রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেভাবে হ্রাস পায়
কোনো একটা দেশের সামস্টিক অর্থনীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাড়ানো এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে যদি দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক দেখা যায়। অর্থাৎ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যত বাড়বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন ততই কমে আসবে।
রাজনৈতিক অস্থিরতাকে সাংবিধানিক বা অসাংবিধানিক উপায়ে নির্বাহী ক্ষমতার পরিবর্তনের প্রবণতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত মনে করা হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকলে একটা দেশে হরতাল-অবরোধ- ভাঙচুর-জ্বালাও-পোড়াও বেড়ে যায়। ফলে আর্থিক ক্ষতি হয়।
২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, হরতালে একদিনে আমাদের দেশের আর্থিক ক্ষতি ছিল প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। নেপালে ২০১৩ সালে সাধারণ ধর্মঘটের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি কী হয় তার ওপর একটি গবেষণা করা হয়। এই গবেষণাপত্রটি ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত উপাত্ত নেওয়া হয়। এখানে দেখা যায় সাধারণ ধর্মঘটের ফলে নেপালের বাৎসরিক জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ০.৬ শতাংশ থেকে ২.২ শতাংশ কমে গিয়েছিল এবং পর্যটকদের আগমনের হারও কমে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!
দেশে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজমান থাকলে অর্থনীতিতে তার বহুমুখী প্রভাব পড়ে। দেশি এবং বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীদের দেশে বিনিয়োগের আস্থা কমে যায়। ফলে দেশে বিনিয়োগ কমে, কর্মসংস্থান কমে, উৎপাদন কমে এবং সামগ্রিক চাহিদা হ্রাস পায় এবং একই সঙ্গে উন্নয়নও হ্রাস পায়।
বিনিয়োগকারীরা সাধারণত যেসব দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে সেইসব দেশে নিরাপদ বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয়। ফলে যেসব দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে সেইসব দেশে তারা বিনিয়োগ বন্ধ রাখে বা কমিয়ে ফেলে।
যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো। কিন্তু দেশ থেকে বিনিয়োগ যদি বাইরে চলে যায় এবং দেশ যদি বিনিয়োগের সুযোগ হারায় তাহলে দেশে মূলধনের পরিমাণ তথা বিনিয়োগ কমার পাশাপাশি কর্মসংস্থান, উৎপাদন, আয় সবকিছুই কমতে থাকে। ফলে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন উভয় বাধাগ্রস্ত হয়।
২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, হরতালে একদিনে আমাদের দেশের আর্থিক ক্ষতি ছিল প্রায় ৩০০ কোটি টাকা....
হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটের মতো অস্থিতিশীল পরিবেশ মানুষের উৎপাদন কাজ বাধাগ্রস্ত করে। শ্রমিকরা ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, শিল্পের কাঁচামাল সঠিক সময়ে কারখানায় পৌঁছাতে পারে না, পরিবহন খরচ বাড়ে, ফলে উৎপাদন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম হয়। পাশাপাশি উৎপাদন খরচ বাড়ার ফলে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এইক্ষেত্রে আমদানি ও রপ্তানি উভয় প্রকার বাণিজ্যই খারাপভাবে প্রভাবিত হয়।
রপ্তানির ক্ষেত্রে হরতাল অবরোধের কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। এতে সময়মতো রপ্তানি পণ্য শিপমেন্ট হয় না। ফলে যেসব শিল্প রপ্তানির সঙ্গে জড়িত থাকে সেইগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আরও পড়ুন >>> ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি
আবার আমদানির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকলে আমদানিতেও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে। আমদানির পরিমাণ কমে যায়, যার প্রভাবে বাজারে আমদানি নির্ভর পণ্যের দাম বাড়ে।
যেসব শিল্পের উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানি করতে হয় সেইসব শিল্পের উৎপাদন কমে। একদিকে যেমন দ্রব্যের দাম বাড়ে, অন্যদিকে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়। ফলে সামগ্রিকভাবে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়, মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে। যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থা স্টক মার্কেটের ওপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার ফলে এইসব প্রতিষ্ঠানে তারল্য সংকট দেখা যায় ফলে বিনিয়োগ হ্রাস পায়।
উৎপাদন কমলে কর্মসংস্থান কমে, ফলে বেকারত্ব বাড়ে, মানুষের আয় কমে। আবার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। ফলে সামগ্রিক চাহিদা কমে।
দেশ থেকে বিনিয়োগ যদি বাইরে চলে যায় এবং দেশ যদি বিনিয়োগের সুযোগ হারায় তাহলে দেশে মূলধনের পরিমাণ তথা বিনিয়োগ কমার পাশাপাশি কর্মসংস্থান, উৎপাদন, আয় সবকিছুই কমতে থাকে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকলে সমাজেও এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করে। এর ফলে সমাজে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। সর্বোপরি মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যায়।
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে চাইলে দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। আর এজন্য অন্যতম পূর্ব শর্ত হচ্ছে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফলে কোনো দেশে বারবার সরকার পরিবর্তন হলে সেই দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হওয়া খুবই কঠিন; কারণ দেশের উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও অবকাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন।
আরও পড়ুন >>> ইভিএম ভীতি, ইভিএম রাজনীতি
আবার ক্ষমতার পালাবদলও যেমন বারবার নীতিগত পরিবর্তন নিয়ে আসে তেমনি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ প্রয়োজন যেসব মেগা প্রকল্পে সেইগুলোর গ্রহণ ও বাস্তবায়নেও ধীরগতি বয়ে আনে। আর এইসব প্রকল্পের উন্নয়ন যদি স্থবির হয়ে পড়ে তাহলে পুরো অর্থনৈতিক উন্নয়নই বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিনিয়োগ, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, আমদানি-রপ্তানি, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, অবকাঠামো, দ্রব্যমূল্য, জীবনযাত্রার মান প্রভৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ, দেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সুতরাং প্রত্যেকটা দেশেরই উচিত হবে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। একমাত্র স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিই পারে দেশকে টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
সোমা ভট্টাচার্য ।। সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়