প্রাথমিক থেকেই শুরু হোক বই পড়ার অভ্যাস
বাঙালির শৈশব মানেই বড়দের মুখে ঠাকুরমার ঝুলির গল্প শোনা। কতই না মধুর ছিল সেইসব দিনগুলো। এখন আর সেই রকম দেখা যায় না। এখনকার বড়রা গল্প শোনানোর সময় পান না বা সময় পেলেও শোনার জন্য কাউকে খুঁজে পান না। এখন সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত।
কেউ একটু সময় পেলেই টিভিতে সিরিয়াল দেখছে, কেউবা মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটাচ্ছে, কেউবা মোবাইলে গেম খেলছে। তাই, ব্যস্ততার কারণে গল্প শোনানো কিংবা শোনার সময় না পেলেও শিশু বয়স থেকেই শিক্ষামূলক বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বইসহ অন্যান্য বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠলে শিশুর সুপ্ত সত্তার বিকাশ ঘটে, মননশীলতার ব্যাপ্তি ঘটে ও জ্ঞানের গভীরতা বাড়ে।
পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি কবিতা, গল্প, শিশুতোষ উপন্যাস, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি পড়লে শিশুমনের একঘেয়েমি দূর করে এবং পঠন পাঠন দক্ষতা বৃদ্ধি পায় যা প্রতিটি শিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শুদ্ধ, সুন্দর ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে বই পড়ার বিকল্প নেই। বই পড়লে শুধু মেধা ও প্রজ্ঞাই বৃদ্ধি পায় না, বরং বই পাঠে শিশুরা হয়ে ওঠে প্রাণচঞ্চল, সহনশীল ও সহমর্মী। প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বই পড়ার অভ্যাসটি রপ্ত করা উচিত।
আরও পড়ুন >>> অস্থির সময়ে রবীন্দ্রনাথ কেন এত প্রাসঙ্গিক?
প্রাথমিক শিক্ষা একটি শিশুর জীবন গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শিশুর মানসিক বিকাশ সাধন করে প্রগতিশীল ও জ্ঞানভিত্তিক স্মার্ট সমাজ বিনির্মাণে সবশিশুর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করা খুবই জরুরি। পৃথিবীতে বই পড়ার মতো নির্মল আনন্দের সমতুল্য আর কিছুই নেই।
শিশুরা কোমলমতি এবং অনুকরণপ্রিয়। বড়দের কাছ থেকে দেখে তারা শিখে। তাদের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হলে প্রথমে শিক্ষক, অভিভাবক এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদেরও বই পড়ার চর্চা থাকা জরুরি। বই পড়ার কথা উঠলেই সবারই বলতে শোনা যায়- সময় কোথায় এত বই পড়ার? অথচ প্রতিদিন আমরা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম এবং টুইটারে অনেক সময় নষ্ট করি। শিশুর সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য শারীরিকভাবে সুস্থ রাখার পাশাপাশি শিশুর মানসিক বিকাশের দিকেও নজর রাখা প্রয়োজন।
শিশুদের পিঠে পাঠ্যবইয়ের ভার চাপিয়ে দিয়ে মুখস্ত করে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার প্রতিযোগিতা তাদের দিনদিন রোবটে পরিণত করছে। তাদের মধ্যে যে স্রষ্টা কী পরিমাণ প্রাণশক্তি দিয়ে এই জগতকে আবিষ্কার করার ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছে, তা ভুলে গিয়ে তারা সেই খুঁটিতে বেঁধে দেওয়া শিকলের ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে তাদের পৃথিবীকে সীমাবদ্ধ করে ফেলছে।
এই গতানুগতিক পড়ালেখা ও শুধুই ভালো ফলাফল করার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতেই অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠাগার স্থাপন করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইপড়ার চর্চা তৈরি হবে।
বই পড়া ক্লাস ও পরীক্ষার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সপ্তাহে অন্তত একদিন পাঠাগারে গিয়ে শিশুদের বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার স্থাপন এবং গ্রন্থাগারে সহকারী গ্রন্থাগারিকের একটি করে পদ সৃজন করেছেন।
উদ্যোগটি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নেওয়া এখন সময়ের দাবি। কারণ পাঠাগার স্থাপনের মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিশুদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারলে তা জাতির জন্য সামগ্রিকভাবে কল্যাণও মঙ্গল বয়ে আনবে।
আরও পড়ুন >>> ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস
লাইব্রেরি হলো দেশ ও জাতির জন্য জ্ঞানভাণ্ডারস্বরূপ। মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশে লাইব্রেরির ভূমিকা অপরিসীম। তরুণদের প্রতিভা বিকশিত করতে, আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য সর্বোপরি দেশের উন্নতির জন্য লাইব্রেরির সংখ্যা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান লাইব্রেরিগুলোয় পড়ার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে লাইব্রেরি গড়ে তুলতে হবে।
দেশের প্রতিটি জেলায় পাবলিক লাইব্রেরি থাকলেও বেশিরভাগ উপজেলায় এই উদ্যোগটি নেওয়া হয়নি। তাই উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট জাতি বিনির্মাণে বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শিক্ষার্থী তথা সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে উপজেলা পর্যায়ে পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপন করা উচিত। এছাড়াও উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে স্থানীয় সবার সহযোগিতায় প্রতিটি ইউনিয়ন, গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় গড়ে তুলতে হবে এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক লাইব্রেরি যাতে শিক্ষার্থীরাসহ সব মানুষ বই পড়ার মতো ভালো একটি অভ্যাস রপ্ত করতে পারে।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের বই পড়ায় উৎসাহিত করতে উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে ‘বই পড়া প্রতিযোগিতা’র আয়োজন করা যেতে পারে যার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠন দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
শুদ্ধ পাঠ, বর্ণ দিয়ে শব্দ তৈরি, শব্দ দিয়ে অর্থবোধক বাক্য তৈরি এবং বই পড়ে তাদের নিজস্ব মতামত খাতায় লেখার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি নানা আয়োজন করা যেতে পারে। এই রকম ছোট ছোট উদ্যোগগুলো যদি উপজেলা প্রশাসন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুরু করা যায়, তবেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
বই কেন পড়ব? শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে বই পড়া আমাদের কতটা সাহায্য করে তা জেনে নেওয়া যাক—প্রথমত বই পড়লে তথ্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়, যেকোনো বিষয়ে নতুন নতুন প্রশ্ন করার ক্ষমতা বাড়ে এবং নতুন করে চিন্তা করতে শিখায়। এছাড়া বই পড়ার আরও অনেক উপকারিতা রয়েছে যেমন—
১) জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে; (২) মানসিক উদ্দীপনা তৈরি করে; (৩) মনকে সুস্থ ও প্রফুল্ল রাখে; (৪) মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে; (৫) অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে সাহায্য করে; (৬) কল্পনা শক্তি বৃদ্ধি করে; (৭) স্মরণ শক্তির বৃদ্ধি ঘটে; (৮) শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি করে; (৯) লেখনী শক্তি বৃদ্ধি করে; (১০) জটিল চিন্তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে; (১১) একাগ্রতা বৃদ্ধি করে; (১২) সহানুভূতিবোধ বাড়ায়; (১৩) আত্মসম্মানবোধ তৈরি করে; (১৪) সংলাপ দক্ষতা বৃদ্ধি করে; (১৫) নতুন ভাষা শিখতে সাহায্য করে এবং (১৬) ভালো ঘুমাতে সাহায্য করে।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছেন—‘বইয়ের মতো এমন বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই।’ আসলেই যুগ যুগ ধরে এই বিশ্বস্ত বন্ধুর মাধ্যমে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত মানুষেরাই সভ্যতার আবিষ্কার করেছেন।
বিশ্বের উন্নত দেশ ও জাতিগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণা এবং প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করেই এই অবস্থানে আসীন হয়েছে। কারণ জ্ঞান ছাড়া মানুষ বা মানবসভ্যতার কথা কল্পনাও করা যায় না।
আরও পড়ুন >>> প্যারী মোহন আদিত্য : অল্পশ্রুত মহান দেশপ্রেমিকের প্রতিকৃতি
এজন্য দেশকে উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধ করতে বই পড়ার চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হলে নতুন প্রজন্মকে সুশিক্ষিত এবং স্বশিক্ষিত হয়ে যোগ্য এবং স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে হবে।
আজকের শিশুদের হাতে যত বেশি বই তুলে দেওয়া যাবে, তারা তত বেশিই শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বিজ্ঞান চর্চা এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে ঋদ্ধ হয়ে আগামী দিনের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
অন্জন দাশ ।। উপজেলা নির্বাহী অফিসার, লক্ষ্মীপুর