কার্যকরী ডেঙ্গু ভ্যাকসিন যখন সময়ের দাবি
ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। শুধুমাত্র লক্ষণ অনুযায়ী সাপোর্টিভ চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। তাই মশা নিধনের পাশাপাশি ভ্যাকসিনই হতে পারে ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য উত্তম কার্যকরী ব্যবস্থা।
ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপ আছে (ডেনভি সেরোটাইপ - ১, ২, ৩ ও ৪) যদিও সম্প্রতি সেরোটাইপ-৫ আবিষ্কৃত হয়েছে। কোনো ব্যক্তি এক ধরনের সেরোটাইপ দিয়ে সংক্রমিত হলে তার শরীরে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা/অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি হয়। ফলে পরবর্তীতে ভিন্ন কোনো সেরোটাইপ দিয়ে সংক্রমিত হলে উক্ত ব্যক্তির মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
সাধারণত কেউ যদি এক ধরনের সেরোটাইপে আক্রান্ত হওয়ার ১৮-২০ মাসের মধ্যে আরেকটি ভিন্ন সেরোটাইপে আক্রান্ত হয় তাহলে তার সিভিয়ার ডেঙ্গু (ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন >>> শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়?
ভয়াবহতার দিক দিয়ে সেরোটাইপ ২ ও ৩ বেশি মারাত্মক। জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা গিয়েছে ২০১৬ সালের আগে আমাদের দেশে সেরোটাইপ ১ ও ২ দ্বারা সংক্রমণ বেশি হয়েছিল। ২০১৭ সালে দেশে প্রথম সেরোটাইপ -৩ শনাক্ত হয়। পরের বছরগুলোয় সংক্রমণের এই হার বাড়তে থাকে এবং ২০১৯ সালে এটি প্রায় মহামারি আকার ধারণ করে অনেক মৃত্যু ঘটায়।
২০২৩ সালে অসংখ্য রোগী ডেঙ্গতে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। এই বছর কোন ধরনের সেরোটাইপ দিয়ে সংক্রমণ বেশি হচ্ছে সেটা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গভ্যাকসিয়া এবং কিউডেঙ্গা নামক দুটি টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে।
ডেঙ্গভ্যাকসিয়া (Dengvaxia)
সানোফি ফার্মাসিউটিক্যালের তৈরি ডেঙ্গু ভ্যাকসিন ডেঙ্গভ্যাকসিয়া (Dengvaxia) সর্বপ্রথম বাজারে এসেছিল কিন্তু কিছু মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) কারণে অনেক দেশেই আবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এই টিকা শুধুমাত্র ৯-১৬ বছরের বয়সের যে ব্যক্তি পূর্বে একবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এবং শরীরে ডেঙ্গু প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি আছে (সেরোপজেটিভ) এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই কার্যকর। এই ভ্যাকসিন শরীরে শুধুমাত্র অ্যান্টিবডি-মেডিয়েটেড ইমিউনিটি তৈরি করতে পারে। ফলে এই টিকা দিলে শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা পরবর্তীতে ন্যাচারাল ডেঙ্গু ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি বহু গুণে বাড়িয়ে দেয় এবং রোগের তীব্রতা-জটিলতাও বেড়ে যায়।
তাই ডেঙ্গভ্যাকসিয়া টিকা দেওয়ার আগে ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি টেস্ট করা আবশ্যক। এই ধরনের ভ্যাকসিনজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে অ্যান্টিবডি-ডিপেন্ডেন্ট-এনহ্যান্সমেন্ট বলা হয় এবং এই মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্যই এই টিকা তার গুরুত্ব হারায়।
কিউডেঙ্গা [QDENGA® (Dengue Tetravalent Vaccine)]
তবে ২০২২ এর শেষের দিকে নতুন জেনারেশন কিউডেঙ্গা [QDENGA® (Dengue Tetravalent Vaccine)] নামক ভ্যাকসিন ইউকেতে প্রথম অনুমোদন পেয়েছে যা ডেঙ্গুর ৪টি সেরোটাইপের বিপরীতেই ৮০ শতাংশ কার্যকর এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর হাসপাতালে ভর্তি ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম।
আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট : এইবারও কি ব্যর্থ হব?
প্রথমবার ন্যাচারাল ইনফেনশনের জন্য টিকার এই কার্যকারিতা বজায় থাকবে ১৮ মাস পর্যন্ত। টিকার কার্যকারিতা ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ অনুযায়ী কম বেশি হতে পারে। যেমন ডেঙ্গু সেরোটাইপ-১ ও ২-এর ক্ষেত্রে কিউডেঙ্গার কার্যকারিতা সাধারণত যথাক্রমে ৭০ ও ৯০ শতাংশ। আবার ডেঙ্গুর ৪টা সেরোটাইপের মধ্যে সেরোটাইপ-৩-এর বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতা সবচেয়ে কম যা মাত্র ৪৯ শতাংশ।
তবে পূর্বে একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সেরোটাইপ-৩-এর বিরুদ্ধে এই টিকার কার্যকারিতা ৭৫ শতাংশ, যা প্রায় ৫৪ মাস পর্যন্ত বজায় থাকতে পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে সেরোটাইপ দিয়েই সংক্রমণ হোক না কেন কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন ব্যক্তিভেদে ৪-৬ বছরের জন্য ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও হেমোরেজিক ডেঙ্গু ফিবার থেকে সুরক্ষা দিতে পারবে ৭০ শতাংশ।
জাপানের টাকেডা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির তৈরি এই ভ্যাকসিন যেমন কার্যকর তেমনি নিরাপদ এবং উল্লেখযোগ্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই।
এটি একটি লাইভ অ্যাটিনিউয়েটেড ভ্যাকসিন যার ভেতরে ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ-২ ব্যবহার করা হয়েছে এবং ৪টি সেরোটাইপেরই জিন-এর ভেতরে প্রবেশ করানো হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৪ বছর ধরে ২৮ হাজার শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর এই ভ্যাকসিনের মোট ১৯টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ৩টি ধাপ সম্পন্ন করা হয়েছে।
কোনো ট্রায়ালেই মারাত্মক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। উপরন্তু দুই ডোজের (৩ সপ্তাহের ব্যবধান) এই টেট্রাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন শরীরে একইসাথে অ্যান্টিবডি এবং সেল মেডিয়েটেড ইমিউনিটি তৈরি করে। পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত (সেরোপজিটিভ) অথবা অনাক্রান্ত (সেরোনেগেটিভ) ৪ বছরের বেশি বয়সের যে কেউ কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন নিতে পারবে।
আরও পড়ুন >>> মশার আচরণগত পরিবর্তন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ
তবে লাইভ এটিনিউটেড ভ্যাকসিন বলে গর্ভবতীদের জন্য এই ভ্যাকসিন উপযুক্ত নয়। গর্ভধারণের কমপক্ষে ১ মাস আগে এই ভ্যাকসিনের ডোজ পূর্ণ করতে হবে।
বর্তমানে কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, আইসল্যান্ড, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, অষ্ট্রিয়াসহ কয়েকটি দেশে জনসাধারণের ওপর প্রয়োগের অনুমোদন পেয়েছে।
এছাড়া বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্যানেসিয়া ফার্মাসিউটিক্যাল ও সেরাম ইন্সটিটিউট যৌথভাবে ডেঙ্গুর একটি টিকা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে যা তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের শেষ ধাপে রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কোনো টিকাকেই অনুমোদন দেয়নি।
তাই যতদিন আমাদের দেশে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত মূলত সচেতন হয়ে এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলা (দিনে বা রাতে মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো, মশার রিপিলেন্ট শরীরে ব্যবহার করা, হাত-পা ঢাকা কাপড় পরা), আশেপাশে কোনো পাত্রে পানি জমতে না দেওয়া, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, জ্বর হলে দ্রুত রক্ত পরীক্ষা করা এবং সর্বোপরি মশা নিধন করাই ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের প্রধান উপায়।
ডা. কাকলী হালদার ।। সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ