে কি না।
সন্তানকে প্রথম বা দ্বিতীয় করা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তাকে ভালো, যোগ্য, যথার্থ ও মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা...
আমি তো মনে করি, স্কুলে প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়ার চেয়ে সাঁতার শেখা গুরুত্বপূর্ণ, শারীরিক ফিটনেস ঠিক রাখা গুরুত্বপূর্ণ; কেননা এসবও একজন মানুষের খুব জরুরি দিক। পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে প্রাসঙ্গিক সব বিষয়েই কিছু-না-কিছু জ্ঞান থাকতে হয়। শুধুই প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়াটা কোনো ফিটনেসের মধ্যেই পড়ে না। প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া জীবনের বিবিধ বিবেচনায় খুবই তুচ্ছ একটা বিষয়, যা কেবল পড়াশোনা করলেই হয়।
একজন শিক্ষার্থীর প্রধান কাজ পড়াশোনা, কিন্তু একমাত্র কাজ পড়াশোনা নয়, আরও অনেকগুলো বিষয় থাকে। আপনার সন্তান ক্লাসে প্রথম, কিন্তু কারও সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না, সে সামাজিক নয়; এটা নিশ্চয় কাম্য নয়।
আরও পড়ুন >>> সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা : চেতনা জাগুক মনে
সে বড় হয়ে অনেক সুযোগ হারাবে, যেগুলো তার শেখা দরকার। আপনি তাকে তাই শেখান। শেখানোর পর সে যদি প্রথম বা দ্বিতীয় হতে পারে, তার যদি ওই পর্যায়ের জ্ঞান থাকে, তবে তা খুবই ভালো। যদি তা নিশ্চিত করতে না পারেন, তাহলে দেখবেন, সন্তান শুধুই প্রথম বা দ্বিতীয় হলো, একইসাথে অন্যদিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ল। এর কোনো মূল্য নেই। এই বিষয়গুলো মাথায় রাখলে অভিভাবক হিসেবে আপনি প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন।
সন্তানকে প্রথম বা দ্বিতীয় করা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তাকে ভালো, যোগ্য, যথার্থ ও মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। তার জ্ঞান সবদিকে থেকে ডেভেলপ করা, শুধু একদিকে নয়। এটা যদি আমরা করতে পারি, তাহলে আমরা ভালো জাতি বা উন্নত জাতি উপহার পাবো। মেধাবী পশু কিন্তু দিনশেষে পশুই থেকে যায়। প্রবল মেধাবী, খারাপ মানুষ হওয়ার চেয়ে অল্প মেধাবী ভালো মানুষ হওয়াই জরুরি। এটাই আমি মনে করি।
সুশান্ত পাল ।। উপ-কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টমস