রাজনৈতিক আদর্শ কোথায়?
দুঃস্বপ্নের সঙ্গে আমাদের বহুদিনের বাস। রোজ সে এসে দাঁড়ায় আমাদের সামনে। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় যে নাগরিক মিছিল একদিন সারাদেশ চমকে দিয়েছিল, স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেই মিছিল তো চলমান থাকারই কথা ছিল। কারণ মিছিল ছিল অন্যায়ের বিপক্ষে। মিছিল ছিল ন্যায্যতার পক্ষে। মিছিল ছিল নিপীড়িত মানুষের কাঁধে ভরসার হাত রাখবার জন্য।
কিন্তু সেই বাংলাদেশ কোথায় হারাল? রাজনীতি এমন এক জায়গায় গেছে যে, পুরো নাগরিক সমাজই এখন বিভক্ত। একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ। কার সাথে মিশব, কার সাথে মিশব না এমন ভাবনাতেই সময় কাটে। কী কথা লিখব আর কোন কথাটা চেপে যাব—এমন অঙ্ক এখন নিয়ম করে করতে হয়।
একটা ভয়ংকর মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠী যেমন সহসাই কাউকে নাস্তিক ট্যাগ দিচ্ছে, তো আরেক পক্ষ হয়তো মৌলবাদী তকমা দিচ্ছে। কয়েক বছর আগে লেখক, ব্লগারদের তো হত্যা করা হচ্ছিল নিয়মিত বিরতিতে।
আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!
যারা এখন মানবাধিকার, গণতন্ত্র, মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে কথা বলছে তাদের ক্ষমতার ইতিহাসও জানা। তাদের চেহারায় ছিল কী আস্ফালন, কী কুৎসিত আচরণ, কী পরিমাণ ঔদ্ধত্য!
মাত্রই গত হয়েছে একুশে আগস্টের মতো ভয়াল ঘটনা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সংসদে তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রীকে হত্যা করতে, তার দলের পুরো নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করতে রাষ্ট্রীয় মদদে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল।
কারও মতের সাথে মিল না হলেও তার কথা শুনতে হবে, তাকে বলতে দিতে হবে—এটা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শিক্ষা। কিন্তু আদর্শের মিল হলেই মহান আর না হলেই পরিত্যাজ্য এই ধারণার গোড়াতেই গলদ আছে…
বিচারের নামে প্রহসন, উল্টো শেখ হাসিনার ওপরই দোষ চাপানোর রাজনীতি চলছে। এই রাজনীতি কোনো মতাদর্শের কথা বলে না। এখন তারা যে গণতন্ত্র ও সহনশীলতার বুলি দিচ্ছে, সেইসব নরম-নরম কথায় না ভুলে ভাবতে হয়। সব রাজনীতির ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য এই দেশে। ক্ষমতাচ্যুত না হলে এই রাজনীতির ব্যবহার বদলায় না। ক্ষমতার পালাবদলে নেতাদের ভাষা, ভঙ্গি, আচরণ খুব দ্রুত বদলে যায়।
এই যে ‘আমরা-ওরা’র বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে এর বড় শিকার উদারনৈতিকতা এবং প্রগতিশীলতা। গোড়া সমর্থক হতে গিয়ে পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজের লোকজনও মূল্যবোধহীন সমাজের নির্মাতা হচ্ছেন।
আরও পড়ুন >>> প্রশাসকের এত জয়জয়কার কেন?
লেখাপড়া শিকেয় তুলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির কদর্য হানায় হুমকি, মারধর আর কুৎসিত আচরণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে নিরুপায় পড়ুয়াদের। এক শ্রেণির নেতৃবর্গের ছত্রছায়ায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা সিন্ডিকেটরা এখন অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রশাসনে এখন মেধাহীনদের রাজত্ব।
দলের নেতা বা পেশাজীবীদের নেতা যে-ই হোন, আমরা মনে করি তারা সবাই একটা উঁচু আদর্শ নিয়েই যেন সাধারণের কাছে যান। এইকথা তারা প্রচারও করেন যে, সাধারণ মানুষকে আদর্শের উচ্চতায় তুলে আনা তাদের কাজ। কিন্তু একটু গভীরে খতিয়ে দেখলে আমরা দেখব তারা কতটা দুর্নীতিপরায়ণ, কতটা আদর্শহীন, কতটা কপট।
রাজনীতির নেতারা অলস অনুগামী তৈরি করে। তারা চায় সব ভাবনার দায়িত্ব তাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে তাদের পেছন পেছন ঘুরতে হবে। আমরা কখনো ভাবতে পারি না যে সত্যি এইরকম প্রশ্নহীন আনুগত্য বদল আনতে পারে কি না।
কারও মতের সাথে মিল না হলেও তার কথা শুনতে হবে, তাকে বলতে দিতে হবে—এটা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শিক্ষা। কিন্তু আদর্শের মিল হলেই মহান আর না হলেই পরিত্যাজ্য এই ধারণার গোড়াতেই গলদ আছে। এর মধ্য দিয়ে একটা ‘আমরা আর ওরা’ বিভাজন তৈরি হয়।
আমরা নিজেকে প্রশ্ন করি না—কেন চেতনা বা আদর্শের নেতৃত্ব গচ্ছিত থাকবে কিছু মানুষের ওপরে? কেন আমরা আশা করব, তারাই আমাদের বোধের ভাণ্ডারী আর কাণ্ডারি হবেন? আদর্শগতভাবে মিল আছে এমন একজন মানুষের হয়তো পুরোপুরিই অনাদর্শের জীবন, আবার আদর্শগতভাবে মিল নেই সেই মানুষটা বিদগ্ধ। কিন্তু সমাজ আর রাজনীতি সবাইকে বিভাজিত করে রেখেছে কেবল রাজনৈতিকভাবে।
আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন
এই রাজনীতির নেতারা অলস অনুগামী তৈরি করে। তারা চায় সব ভাবনার দায়িত্ব তাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে তাদের পেছন পেছন ঘুরতে হবে। আমরা কখনো ভাবতে পারি না যে সত্যি এইরকম প্রশ্নহীন আনুগত্য বদল আনতে পারে কি না। আমরা নিজেদের ভাবতে পারছি না যে আসলে আমরা ভুল রাজনীতির শিকার।
এটি অসুখ। এই অসুখটা যে প্রকটভাবে রাজনৈতিক, সেটাও আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এর শুরু কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক করবে দলগুলো। কিন্তু এই অসুখটির উৎস যে বহু আগে থেকেই বাঙালি মানসিকতার মধ্যে নিহিত, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এই সমাজে ফরসা-কালোর অসুখটি যেমন চিরদিন ধরে চলে আসছে, ধনী-দরিদ্র বিভেদটাও অনাদিকাল ধরে বিরাজমান। তার সাথে এখন প্রকট হয়েছে ক্ষমতাভোগী ও ক্ষমতাহীনের সমস্যা।
আমাদের সাংবাদিক, আইনজীবী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, সরকারীকর্মী সবাই একে অন্যকে ‘ওরা’ বলে। প্রতি পদক্ষেপে শ্রেণি-বিভাজন আমাদের জাতিগত ঐতিহ্য। আমরা বুঝতেও পারি না যে, এই অপরায়ণ ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতাকে পল্লবিত করে।
এক ভয়ংকর পরিবেশ যেখানে প্রতিভাবান ও গুণীদের যাচাই করার আগে জেনে নিতে হয় ‘আমাদের লোক’ কি না। অযোগ্য হলেও অসুবিধা নেই, যদি আবার ‘আমাদের’ হয়। কিন্তু এমন ভাবার মধ্যে যে একটা অপ্রাপ্তমনস্ক নির্বুদ্ধিতা ও মনোবৈকল্য আছে, তা বোঝাবার সময় আসবে কী?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন