মহীয়সী বঙ্গমাতা
বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘সে (রেণু) তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’ প্রিয়তমার জন্য কতটা ভালোবাসা থাকলে হৃদয়ে এমন রক্ত ক্ষরণ হয় তা অনুমান করা অসম্ভব।
জাতির পিতার সেই ‘রেণু’ হলেন বাংলার মহীয়সী নারী বেগম শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব। যিনি প্রজ্ঞা, ধৈর্য, সাহসিকতা, মায়া মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে পালন করেছেন নারী জীবনের সব দায়িত্ব।
রাজনীতিবিদ না হয়েও দেশের দুঃসময়ে জনগণকে আগলে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে নিজের মেধা ও বিচক্ষণতা দিয়ে নেতাকর্মীদের জুগিয়েছেন সাহস। দিয়েছেন অনুপ্রেরণা। মায়ের ভালোবাসায় সবাইকে আগলে রেখে বঙ্গমাতা হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন সবার কাছে।
আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন
মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুননেছা যার নামের সাথে মিশে আছে বাঙালির আবেগ আর ভালোবাসা। যে নাম শুনলে অতল শ্রদ্ধায় নত হয় মাথা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে শাশ্বত বাঙালি মায়ের মায়াবী মুখের প্রতিচ্ছবি।
যার আত্মত্যাগ, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টির সঙ্গে। কিন্তু ১৯৭৫’র রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ইতিহাস বিকৃতির নোংরা খেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু পরিবারের অবদান মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র চলে। দীর্ঘ ২১ বছর বিভিন্ন মোড়কে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেশ শাসন করায় স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের অবদান এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা।
পৃথিবীর অনেক মহৎ অর্জনের পেছনে রয়েছে অনেক মহীয়সী নারীর ভালোবাসা, ত্যাগ ও মহত্ত্ব। বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে স্বাধীনতার রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুননেছা তাদেরই একজন।
বঙ্গবন্ধু, বাঙালিও বাংলাদেশ যেমন একই সূত্রে গাঁথা, তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবও পরস্পর অবিচ্ছেদ্য নাম। কোনো জাতি রাষ্ট্র উদ্ভবের ইতিহাসে এইরকম মহীয়সী ব্যক্তিত্ব দ্বিতীয়টি নেই।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন সঙ্গী ফজিলাতুননেছার জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। ফুলের মতো গায়ের রং ছিল তার। মা হোসনে আরা বেগম রেণু বলে ডাকতেন তাকে। রেণু নামেই পরিচিত হয়ে উঠলেন তিনি। মাত্র ৩ বছর বয়সেই হারালেন বাবা শেখ মোহাম্মদ জহুরুল হককে।
৫ বছর বয়সে হারান মাকে। এই সময়ে অনাথ রেণুর ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে পড়ে ৮০ বছরের বৃদ্ধ দাদা শেখ মোহাম্মদ আবুল কাশেমের ওপর। কিন্তু রেণুর বেশি প্রয়োজন ছিল মা-বাবার ভালোবাসার। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর মা সাহেরা খাতুন (রেণুর চাচি) মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন রেণুকে। একই পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেন শেখ মুজিব ও রেণু। মাত্র ১৩ বছর বয়সে রেণুর দাদার নির্দেশে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা।
আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নেপথ্যচারিণী, প্রেরণাদায়িনী ও মহীয়সী নারীর নাম বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘তার প্রিয় সহধর্মিণী একদিকে যেমন শক্ত হাতে সন্তান ও সংসার সামলিয়েছেন, তেমনি নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে অতিক্রম করে স্বামীর সংগ্রামে সহযোদ্ধা হিসেবে ছায়াসঙ্গীর মতো জুগিয়েছেন সাহস ও উদ্দীপনা।’
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে, সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। কারাবন্দি করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। প্রায় দেড় বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। যেহেতু স্বামী কারাবন্দি তাই রেণুকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চাইতো না। ৩ দিনের নোটিশে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। দুঃসময়ে তার মনোবল ছিল প্রবল। সবদিকে লক্ষ্য রেখে শান্ত মনে সামলাতে পারতেন সবকিছু।
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে উঠে আসে বঙ্গমাতার ত্যাগ-তিতিক্ষার অনেক অজানা তথ্য। নিজের হাতেই সেলাই করতেন সন্তানদের কাপড়। স্নেহ ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে সন্তানদের বুঝতে দিতেন না পিতৃস্নেহের অভাব।
একদিকে সংসার, অন্যদিকে কারাগার। অনেকটাই দৌড়ঝাঁপে সময় হতো পার। স্বামীর মামলার খোঁজখবর নিতে ঘুরতে হয়েছে আইনজীবীদের দ্বারে দ্বারে। নিয়মিত বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যেতেন জেলগেটে। স্বামীর প্রতি তার এই ভালোবাসা ও ত্যাগের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা-পয়সা জোগাড় রাখত’ (পৃষ্ঠা-১২৬)।
দেশপ্রেমের অগ্নি পরীক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন তিনি। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকারের দায়ের করা আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে, যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দি মুক্তির দাবিতে গড়ে ওঠে ৬৯’র গণআন্দোলন। এই সময়ে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি থাকা শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে পৌঁছে দিতেন তিনি।
একদিকে নেতাকর্মীদের উৎসাহ দিয়ে মনোবল চাঙা রাখতেন, অন্যদিকে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকতে বঙ্গবন্ধুকেও অনুপ্রাণিত করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণে পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন বেগম মুজিব। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখে তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন প্যারোলে নয়, পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবে।
তাই বঙ্গমাতার পরামর্শে বঙ্গবন্ধুও প্যারোলে মুক্তি নিতে রাজি হননি। এরই মাঝে শেখ মুজিবসহ কারামুক্তিদের আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানের। আন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় আইয়ুব সরকার। ১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু।
আরও পড়ুন >>> কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গমাতা
পরের দিন নিজেদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয় বাঙালি জাতি। প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ার বিষয়ে বঙ্গমাতার এই সিদ্ধান্তকে ইতিহাসে অনন্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পেছনেও রয়েছে বঙ্গমাতার উৎসাহ ও প্রেরণা।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস অসীম সাহস ও ধৈর্য নিয়ে বেগম মুজিব অনেকটা বন্দিদশায় সব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জিত হয় বাঙালি জাতির। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর নতুন জীবনের শুরু হয় বেগম মুজিবের।
অতীতের আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করার মতো তখন পাশে দাঁড়ান যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে। বীরাঙ্গনাদের সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য তাদের বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন তিনি এবং সহায়তা করেন তাদের আর্থিক পুনর্বাসনে।
সরকার প্রধানের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কোনো অহংবোধ ছিল না। দামি আসবাবপত্র, অলংকার, শাড়ীর প্রতি ছিল না কোনো লোভ। বরং নিজের গয়না বিক্রি করে দলীয় নেতাকর্মীদের সহায়তা করার দৃষ্টান্ত রয়েছে তার। খুবই সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন বঙ্গমাতা। তা যেন আবহমান শাশ্বত বাংলা মায়েরই প্রতিচ্ছবি।
আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!
স্বাধীনতার আগে ও পরে বঙ্গবন্ধুকে উৎসাহ ও প্রেরণাদানের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশ না পেলে বঙ্গমাতার ত্যাগ-তিতিক্ষা অপ্রকাশিত থেকে যেত বাঙালির কাছে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী লেখার পেছনেও প্রেরণা ছিল বঙ্গমাতার। তিনিই বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং মনের কথা লিখতে জেলগেটে পৌঁছে দিতেন কাগজ-কলম।
বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর শুধু জীবনসঙ্গীই ছিলেন না, ছিলেন সব আন্দোলন-সংগ্রামের ছায়াসঙ্গী—শেষ পর্যন্ত হলেন তার মৃত্যুসঙ্গীও। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকদের নির্মম বুলেটে শহীদ হন বঙ্গমাতাও।
বঙ্গমাতার দেশপ্রেম, ত্যাগ, ধৈর্য ও দায়িত্ববোধ ছড়িয়ে পড়ুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হোক দেশের নারীসমাজ। বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি তার স্মৃতির প্রতি।
মানিক লাল ঘোষ ।। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য