তরুণ প্রজন্মের চোখে নজরুল
মেয়েটা রাস্তা পেরোচ্ছিল একটু আগেই। কত আর বয়স হবে, বড়জোর বছর উনিশ। গা থেকে কলেজের গন্ধ যায়নি, জিন্স থেকে অভিমান। দিব্যি দেখতে। চোখে চশমা, হাতে ছাতা। বৃষ্টিটা জোরে নামল এইবার। কফি হাউজের খোলা জানলা দিয়ে কলেজ স্ট্রিটের বৃষ্টি দেখতে কার না ভালো লাগে। মেয়েটা আড়াল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে কফি হাউজে ঢুকছে। আমার সঙ্গে ঢাকার সাংবাদিক এক বন্ধুদম্পতি কফি হাউজে উষ্ণতা ও স্বাধীনতা দেখছে চোখ ভরে।
দরজায় চোখ পড়ল। সেই মেয়েটা। এদিক-ওদিক জায়গা খুঁজছে। আমাদের চার চেয়ারের টেবিলে একটা চেয়ার খালি। সরাসরি এসে জিজ্ঞাসা করল, এখানে বসতে পারি? আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই বলল, আমি অনন্যা। প্রেসিডেন্সি, সেকেন্ড ইয়ার। তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল আজ। এইরকম একটা দিন, ভাবলাম একটু হ্যাং আউট করি। আচ্ছা, আপনারা কতক্ষণ বসবেন?
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?
মেয়েটি বলল, আমার বন্ধুরা আসছে। আমার দায়িত্ব জায়গা দখল করার।
আমি বললাম, তা হয়ে যাবে। আপনি আগে নিজেকে সেটেল ডাউন করুন।
আরও পড়ুন >>> শতাব্দীর পশ্চাতে নজরুল অবলোকন
মেয়েটি ফস করে একটা লম্বা সিগারেট জ্বালিয়ে আমাদের টেবিলে নিজেকে সেটল ডাউন করে হাতে তুলে নিলো বন্ধুর সদ্য কেনা নজরুল সম্পর্কিত একগাদা বইয়ের একটা। আমার বন্ধুপত্নী এতক্ষণ অনেক কথা বলছিল। মেয়েটার কাণ্ডকারখানা দেখে নিশ্চুপ। মেয়েটি বইটা উল্টে-পাল্টে দেখে বলল, আপনারা কি বাংলাদেশি?
আমি বললাম, কেন বলুন তো?
- নাহ, নজরুল নিয়ে তো এখানে খুব অল্প মানুষই পড়াশোনা করে। যা করে সব বাংলাদেশের লোকেরা।
- কেন? এখানে বুঝি নজরুল চর্চা হয় না?
- নাহ। কী করে হবে? নজরুল তো কবেই হ্যাকড হয়ে গেছে বাংলাদেশের কাছে।
- হ্যাকড বলতে?
কাজী নজরুলের কোনো ‘বিশ্বভারতী’ ছিল না। তিনি তার সৃষ্টিকে কোনো আইনের মাধ্যমে বেঁধে ফেলেননি। নজরুলের গানে একেকজন শিল্পীর গায়কী একেক রকম।
- ওপার বাংলা স্রেফ নিয়ে নিয়েছে নজরুলকে। জাতীয় কবি বানিয়ে, ওখানেই কবর দিয়ে, এত সম্মান জানিয়ে ওদের করে নিয়েছে...।
- সে কী! অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা কবিতাটা আপনি পড়েননি? ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল / আর সবকিছু / ভাগ হয়ে গেছে / শুধু ভাগ হয়নি কো / নজরুল।’
- তা পড়েছি। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের কথা। আর এখন? এইপারে নজরুল নিয়ে চর্চা কোথায়? রেডিও-টিভি, মিউজিক চ্যানেল কোথাও বাজানো হয় নজরুলের গান? ওইদিকে রাজনৈতিক দলগুলো তো তাকে নিয়ে মাতামাতি করে।
- কোথায়? কীভাবে?
- আপনি শাসক দলের কাণ্ড দেখুন। ওরা কথায় কথায় নজরুল আওড়ায়। ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান। / মুসলিম তার নয়ণ-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।।’
- তাতে অন্যায় কোথায়?
- অন্যায় নেই? চর্চা কোথায়? নজরুল অ্যাকাডেমি করেছে। তার মাথায় এক কবি যার নজরুল সম্পর্কে কোনো কাজ নেই। তাকে জিজ্ঞাসা করুন। তিনি বলছেন, ২১টি জেলায় কর্মশালা করেছে তার একাডেমি। ব্যস। তারপর?
- আপনি কী চাইছেন? কী করা উচিত?
- দেখুন, আমাদের জেনারেশন তো এমনিতেই বাংলা বইটই বিশেষ পড়ে না। গান বলতে হিন্দি আর রূপম ইসলাম। ব্যান্ডও ভোগে গেছে। এখন গান কোথায়?
আরও পড়ুন >>> নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার পটভূমি
- তার মধ্যেও রবীন্দ্রসঙ্গীত বেঁচে আছে কীভাবে?
- কীভাবে? দেখুন এখানে একটা মজা আছে। কাজী নজরুলের কোনো ‘বিশ্বভারতী’ ছিল না। তিনি তার সৃষ্টিকে কোনো আইনের মাধ্যমে বেঁধে ফেলেননি। নজরুলের গানে একেকজন শিল্পীর গায়কী একেক রকম। যে যার মতো এক্সপেরিমেন্ট করেছেন।
- তাতে কী?
- তাতে এখন ‘খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগর জলে’ গানে ধামসা বাজানো হচ্ছে। এটা কি সাঁওতাল গান?
- তা তো রবীন্দ্রসংগীতেও এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। দ্য বং কানেকশন (The Bong Connection, 2006) দেখেননি?
- সেইখানে মূল গানের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না বা মূল সুরের, অ্যাডিশন হচ্ছে। তার ওপরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে রবীন্দ্রসংগীত বাজানো হচ্ছে।
- তা তো নজরুলের গান দিয়েই তো বাঙালির সংগীত শিক্ষার শুরু।
- ঠিক। কিন্তু তারপরে? রিয়ালিটি শো, অনুষ্ঠান, টিভি এক্সপোসার—সেইখানে নজরুল একদমই বাদ।
- কিন্তু আবৃত্তিতে? সেইখানে তো নজরুল করতেই হবে।
- আবৃত্তি করতে ‘বিদ্রোহী’, ‘সাম্যবাদী’ লাগবেই। এমন দ্রোহের কবিতা রবীন্দ্রনাথ লেখেননি। তাই...
- আপনি বলতে চান যে তরুণ প্রজন্ম নজরুলচর্চা থেকে দূরে সরে গেছে?
- এক্সাক্টলি। নজরুলের এমন বর্ণময় জীবন নিয়ে একটাও উপন্যাস লেখা হয়েছে। তাও সব তথ্য ঠিক নয়। ফিল্ম ক’টা হয়েছে? আপনি কি জানেন ওর একসময়ের প্রেমিকা নার্গিসের আসল নাম কী ছিল?
...ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। নজরুল তার প্রেমে পড়লেন। ফজিলাতুন্নেছা নজরুলের প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারপরও নজরুল ছিলেন নাছোড়বান্দা, আশা ছাড়েননি।
- না। তা জানি না।
- সৈয়দা খাতুন। কুমিল্লার মেয়ে। বিয়ে হতে হতে হয়নি। বিয়ের আসর থেকে ফিরে আসেন নজরুল। নার্গিসের সঙ্গে তার প্রেমের অভিজ্ঞতা থেকে জন্মেছে বহু গান ও কবিতা। আচ্ছা আপনি জানেন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কোন বাড়িতে বসে রচনা করেছিলেন নজরুল?
- না তো।
আরও পড়ুন >>> নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা
- ৩/৪ সি তালতলা লেন বাড়িতে রচিত হয়েছিল। ১৯২১ সালে। তিনি জীবনে আরও অনেককাণ্ড করেছিলেন। ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে পূর্ববঙ্গ থেকে কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক আইনসভায় প্রার্থী হয়েছিলেন এবং হেরে গিয়েছিলেন। আচ্ছা, আপনি কি ফজিলাতুন্নেছার কথা জানেন?
- শুনেছি। তবে খুব বিশদে...
- ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামক সংস্থার দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে যোগ দিতে এসে তিন সপ্তাহ ঢাকায় ছিলেন নজরুল। এই সময় কাজী মোতাহার হোসেন ফজিলাতুন্নেছার সাথে নজরুলের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ফজিলাতুন্নেছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ছিলেন।
তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও বিদুষী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। নজরুল তার প্রেমে পড়লেন। ফজিলাতুন্নেছা নজরুলের প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারপরও নজরুল ছিলেন নাছোড়বান্দা, আশা ছাড়েননি। কাঙালের মতো প্রেম চেয়েছেন ক্রমাগত। কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে লেখা সাতটি এবং ফজিলাতুন্নেছার কাছে লেখা একটি মোট আটটি প্রেমাকুতিপূর্ণ পত্র তার প্রমাণ।
- আর প্রমীলার ব্যাপারটা?
- বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে তার নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। বীরেন্দ্রকুমারের মাতা বিরজাসুন্দরীকে তিনি মা বলে ডাকতেন। এরইমধ্যে নতুন করে প্রেমে পড়েন বিরজাসুন্দরীর জা গিরিবালা দেবীর একমাত্র মেয়ে আশালতা সেনের সাথে। তখন নজরুলের বয়স বাইশ বছর, আর আশালতা সেনের বয়স মাত্র তের বছর। এই প্রেমের সূত্রে নজরুল নিয়মিত কুমিল্লায় যেতেন।
নজরুল-প্রমীলার প্রেম ধীরে ধীরে এমন গভীর হয়েছিল যে, মিলনের জন্য ধর্ম আর কোনো বাধাই ছিল না। বিয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। এই বিয়েতে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল কন্যাপক্ষের একমাত্র অভিভাবক মা গিরিবালা দেবীর। কাজী নজরুল ইসলাম ও আশালতা সেনগুপ্তের বিয়ে হয়েছিল ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল। ঘরোয়া পরিবেশে, অনাড়ম্বর এবং অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। আর তা হয় মুসলমান রীতি মেনেই।
আরও পড়ুন >>> অস্ত্র ও ছলনার বিরুদ্ধে মানুষে আস্থা রবীন্দ্রনাথের
- বাহ। কিন্তু নজরুল সম্পর্কে আপনি তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে আপনি এত জানেন অথচ বলছেন যে তরুণরা নজরুল নিয়ে মাথা ঘামায় না?
- সত্যি ঘামায় না। ক’টা বই আপনি নজরুলকে নিয়ে পেয়েছেন? রূপা প্রকাশনীর সুমন্ত সেনের লেখা ইংরেজি ভাষায় নজরুলের ওপর একটি গ্রন্থ আছে। ওটা ভালো। অনেকেই নাকি গবেষণা করছেন, তাহলে এপারে বই কোথায়? ওপার বাংলায় যান, ওরা গুলে খেয়েছে নজরুলকে।
- অনন্যা, আমাদের তর্ক শুরু হয়েছিল যে এপারের তরুণ প্রজন্মের চোখে নজরুল। মাঝখানে আপনি আসলেন। আর যা যা বললেন তাতে আপনার জ্ঞান ও চর্চার পরিচয় পেয়ে এটা বুঝলাম যে কলকাতায় নজরুলচর্চা এখনো খুব ভালোই হচ্ছে।
অনন্যা হেসে ফেলল। আবার ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, আপনি ভুল করলেন। কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে আমার প্রপিতামহ, তাই আমি জানি। বাকিরা?
আমি নিশ্চুপ।
অমিত গোস্বামী ।। কবি ও কথাসাহিত্যিক (ভারত)