আইসিইউতে যখন আমাদের সিনেমা
সিনেমা কী? কাকে বলে? খুব ছোটবেলায় এই প্রশ্নের উত্তর কখনো খুঁজতে যাইনি, হয়তো প্রয়োজন পড়েনি, ছোটবেলার স্মৃতিতে আছে দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই (The Bridge on the River Kwai, 1957) দেখতে গেছিলাম মধুমিতা সিনেমা হলে।
তাছাড়া স্কুল জীবনে এক টিকেটে দুই ছবি প্রতিদিন দেখতাম ছন্দ সিনেমা হলে। ভালোই লাগত, প্রথম সিনেমা হতো অ্যাকশন আর পরেরটা প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য নির্মিত যৌন বাণিজ্যতা, যদিও সেই বয়সে পরের সিনেমাটাই দেখতে বেশি ভালো লাগতো।
পরবর্তীতে ভিডিও হোম স্টিস্টেম বা Video Home System-VHS-এ সিনেমা দেখার চর্চাই ছিল স্কুল জীবনে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা। আমাদের বাবা-মা তখন হিন্দি আর বাংলা সিনেমা বেশি দেখতো, সেই সুবাদে সেই সময় উত্তম-সুচিত্রার বাংলা সিনেমা, অমিতাভ বচ্চন-রেখা আর নাসিরউদ্দিন-স্মিতা পাতিলের সিনেমা দেখার চর্চাই বেশি হতো।
আরও পড়ুন >>> সিনেমা হোক দখিনা হাওয়ায় দুরন্ত পালতোলা নাও
এইসব সিনেমা দেখার ফলে সেই বয়সে সম্পর্কের গল্প, বাম রাজনৈতিক চিন্তারও এক ধরনের প্রতিফলন পেতাম, পরবর্তীতে সত্যজিৎ রায়-মৃণাল সেন-বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সিনেমা সেই বয়সে চলচ্চিত্রের বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে। নিউ লিবারেল ইকোনমির উদ্বোধন বাংলাদেশে বিদেশি সিনেমার (বিশেষ করে ভারতীয় সিনেমার জোয়ার মূলত MTV/Channel V আর জিটিভি-এর মাধ্যমে) এক প্রকার সাংস্কৃতিক আধিপত্য করার দ্বার খুলে দেয়।
যেকোনো রাষ্ট্রে জাতীয় সিনেমা বলতে হয়তো সেই দেশের নিজস্ব চলচ্চিত্র ধারাকেই বোঝায়। যেখানে সেই সিনেমার সাথে সেই দেশের মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয় যা অনেকটা আয়নার মতো কাজ করে।
এসব চ্যানেলে সিনেমার গান, অনুষ্ঠান এবং ‘স্টার/সেলেব্রিটি’দের লাইফ স্টাইল প্রচার শুরু করে যা আমাদের সিনেমার কৃষ্টির বাইরে একটা নতুন কালচারাল ন্যারেটিভ হাজির করে, যা আমাদের জীবনযাত্রা, সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষায় আর সমাজ বাস্তবতায় নতুন মাত্রা তৈরি করে।
এই আকাঙ্ক্ষার সাথে আমাদের প্রতিদিনের জীবনের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা, সম্পর্ক সবকিছু প্রভাবিত হয়। তাই সিনেমা এখন আর অন্ধকার ঘরে বসে দেখে আসা অভিজ্ঞতার কথা বলে না। সিনেমা এখন আপনি বিয়ের অনুষ্ঠানে কী কাপড় পরবেন, কোন গানে নাচবেন, সব্যসাচীর ডিজাইনের কাপড় কিনতে কলকাতায় কবে যাবেন, কিংবা ওয়েডিং ফটোশুট করতে কোন দৃষ্টি নন্দন লোকেশনে যাবেন… তাও নির্ধারণ করে দেয়।
দেশভাগের আগে এই মাটিতে সিনেমার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা দেখতে পাইনি, পরবর্তীতে চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরশেনের মাধ্যমে বলা যায় আমাদের দেশে সিনেমার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। কিন্তু সেই সময় বাংলা আর উর্দু এই দুই ভাষার সিনেমাকে আমরা আমাদের জাতিগত সিনেমা বলতে পারতাম। তাই জহির রায়হানের ‘কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩)’ যেমন ‘আমাদের সিনেমা’ ঠিক একইভাবে আবার উর্দু সিনেমাও ‘আমাদের সিনেমা’।
আরও পড়ুন >>> চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী?
স্বাধীনতার পর পর ‘আমাদের সিনেমা’ সাবালাক হওয়ার আগেই নিউ লিবারেল ইকোনমির চাপে এই দেশে ইংরেজি গান আর সিনেমার আবির্ভাব হয়। ইংরেজি গানের জনপ্রিয়তায় আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীতের যে চর্চা ছিল তার আগে ‘আমাদের সিনেমা’য় বিশ্ব চলচ্চিত্রের চর্চা ছিল না বললেই চলে।
সেই সময় আমাদের শহরগুলোয় বিশ্ব চলচ্চিত্র বলতে ফিল্ম সোসাইটির সিনেমায় বোঝা যেত। সেই সুবিধা আমাদের মূলধারার সিনেমাতে বিচ্ছিন্নভাবে একটা ‘সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৭৯)’ কিংবা পরবর্তীতে ‘মাটির ময়না (২০০২)’ হাজির ছিল। মূলধারা আর বিকল্প ধারা আমি সামাজিক বিচারে কখনো আলাদা করে দেখি না। বরং আমি ‘আমাদের সিনেমা’ আর ‘তাদের সিনেমা’ হিসেবে দেখি।
যেকোনো রাষ্ট্রে জাতীয় সিনেমা বলতে হয়তো সেই দেশের নিজস্ব চলচ্চিত্র ধারাকেই বোঝায়। যেখানে সেই সিনেমার সাথে সেই দেশের মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয় যা অনেকটা আয়নার মতো কাজ করে। এই প্রতিফলন কিন্তু সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত সিনেমাতেও হতে পারে যেমন—‘বেদের মেয়ে জোস্না (১৯৮৯)’।
বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্রের অবস্থা, যা অনেকদিন যাবৎ বলা যায় একদম আইসিইউতে আছে। ডিজিটাল টেকনোলজির এই সময়ে চলচ্চিত্রের সনাতনী সব কারখানা অচল হওয়ার পর, নতুন ধারার নির্মাতাদের বিকাশ দেখা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা না পাওয়ায় বিকশিত হতে পারছে না।
তার মাঝে বিদেশি সিনেমা অর্থাৎ ওটিটির মাধ্যমে আসা ‘তাদের সিনেমা’-এর প্রভাব তো থাকেই। এই সময় ‘তাদের সিনেমা’ বলতে আসলে আমরা বুঝি হিন্দি, ইংরেজি, কোরিয়ান বা ইউরোপিয়ান সিনেমাকে। এইসব সিনেমা যখন আমরা দেখি তখন কিন্তু সিনেমা দেখার উদযাপন করতে পারি না কারণ সেই সব আমরা ছোট পর্দাতেই বেশিরভাগ সময় দেখি। মার্ভেল চলচ্চিত্র বা কিছু হলিউড চলচ্চিত্র আমরা উদযাপন করলেও জাতীয়ভাবে সেইসব সিনেমা এখনো উদযাপিত হয় না বলেই আমার মনে হয়।
বলিউড সিনেমা অনেক আগেই সিনেমার ন্যারেটিভ থেকে বের হয়ে একটা অলীক জীবন সংস্কৃতি উপস্থাপন করে, যা আমাদের চকচকে জীবনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। আধুনিক সিনেমার কারখানার সব উপাত্ত নিয়ে একদল দক্ষ সিনেমাকর্মী দ্বারা যখন একটা ‘জাওয়ান’ আর ‘পাঠান’ নির্মাণ করে তখন সেইখানে সিনেমার চকচক ইমেজ আর সাউন্ডের খেলা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। এইসব ‘তাদের সিনেমা’ যখন আমাদের দেশের সিনেমা হলে উদযাপিত হবে তখন কিন্তু সেই সিনেমা আর তাদের থাকবে না, হয়ে যাবে ‘আমাদের সিনেমা’।
আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৪৭-১৯৭৫) শিল্পের স্বকীয়তা
ভারতে প্রতি বছর শত শত সিনেমা মুক্তি পায়, কিন্তু আমাদের দেশে সব সিনেমা আসবে না বা সিনেমা হলে দেখানো হবে না। ভারতের সৃজনশীল সিনেমা ‘কোর্ট’ বা ‘নিউটন’ এইদেশের সিনেমা হলে না এসে আসতে থাকবে বলিউডের সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত সিনেমা যা সিনেমার ন্যারেটিভের বাইরের ন্যারেটিভ নিয়ে হাজির হবে।
অন্ধকার ঘরে সিনেমা দেখা জেলখানার মতো, যেখানে টিকেট কেটে আপনি এমন এক অভিজ্ঞতা উপভোগ করেন যা আপনার প্রতিদিনের জীবনে আপনার অজান্তে তার চর্চা দেখা যাবে বা তার প্রভাব পড়বে।
হলিউড সিনেমার জীবন অভিজ্ঞতা আমাদের অনুধাবন করা যত কঠিন তার চেয়ে অনেক সহজ বলিউড সিনেমার জীবন চর্চা করা। আমাদের ভাই-বোনদের বিয়ে, গায়ে হলুদ, অনুষ্ঠানের চেহারা দেখলে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না।
বলিউড সিনেমা অনেক আগেই সিনেমার ন্যারেটিভ থেকে বের হয়ে একটা অলীক জীবন সংস্কৃতি উপস্থাপন করে, যা আমাদের চকচকে জীবনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে।
স্বাধীনতার সময় জহির রায়হান, আলমগীর কবির এবং পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে সৈয়দ হাসান ইমামের নেতৃত্বে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতির উদ্যোগে একটি ‘চলচ্চিত্র শিল্প জাতীয়করণ নীতিমালা’ শিরোনামে একটা নীতিমালা তৈরি করা হয়। এই প্রসঙ্গে আলমগীর কবির বলেছিলেন, ‘অশিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত প্রযোজকদের হাত থেকে সিনেমা শিল্পকে মুক্ত করে তখন সমাজতন্ত্রীকরণের পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। ভেজাল ও অপদার্থ জিনিসের অনুপ্রবেশ যাতে না ঘটে তারই জন্য এই চেষ্টা। এই পরিকল্পনায় ছিল সিনেমা করা, বণ্টন ও প্রদর্শন জাতীয়করণ করা, সিনেমার জন্য একজন মন্ত্রী নিয়োগ ও বিশেজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন করা, যারা বাৎসরিক প্রোডাকশন একই সঙ্গে পুরোনো ও নতুন পরিচালকদের মধ্যে ব্যবস্থা করবেন’—কথাটা এই মূহুর্তের বাজার অর্থনীতির সময় প্রাসঙ্গিক কি না প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু দুনিয়ার যেকোনো নেতা যেমন ভ্লাদিমির লেনিন, জওহরলাল নেহেরু কিংবা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সবাই চলচ্চিত্রকে সমাজ গঠনের হাতিয়ার হিসেবে ভাবলেও, আমাদের দেশে ১৯৭৫ সালের পর কখনো কোনো সরকার সিনেমাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। এমনকি অনুদান নামের প্রহসনের প্রণোদনা দেওয়ার চেষ্টা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এবং খামখেয়ালিপনায় বেশিরভাগ সময় ব্যর্থ হয়েছে।
চলচ্চিত্র কারখানায় অনিয়ম আর অসাধু প্রযোজক আর পরিচালকের দৌরাত্ম্যে কারখানার বাণিজ্যিক বিকাশও হয়নি। এই সময় যেখানে চলচ্চিত্র বিকাশে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন সেইখানে হঠাৎ সরকার সিনেমা হল ব্যবসায় মনোযোগী হয়ে উঠলেন। সিনেমার ন্যারেটিভ তৈরি হয় বিষয়ে, গল্পে আর নির্মাণে তারপর হয় পরিবেশনে।
আরও পড়ুন >>> এখন তাহলে কোন জীবন থেকে নেবেন?
নির্মাণ বৈচিত্র্যে নজর না দিয়ে আমরা যদি হল বাঁচাতে ভারতীয় অন্তঃসারশূন্য সিনেমাকে ‘আমাদের সিনেমা’ হিসেবে হাজির করি তাহলে তা আমাদের জাতি গঠনে কীসের চাপ সৃষ্টি করবে তা মনে হয় আমাদের চলচ্চিত্র কারখানার কর্মীরা বুঝতে পারছে না।
ভারতের সাথে আমাদের যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকুক না কেন, বলিউড সিনেমার সাংস্কৃতিক আধিপত্য মোকাবিলা করতে হলে ‘আমাদের সিনেমা’ সাবালক করে তুলতে হবে। তার জন্য বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণের কাঠামো তৈরি করা থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সুযোগ করে দিতে হবে।
তার বদলে যদি আমরা শুধু ‘পাঠান’ আর ‘জাওয়ান’-এর উৎসবে মেতে উঠি তাহলে আইসিইউতে থাকা ‘আমাদের সিনেমা’কে কিছুদিন লাইফ সাপোর্টে রেখে আসা ভালো। আজ আমাদের স্বাধীন দেশের চলচ্চিত্র যোদ্ধা আলমগীর কবিরের স্বপ্ন দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হলো।
অমিতাভ রেজা চৌধুরী ।। চলচ্চিত্র পরিচালক