সেলিম আল দীন : মহানাট্যের নটরাজ
একটা নাটকের কথা মনে পড়ে। নাট্যদলের জীবননাট্য নিয়ে লেখা একটা ধারাবাহিক। রাত জেগে নিভু নিভু চোখে টিভির পর্দায় তাকিয়ে থাকতাম। তখনো জানি না কে তার নাট্যকার। পাখির বাচ্চার মতো এক মুঠি বাল্যকালে তার দরকারও ছিল না। নাটকের নাম ‘গ্রন্থিকগণ কহে’।
কোন গ্রন্থিক, কী কহে তা জানতাম না; বয়সের কারণে অনেকটাই ছিল অবোধ্য। অনেক পরে দেখলাম ‘ছায়াশিকারী’। অডিওতে শুনলাম রেকর্ড করা ‘কিত্তনখোলা’। পড়লাম ‘কেরামতমঙ্গল’; জানা গেল ‘চাকা’, ‘প্রাচ্য’, ‘বনপাংশুলের হদিস’। একে একে জেনে গেলাম ওই সব নাটকের রূপদর্শী কারুকার সেলিম আল দীন।
যে বিদ্যাপীঠে তার ও তার নাটকের ব্যাপক বিকাশ সেই বিদ্যাপীঠে পৌঁছে তাকে দেখেছি বেশ কয়েক বছর। কিন্তু সেই দেখা এমন নয় যে, আমি তাকে খুব ভালো করে বুঝি; সেই পড়া এমন নয় যে, তার শিল্পমঞ্চের সবটুকু আমি উদযাপন করেছি। সেই দেখা চকিত, চূর্ণিত।
আরও পড়ুন >>> অস্থির সময়ে রবীন্দ্রনাথ কেন এত প্রাসঙ্গিক?
কয়েক মুহূর্তের দেখাশোনায় তার কথাই ছিল অধিক। আমি বা আমরা শ্রোতামাত্র। তার কথামালায় আমাদের টুকরো মন্তব্যের প্রবেশাধিকার ছিল সীমিত, আর শিক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সর্বাধিক। যতটুকু শুনেছি, তার কিছু অংশই আজ হয়তোবা বলা যেতে পারে।
২.
এক পাল কাব্যভোক্তা তার ঘরে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। সেই প্রথম সেলিম আল দীনের মুখোমুখি হওয়া এবং তারপর পথ হাঁটা। চলতি পথে অশেষ অভিজ্ঞতার বিবরণ। শিল্প থেকে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান থেকে দর্শন, দর্শনের মোড় ডিঙিয়ে রাষ্ট্রের চৌরাস্তা, রাষ্ট্র পেরিয়ে রাজনীতির হট্টগোল, নিস্তব্ধতার রবীন্দ্রনাথ, আবার শিল্প, নাটক-কবিতার যৌথতা, দৈনন্দিন জীবনের চোরাবালি, মৃত্যু এবং আবার শিল্প এইভাবে পরিধি ভেঙে ভেঙে পৌঁছে যান অপার দিগচিহ্নহীন মহাবিশ্বে।
....কয়েক মুহূর্তের দেখাশোনায় তার কথাই ছিল অধিক। আমি বা আমরা শ্রোতামাত্র। তার কথামালায় আমাদের টুকরো মন্তব্যের প্রবেশাধিকার ছিল সীমিত, আর শিক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সর্বাধিক।
সব অন্ধিসন্ধি যেন চোখের মণিতে জ্বলে উঠছে মাঝে মাঝে। তারই ঝিলিকে আমরা পেয়ে যাচ্ছি তাৎক্ষণিক উজ্জ্বলতা। জীবনে এই প্রথম একজন ঘোরগ্রস্ত শিল্পীর দেখা পেলাম। জানা হলো, চিন্তার বহুরেখা ছাড়া শিল্পে সুস্থিতি অসম্ভব।
মহুয়া ফুটবে, মহুয়া ফুটছে; সেলিম আল দীন ব্যাকুল আগ্রহে অঞ্জলি ভরে তুলে নেন সেই ঘ্রাণ। উৎসব হবে মহুয়া ফুলের। মহুয়া ফুল ফোটার উৎসব। আমরা হাসলাম—‘আধুনিক’ মানুষের ‘বৃক্ষবন্দনা’! তবু আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনলাম তার কথা—আমেরিকার চণ্ডনাচন, আফগানিস্তানে আগ্রাসন, ইরাকে হামলা, জাতিসংঘের ব্যর্থতা, সাম্রাজ্যবাদের নির্মমতা, রাষ্ট্রে নিপীড়ন ইত্যাদি।
পীড়িত মানুষের আখ্যান শুনতে শুনতে মনে হলো মহুয়া গাছের নিচে দাঁড়ানো আমরা এই নিরুপায় মানবগোষ্ঠী প্রকৃতির পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। মহুয়া ফুল ফোটার উৎসবে বৃক্ষবন্দনার আড়ালে তাহলে মানুষের ক্রন্দনকে জানিয়ে দেওয়া? কিন্তু প্রকৃতির কাছে কেন? উৎসবের ভিড়ে বুঝতে চাইলাম, বৃক্ষ-প্রাণশোভিত প্রকৃতিই মানুষের শেষ শরণ। সেলিম আল দীন সেই প্রত্যাবর্তনের জন্যই জমিয়ে তোলেন খ্যাতিহীন ফুলের উৎসব।
লেখার জমিন কীভাবে তৈরি হয়? যদি না থাকে জীবন সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান বোধ, যদি না থাকে বিশ্ব-ভূগোলের ধারণা, যদি না থাকে ধ্রুপদি সাহিত্যের পাঠ? অথবা যদি লৌকিক জীবনে লেখকের প্রবেশ থাকে বিহগস্বভাবের?
সেলিম আল দীনের উত্তর—না, সে লেখক নয়, শিল্পী নয়, নামপরিচয়হীন অন্য কিছু। তরুণ লেখকদের সংকট প্রসঙ্গে এই কথাগুলো বহুবার জানিয়েছেন তিনি; হয়তোবা নিজেকে জানাবার জন্যেই। ঠিক যেমন নিজেকে বুঝবার জন্য অন্যদের বারবার পড়ে শোনান নিজের লেখা ‘ঊষা-উৎসব’ কিংবা অন্য কোনো লেখা, অথবা নিজেরই লেখা দিনপঞ্জির দুই-একটি অনুচ্ছেদ শুনতে চান অন্যের কণ্ঠে।
আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন
খুঁজে নেন অন্যের লেখাও; আবিষ্কারের আনন্দ গাঁথা থাকে চোখে মুখে। বোঝা যায়, নিজেকে ঋদ্ধ করার সব দরজা খোলা রেখে সেলিম আল দীন শিল্প আর জীবনকে যাপন করেছেন। তার লেখার বহুমুখ বহুস্বর সেই সাক্ষ্য দেয়।
৩.
লোকটা কবি হতে চেয়েছিল। কবিতার বীজ গর্ভে নিয়ে হলেন নাট্যকার। লিখলেন নাটক, হলো নাটক-কবিতা-সংগীত-নৃত্যের বিচিত্র ঐক্য। লোকে যদি না বোঝে! তাই লিখলেন নিজের লেখার তত্ত্বরূপ—দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব, ধ্রুপদি বাস্তবতা, ফিউশনতত্ত্ব বা শিল্পের একাঙ্গীকরণ, তুলনামূলক নাট্যতত্ত্ব, গবেষণাগার নাট্য, উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ ইত্যাদি।
নাটকের রূপাঙ্গিক হিসেবে অভিধা দিলেন কথানাট্য, বর্ণনামূলক নাট্যরীতি। এমনকি বাংলার নাট্য-সম্পর্কিত পরিভাষাগুলো ভাষ্যসহ গ্রন্থবদ্ধ করেছেন। খুব সাংগঠনিকভাবে ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যূথবদ্ধতায় ছড়িয়ে দিলেন গ্রাম থিয়েটারের ধারণা—শম্ভু মিত্র যেমন বাংলার নাটক, মঞ্চ, অভিনয় আর থিয়েটারের ধারণাকে সংঘবদ্ধ করেছিলেন। বারোয়ারি কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সম্পৃক্তির ফলে সেলিম আল দীনের নাটকেও দেখা বহু রঙের মানুষ, বহু কথা, বহু মাত্রার জীবন।
মূলত সেলিম আল দীনও শুরু করেছিলেন প্রথাবদ্ধ পথে; আমরা তার সাম্প্রতিক নাট্যকর্মের ঘোরে প্রায়শ ভুলে যাই যে, ‘কিত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’ বা ‘চাকা’র বাইরেও সেলিম আল দীন বিস্তর নাটক লিখেছেন। ‘লিব্রিয়াম’, ‘অনিকেত অন্বেষণ’, ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘সঙবাদ কার্টুন’, ‘মুনিরা মফস্বলে’, ‘রক্তের আঙ্গুরলতা’, ‘মুনতাসির’—এসব নাটকের কোনোটা ধারণ করেছে শহুরে জীবনের নিঃসহায় হতাশা, কোনোটা ফ্যান্টাসি ও তীব্র ব্যঙ্গ।
নাটকের অ্যাবসার্ড ধরনও যুক্ত আছে কিছু নাটকে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, নূরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, সাঈদ আহমদ—বাংলাদেশের নাটকের এই আধুনিক খাত ধরেই সেলিম আল দীনের প্রবেশ। কিন্তু সেই খাতে দীর্ঘমেয়াদি হননি।
বরং শিল্প বা নাট্য বিষয়ে ভিন্ন তৎপরতায় লিপ্ত থেকেছেন। তার দিক থেকে বাংলা নাটকের উৎস ও ‘আধুনিকতা’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ‘বাংলা নাটকের সূত্রপাত ইংরেজ শাসনের পর’—প্রচণ্ড মিথ্যার রেশ ধরে গড়ে ওঠা বাংলা নাটকের এই ‘ইউরোপীয়’ ইতিহাস ভেঙে গেছে সেলিম আল দীনের হাতে।
তারও আগে ভেঙেছেন শম্ভু মিত্র। কিন্তু বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় ভাঙনের ঢেউ অতো তীব্র হয়নি। ফলে নাট্যধারায় প্রধান হয়ে উঠেছে অ্যাবসার্ডবাদ, অভিব্যক্তিবাদ; বর্হিদেশীয় প্রভাব বশে আমরা নাটকে পেতে চেয়েছি ফ্রয়েডপন্থী যৌনউত্তাপ। এই সবের সমান্তরাল নাটকের কেতাবি ধারায় আরও একটি ক্ষুদ্র ধারার চল ছিল; একে বলা যায় লোকনাট্যের ধারা।
আরও পড়ুন >>> সত্যেন সেন : মেহনতি মানুষের মুক্তিসংগ্রামের তূর্যবাদক
জসীমউদ্দীন, মমতাজউদদীন আহমদ, সৈয়দ শামসুল হক লোকনাট্যের ভাব-স্বভাবের ব্যবহার করেছেন। সেলিম আল দীন আরও বিস্তৃত রূপে লোকনাট্য, কথকতা, বাংলা কাব্যের বিবরণধর্ম প্রভৃতির প্রয়োগপরিধি বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে একই নাটকে মিশে আছে কুশীলবের সংলাপ, নাট্যকারের কথা-বিবরণ। ‘কিত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘চাকা’, ‘হরগজ’, ‘যৈবতী কন্যার মন’ নাটকে আখ্যানরীতিসমূহের প্রয়োগ বাংলা অঞ্চলের নিজস্ব নাট্যরীতি / শিল্পরীতি খোঁজার ‘আধুনিক’ প্রয়াস।
এই প্রয়াসের মধ্য দিয়ে সেলিম আল দীন একটি তাত্ত্বিক বিতর্কে প্রবেশ করেছেন; বিতর্কটি সাহিত্যের সংজ্ঞায়ন ও বিভাজন নিয়ে। সেলিম আল দীন যখন বাংলা নাটকের শেকড় খুঁজতে গিয়ে দেখেন ঔপনিবেশিক যুগের পূর্ব-পর্যন্ত প্রায় সমস্ত বাংলা সাহিত্য নাট্যক্রিয়ামূলক তখন তাকে নতুন করে ভাবতে হয়—সাহিত্যের নানামাত্রিক বিভাজনের (কবিতা/নাটক/গল্প/উপন্যাস) কার্যকারণ কী? তখন হয়তো মন থেকে উত্তর আসে—‘পাশ্চাত্যের সংজ্ঞাভুক্ত শিল্পমাধ্যমসমূহ আমাদের দেশকাল ভূগোল-জনপদের বাস্তবতার সঙ্গে বাহিত শিল্পরুচির অনিবার্য সম্পর্ককে খণ্ডিত করেছে এবং একটি উপরচাপানো ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ফলেই এই খণ্ডন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল’ (বাঙলা দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের পূর্বাপর)।
একই রকম কথা বলেছেন কথাকার দেবেশ রায়—‘ইয়োরোপের এই উপনিবেশ নির্মাতারা আমাদের শেখালেন—দেশের অর্থনীতি বলতে বোঝায় শিল্প, দেশের শাসন বলতে বোঝায় গণতন্ত্র, দেশের শিল্প-সাহিত্য বলতে বোঝায় এ-রকম সব ভাগ-উপভাগ-লিরিক, ট্র্যাজেডি-কমেডি, নভেল’ (উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে)।
সেলিম আল দীন এইসব বিভাজনের শ্রেণিসম্পর্ক ছিন্ন করে স্থির হয়েছেন একটি জায়গায়—যেখানে ‘এক’ মিশে যায় ‘বহু’র মধ্যে, ‘বহু’ মিশে যায় ‘এক’এর মধ্যে। এই রীতির নাম দিয়েছেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব।
‘কিত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘হাত হদাই’, ‘চাকা’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘বনপাংশুল’, এমনকি নিকটকালের ‘নিমজ্জন’, ‘স্বর্ণবোয়াল’ দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের সমর্থনে রচিত। ‘নিমজ্জন’-এর ভিন্নতা সত্ত্বেও বলা যায়, এসব লেখার একদিকে আছে শিল্পাঙ্গ নির্মাণের ধ্রুপদি ধাঁচ, অন্যদিকে আছে লৌকিক জীবনপ্রবাহের গীত-কথা-সমন্বিত গতি; স্থান আর প্রকৃতির বিশদ পটভূমি রচনার পরিসর বাড়িয়ে দিয়েছে বলে বাংলা গীতিকা, আখ্যানকাব্য বা ভারতীয় মহাকাব্যের গঠনকাঠামোর সঙ্গে এগুলোর তুলনা চলে।
আরও পড়ুন >>> সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা : চেতনা জাগুক মনে
নাট্যশুরুর মুহূর্তে উচ্চারিত বন্দনা অংশ, আখ্যানের সর্গভিত্তিক বিভাজন এবং বিবরণধর্মের সঙ্গে বাংলা অঞ্চলের প্রাক-ঔপনিবেশিক আঙ্গিকগুলোর সাযুজ্য চোখে পড়ে। ‘ঢোঁড়াইচরিতমানস’ উপন্যাসে ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ী। সতীনাথ-পূর্ববর্তী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসেও এই অন্বেষণ সচল ছিল। দেবেশ রায় অনুসন্ধানের মাত্রা বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছেন; তার ‘মফস্বলীবৃত্তান্ত’, ‘তিস্তপারের বৃত্তান্ত’, ‘খরার প্রতিবেদন’, ‘শিল্পায়নের প্রতিবেদন’ স্বদেশি শিল্পরীতির মর্ম উপলব্ধির ফল।
মূলত সেলিম আল দীনের শিল্পসন্ধান একক, আকস্মিক বা ধারাবিচ্ছেদী নয়। উপনিবেশের শিল্পকলকব্জায় যারা দেশজ রীতির অন্তর্ঘাত ঘটাতে চেয়েছিলেন তাদের সঙ্গে সেলিম আল দীনের সাযুজ্য সর্বাধিক। তাই তারাশঙ্করের উপন্যাস, শম্ভু মিত্রের নাটক ও নাট্যবোধ, সতীনাথের আখ্যানকাঠামো এবং দেবেশ রায়ের উপন্যাস চিন্তার সহগামী হয়ে উঠেছে তার নাটক ও নাট্যতত্ত্ব। আর তাই ‘যৈবতী কন্যার মন’-এর কালিন্দী যেন ‘নাগিনীকন্যার কাহিনী’র শবলা ও মঙ্গলার প্রতিধ্বনি।
লোকটা কবি হতে চেয়েছিল। কবিতার বীজ গর্ভে নিয়ে হলেন নাট্যকার। লিখলেন নাটক, হলো নাটক-কবিতা-সংগীত-নৃত্যের বিচিত্র ঐক্য....
নিজস্ব নাট্যরীতির খোঁজে বেরিয়ে সেলিম আল দীন পৌঁছে গেছেন প্রাক-ঔপনিবেশিক শিল্পসত্যে—জীবন, ধর্মীয় কৃত্য, শিল্প যেখানে একাকার; সেখানেই দৃঢ় বাঙালির শিল্পের অভেদের শক্তি। নিম্নবর্গের যৌথজীবনের আখ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘হাতহদাই’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘চাকা’।
সামন্তযুগের গ্রামীণ যূথবদ্ধ জীবনচর্যার সঙ্গে খাপ খেয়েছে লোক আখ্যানরীতি। কিন্তু পুঁজি-ধনতন্ত্রের যুগে প্রাক-ঔপনিবেশিক প্রকরণ-প্রবণতাসমূহ কীভাবে ধারণ করবে সাম্প্রতিক ‘শিক্ষিত’-‘নাগরিক’-‘বিদগ্ধ’ মানুষের জীবন? মঙ্গলকাব্যের যুগ আজ নেই, পুঁথি পাঠের প্রচলন সীমিত, কথকতার কোনো আসরও বসে না। ধারণা করি এর উত্তরও সঞ্চিত ছিল। না হলে কী করে লেখা হলো ‘নিমজ্জন’?
না, সেলিম আল দীনকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি এসব কথা।
৪.
পুরোনো কলাভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছিলেন, কী রে, কী করিস তুই? আয় চা খাই... বললাম, স্যার, আগামীকাল আমার গবেষণাপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন, খুবই ব্যস্ত। স্যার বললেন, কীসের গবেষণা? বললাম, দেবেশ রায়ের ওপর... বললেন, খুব ভালো বিষয়, অনেক বড় লেখক... ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-এর শেষাংশ খুবই মর্মদাহনের... বাঘারুটা অসাধারণ... হ্যাঁ হ্যাঁ দেবেশ রায় নিয়েই লিখবি, আমাকে নিয়ে তো কিছু লিখবি না। বলেছিলাম লিখব। না, উপলক্ষের এই লেখা সেই লেখা নয়।
মহানাট্যের যেই নটরাজ শিল্পের সভায় এতদিন নেচে গেছেন তার মননের প্রতিটি মুদ্রা দাবি করে দীর্ঘ পাঠ।
সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়