জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে যখন বাংলাদেশ
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার জাতীয় তেল কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতান আল জাবেরকে কপ ২৮ সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত করেন। যিনি দুবাইয়ে ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের তত্ত্বাবধান করবেন।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্প স্তরের থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত করার লক্ষ্যে বিশ্বকে কীভাবে অগ্রসর করা যায় তা নিয়ে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে ১৯০টিরও বেশি দেশের রাজনৈতিক নেতারা এই সম্মেলনে একত্রিত হবেন।
তেল, গ্যাস, জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির প্রতিনিধিরা কপ ২৮ বা কোনো ধরনের জলবায়ু সংলাপেরই নেতৃত্বে থাকতে পারেন না। থাকলে তা হবে সাধারণ মানুষের থেকে জলবায়ু অধিকার কেড়ে নেওয়া। আবুধাবি তেল কোম্পানির প্রধানকে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের সভাপতি করে বিশ্বকে এক কঠিন জলবায়ু সংকটে প্রেরণ করল।
আরও পড়ুন >>> বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ কী?
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত রেখে কার্বন নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
তবে সাধারণ মানুষের জলবায়ু অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া বিগত কয়েকটি কপ সম্মেলন থেকেই শুরু হয়েছে। ২০২১ সালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ ২৬ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে ৫০৩ জন জীবাশ্ম জ্বালানি এবং তেল, গ্যাস শিল্পের লবিস্ট ছিলেন।
পরবর্তীতে ২০২২ সালে মিসরে অনুষ্ঠিত কপ ২৭ সম্মেলনেও তেল, গ্যাস কোম্পানির পক্ষ থেকেও প্রায় ৬০০ জনেরও বেশি লবিস্ট বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এভাবেই প্রতিনিয়ত বিশ্বের সব থেকে বড় জলবায়ু সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা এক বিশাল অঙ্কের মুনাফার লোভে সজ্ঞানে সাধারণ মানুষ তথা পৃথিবীর ক্ষতি করছি। এছাড়া তারা দূষণকারী দেশের রাজনীতিকদের প্রভাবিত করছে, জলবায়ু সংক্রান্ত কার্যক্রম ও অগ্রগতিতে বাধা দিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম আরও একটি কারণ প্লাস্টিক। ১৮৫০ সালে প্রথম প্লাস্টিক উদ্ভাবিত হয় তারপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৩০ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক উৎপাদন করেছে মানুষ। এর মাঝে প্রায় ৬৩০ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক পরিণত হয়েছে আবর্জনায়। মাত্র ৯ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়, ১২ শতাংশ পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং প্রায় ৭৮ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে রয়ে যায়।
আরও পড়ুন >>> বিশ্ব পরিবেশ দিবস : আমাদের ব্যর্থতা ও করণীয়
প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাস্টিকের আবর্জনা নদী-নালা, খাল-বিলে গিয়ে সমুদ্রে জমা হচ্ছে। এক রিপোর্টে উঠে এসেছে, এখন পর্যন্ত যত প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে এবং স্থলভাগে রয়েছে, সেই সব বর্জ্য যদি এক জায়গায় জড়ো করা হয় তবে তা সর্বোচ্চ এভারেস্টের থেকেও সুউচ্চ হবে।
পরিবেশের আরেকটি ভয়াবহ রূপ মাইক্রো প্লাস্টিক। মাইক্রো প্লাস্টিক হচ্ছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রতম কণা। এর আকার ৫ মিলিমিটারেরও কম। মাইক্রো প্লাস্টিকের উৎস আমাদের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র। সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্য সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সহায়তায় ভেঙে মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হয় এবং খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে চলে আসে মানব শরীরে।
দক্ষিণ এশিয়ার ৮০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ হটস্পটগুলোয় বসবাস করে, যে অঞ্চলগুলো ২০৫০ সালের মধ্যে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হবে, যদি তীব্র কার্বন নিঃসরণ অব্যাহত থাকে। এই অঞ্চলে আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা জলবায়ু অভিযোজন ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক, প্রযুক্তিগত এবং মানব সম্পদের আরও দক্ষ এবং কার্যকর ব্যবহার করার পরিস্থিতিতে ত্বরান্বিত করতে পারে।
একজন জলবায়ুকর্মী হিসেবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভয়ংকর তীব্র তাপদাহ অনুভব করেছি। যা এর আগে কখনো অনুভব করিনি। আমি দেখেছি এই তীব্র গরমে অসহ্যকর পরিস্থিতিতে পড়া মানুষ এবং পশুপাখিদের, দেখেছি তীব্র খরা যার অন্যতম কারণে তীব্র তাপদাহ। যা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।
বাংলাদেশও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বেশ বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশে একাধারে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদি সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও অনেক বেশি। তাই উল্লিখিত পাঁচটি মানদণ্ডেই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় শীর্ষে।
আরও পড়ুন >>> আধিপত্য নয়, বন্ধুত্ব করি প্রকৃতির সঙ্গে
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ-এর ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এই সমীক্ষা চালানো হয় ১৯৯০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৯৩টি দেশের ওপর। উল্লেখ্য, উক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত ২০০৭ এবং ২০০৮ সালের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমরা তখনই সফল হতে পারবো যখন বিশ্বনেতারা এর মর্ম বুঝতে পারবেন এবং প্রত্যেকটি উন্নয়নশীল দেশে সবুজ অর্থনীতি বাস্তবায়ন করবেন। বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে, দেশে পেট্রোল চালিত যানবাহনের ব্যবহার কমিয়ে, সাইকেল এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে, প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করাও হতে পারে আরও একটি বড় পদক্ষেপ।
শুধু জলবায়ু কর্মীরাই নয়, এই জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এগিয়ে আসতে হবে সকলকে। মানবজাতির এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত যাতে করে বিশুদ্ধ পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব হয় যার ফলে যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুস্থভাবে বসবাস করতে পারে।
সুদীপ্ত চন্দ রায় ।। জলবায়ুকর্মী এবং অ্যামাজনে প্রকাশিত বই ‘দ্য গ্রেট পলিটিক্যাল লিডারশিপ’-এর লেখক