এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যেভাবে যানজট কমাবে
ফ্লাইওভার বনাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
ভূমি বা সমতলের রাস্তায় যান চলাচলের যুগ থেকে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সড়কের ওপরে আরেকটি রাস্তা তৈরি করে যান চলাচলের সূচনা হয় ২০০৪ সালে মহাখালী ফ্লাইওভারের মাধ্যমে। এরপর আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে আধুনিকায়ন হতে থাকে আর আমরা ২০২২ সালে মেট্ররেলের সূচনা করে, রাস্তার ওপর রেল চলাচলেরও সূচনা করেছি।
এরই ধারাবাহিকতায় ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যুক্ত হলো যা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নামে পরিচিত। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সাথে ফ্লাইওভারের একটি পার্থক্য রয়েছে তা হলো, ফ্লাইওভার কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থান বিশেষ করে রাস্তার সংযোগস্থল বা লেভেল ক্রসিং-এর ওপর নির্মাণ করা হয় যাতে করে ঐ নির্দিষ্ট স্থানকে ওপর দিয়ে অতিক্রম করা যায়। এর দৈর্ঘ্য সাধারণত কম হয়।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হলো, রাস্তার ওপর নির্মিত আরেকটি রাস্তা যা শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্য আরেকপ্রান্তকে সংযোগ করে। এর দৈর্ঘ্য অনেক বেশি হয়। যেমন নিকটবর্তী দেশ থাইল্যান্ডের ‘Bang Na Expressway’-এর দৈর্ঘ্য ৫৫ কিমি। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ইত্যাদি দেশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে অনেক আগেই।
আরও পড়ুন >>> আলমডাঙ্গা মহাসড়কের একদিন
বিভিন্ন দেশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
পৃথিবীর সব দেশ কয়েকটি লক্ষ্য নিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসয়ের মতো একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেয়, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো যানজট কমানো। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পেছনেও অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো যানজট কমানো। যদিও এর একপ্রান্ত (হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর) থেকে অন্য প্রান্ত (কুতুবখালি, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক) পর্যন্ত ১২.৭৩ কিলোমিটার কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকা শহরের যানজট ও যানবাহনের কথা বিবেচনা করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে এগারো কিলোমিটার যাতায়াতের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কীভাবে যানজট কমাতে সাহায্য করবে
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বিভিন্নভাবে যানজট কমাতে সাহায্য করে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যেহেতু নিজেই একটি রাস্তা তাই এর নির্মাণে শহরের মোট রাস্তার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। রাস্তার পরিমাণ যত বাড়বে একই সংখ্যক গাড়ি তখন বিভক্ত হয়ে যাবে ফলে নির্দিষ্ট একটি রাস্তার ওপরে চাপ কমে যাবে।
দ্বিতীয়ত, রাস্তার সংযোগস্থলে যত বেশি গাড়ি থাকবে তত বেশি যানবাহন পরিচালনা করতে সময় বেশি লাগবে যা যানজট তৈরি করে। এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কোনো সংযোগস্থল থাকে না এবং যত বেশি যানবাহন ওপরের রাস্তা ব্যবহার করবে নিচের রাস্তার সংযোগস্থলে তত গাড়ির চাপ কমে যাবে এবং ব্যবস্থাপনা সহজ হবে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সম্পূর্ণ অংশের যাত্রা শুরু হলে পণ্যবাহী ট্রাক সারাদিন যাতায়াত করতে পারবে এবং এতে করে একদিকে সময় ও খরচ কমে যাবে অন্যদিকে পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখবে।
তৃতীয়ত, যে গাড়িগুলো এতদিন এক জেলা থেকে ঢাকার ভেতর দিয়ে চলাচল করে, অন্য জেলায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করতো তারা এখন থেকে ঢাকার মূল সড়কের গাড়ির সাথে যুক্ত না হয়ে সরাসরি ওপর দিয়ে রাজধানীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যেতে পারবে। এক্ষেত্রে দুটো সুফল পাওয়া যাবে। একটি হলো, যে গাড়িগুলো এতদিন ঢাকায় কোনো গন্তব্য না থাকলেও শুধুমাত্র বিকল্প রাস্তা না থাকায় ঢাকার সড়ক ব্যবহার করে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ তৈরি করতো, তা হ্রাস পাবে।
দ্বিতীয় যে সুফল তা হলো অর্থনৈতিক, যা পাওয়া যাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সম্পূর্ণ কার্যক্রম শুরু হলে। এতদিন পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রাক দিনের বেলা ঢাকা প্রবেশ করতে পারত না, তাই এগুলো মালামাল নিয়ে সারাদিন ঢাকার কাছাকাছি অপেক্ষা করতো। এর ফলে পণ্য পরিবহনের খরচ ও সময় বেড়ে যেত এমনকি অনেক মালামাল নষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সম্পূর্ণ অংশের যাত্রা শুরু হলে পণ্যবাহী ট্রাক সারাদিন যাতায়াত করতে পারবে এবং এতে করে একদিকে সময় ও খরচ কমে যাবে অন্যদিকে পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখবে।
শুধু তাই নয়, অনেকসময় দেশের বাইরে গার্মেন্টসসহ অনেক পণ্য রপ্তানি করার ক্ষেত্রে যানজটের কারণে শিপমেন্টের সময় বেশি লাগত কিন্তু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সেই সমস্যা হ্রাস করবে। চতুর্থত, ঢাকা থেকে সড়কপথে বের হওয়া বা অন্য জেলা থেকে ঢাকায় প্রবেশ করার ক্ষেত্রে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প ব্যবহার করে সহজেই যানজট এড়িয়ে যাতায়াত করা যাবে। এতে করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারকারীর যেমন সময়, জ্বালানি খরচ কম হবে তেমনি নিচের সড়কের যানবাহনের চাপ কিছুটা কমে যানজট কমাতে সাহায্য করবে।
আরও পড়ুন >>> মরণ ফাঁদের নির্মাণকাজ
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উপরোক্ত যে সুবিধা, তা অর্জনের জন্য কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে যা পূরণ না হলে যানজট কমবে না বরং শুধুমাত্র স্থান পরিবর্তন করবে। যেমন, ঢাকা শহরে ছোট গাড়ির আধিক্য এবং বৃদ্ধি হার অস্বাভাবিক বেশি। আমাদের প্রয়োজন বেশিসংখ্যক ছোট গাড়িকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করানো। এর ফলে নিচের যতটুকু সড়ক ফাঁকা হবে সেইখানে গণপরিবহন অগ্রাধিকার দিয়ে তার ব্যবহার উপযোগী করার পাশাপাশি সাইকেল ও হাঁটার জন্য নিচের সড়কের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে, ছোট ব্যক্তিগত গাড়ি বা মোটরসাইকেলের সংখ্যা যেভাবে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে করে অল্প সময়ে নিচের সড়কের চাপ পুনরায় বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রতিটি র্যাম্প একেকটি যানজট তৈরির পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে যদি না র্যাম্প ও তার কাছাকাছি সংযোগস্থলের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং সঠিকভাবে করা সম্ভব হয়। র্যাম্পের নিকটবর্তী রাস্তার সংযোগস্থলে যানজট তৈরি হলে তার প্রভাব এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পে পড়বে অথবা র্যাম্প থেকে একসাথে অনেক গাড়ি নিচের রাস্তায় চলে আসলে তা নিকটবর্তী সংযোগস্থলের পরিচালনা সময় বাড়িয়ে দেবে।
আমাদের প্রয়োজন বেশিসংখ্যক ছোট গাড়িকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করানো। এর ফলে নিচের যতটুকু সড়ক ফাঁকা হবে সেইখানে গণপরিবহন অগ্রাধিকার দিয়ে তার ব্যবহার উপযোগী করার পাশাপাশি সাইকেল ও হাঁটার জন্য নিচের সড়কের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
শুধু তাই নয়, র্যাম্পের সামনে অহেতুক গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার না করলেও র্যাম্পের সামনে জটলা করে কৃত্রিম যানজটের সূচনা হতে পারে। র্যাম্পের মুখে যেন কোনো প্রকার পার্কিং বা অব্যবস্থাপনা না থাকে তা খেয়াল রাখতে হবে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পগুলো রাস্তার একপাশ থেকে সংযুক্ত হয়েছে যার ফলে অনেক ক্ষেত্রে ফুটপাথ ভেঙে ফেলা হয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে পথচারীরা এলোমেলোভাবে রাস্তা ব্যবহার করতে গিয়ে র্যাম্পের সামনে চলে আসতে পারে এতে করে দ্রুতগামী গাড়ির সাথে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। ফুটপাত নিরবচ্ছিন্ন ও ব্যবহার উপযোগী রাখতে হবে যাতে করে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় ও র্যাম্পের যান চলাচল বিঘ্ন না ঘটে।
ঢাকা শহরের ভেতরে যেসব আন্তঃজেলা বাস ও ট্রাক টার্মিনাল রয়েছে তাদের মূল শহরের বাইরে সরিয়ে নিয়ে আন্তঃজেলা বাস ও ট্রাক বাধ্যতামূলক এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দীর্ঘমেয়াদি সুফলের জন্য সড়ককেন্দ্রিক মেগা প্রকল্পগুলোর সাথে সমন্বয় করা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন >>> পরিকল্পিত মেট্রোরেল কেন জরুরি
সর্বোপরি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনা যাতে না হয় তার জন্য নির্ধারিত গতিসীমা, মূল এক্সপ্রেসওয়েতে ৬০ কিমি/ঘণ্টা ও র্যাম্পে ৪০ কিমি/ঘণ্টা, নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে গাড়ির গতি ডিজিটাল বোর্ডে প্রদর্শন করলেই হবে না পাশাপাশি যদি কেউ ওভারস্পিড করে তাহলে পরবর্তী টোলের সাথে জরিমানার অর্থ পরিশোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এখন পর্যন্ত যতটুকু সম্পন্ন হয়েছে তা নিচে অবস্থিত রেলপথের ওপর দিয়ে নির্মাণ করার কারণে জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য জটিলতা ও দুর্ভোগ কম হয়েছে। কিন্তু ফার্মগেট থেকে কুতুবখালি পর্যন্ত অংশে এই সুবিধা পাওয়া যাবে না। তাই অবশিষ্ট অংশ বাস্তবায়নের সময় জনদুর্ভোগ কমিয়ে দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শুধু একটি স্থাপনা মাত্র এবং আমাদের পরিকল্পিত ব্যবহারের সুফল বয়ে আনতে পারে আবার একইভাবে খামখেয়ালি বা ভুল সিদ্ধান্ত একে পরিণত করতে পারে এক শ্বেত হস্তিতে।
কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক (অন-লিভ), এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট; সার্ভিলেন্স কো-অর্ডিনেটর, বিআইজিআরএস