বিশ্ববিদ্যালয় ও হলের পরিবেশ যেমন হওয়া উচিত
যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের ডাকা শান্তি সমাবেশে যোগ দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের হল পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রলীগ নেতারা তাদের বলেছেন, সমাবেশে না গেলে হলে থাকতে দেওয়া হবে না। (প্রথম আলো, ২৮ জুলাই ২০২৩)।
বিষয়টা কি আদৌ যৌক্তিক? সভ্য দেশে তা কি আশা করা যায়? অথচ আমরা ঠিক উল্টো কাজ করতে পারতাম। ছাত্রদের আলাদা হলের পরিবেশ দিতে পারতাম। ছাত্রদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা প্রাধান্য দিতে পারতাম।
আসুন ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করি। এমন যদি হতো যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি না করে শিক্ষা ও ছাত্রদের জন্য যা কল্যাণকর সেই রাজনীতি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো এবং সেই নির্বাচনে যারা প্রার্থী হতো তারা কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করতো না।
আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং ও বিজ্ঞান শিক্ষার মান
ছাত্র নেতা তারাই হবে যারা ভাববে প্রথম বর্ষের ছাত্ররা যারা ক্যাম্পাসে আসবে তাদের দেখভাল করবে এবং তাদের কোনো সমস্যা থাকলে সেইসব সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করবে। অর্থাৎ ছাত্র নেতারা ছাত্রাবস্থাতেই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সমাজের কল্যাণ হয় এমন কাজের নেতৃত্ব শিখবে।
ছাত্ররা যদি নিয়ম শৃঙ্খলা মানতো তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো চালানোর জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজন হতো না। বড়জোর কয়েকজন কর্মকর্তা এবং কিছু ছাত্রকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিয়োগ দিয়ে যদি হল চালানো যেত তাহলে কতই না ভালো হতো।
ছাত্ররা যদি ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো’ স্লোগান শেখে, ছাত্র হয়ে দুর্বল ছাত্রদের গেস্ট রুমে এনে টর্চার করে তাহলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো সুন্দর পরিবেশ আসবে না।
কিছু ছাত্র কিছু আর্থিক সহযোগিতা পেত এবং হলের কিছু দায়িত্ব পালন করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতো যা উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়। এতে শিক্ষকদের প্রভোস্ট হওয়া এবং আবাসিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া মানে শিক্ষকদের দিয়ে হোস্টেল চালানো। এর মাধ্যমে শিক্ষকদের কর্মঘণ্টার মারাত্মক অপচয় হয়।
শিক্ষকদের কর্মঘন্টা বাঁচানোর জন্য উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে কতকিছুই না করে। যেমন মাস্টার্স বা পিএইচডি ছাত্রদের দিয়ে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ল্যাব ক্লাস চালানো হয়। এতে ছাত্ররা আর্থিক সহযোগিতা পায় এবং একই সাথে যেই কাজ আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পাস ছাত্ররাই করতে পারে সেই কাজে অধ্যাপককে দিয়ে করানো মানে শিক্ষকদের সময়ের অপচয় ঘটানো।
এমনকি বিভাগে পোস্টডক থাকলে তাদের দিয়ে প্রথম বর্ষের কিছু ক্লাস নেওয়ার সুযোগ দিয়েও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের উচ্চতর ক্লাস নেওয়া ও গবেষণায় মনোনিবেশ করার সুযোগ দেওয়া যায়।
আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি কতটা যৌক্তিক?
উপরের সবকিছুই সম্ভব হবে যদি ছাত্ররা নিয়মানুবর্তিতা মানে এবং সত্যিকারের ছাত্র হয়। তা না হয়ে ছাত্ররা যদি ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো’ স্লোগান শেখে, ছাত্র হয়ে দুর্বল ছাত্রদের গেস্ট রুমে এনে টর্চার করে, ছাত্রদের বস্তির চেয়েও অধম জীবন যাপন করতে হয়, ছাত্র হয়ে হলের সিট দখল করা শেখে তাহলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো সুন্দর পরিবেশ আসবে না ।
এই পরিবেশে যারা বড় হবে তারাও দেশের জন্য কল্যাণকর নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে না। ছাত্রাবস্থাতেই যদি শিক্ষার্থীরা মারামারি শেখে, সিট দখল শেখে, ব্যবসায়ীকে ধরে এনে টাকা আদায় করা শেখে, মার্কেটে হামলা করা শেখে তাহলে এরা বড় হয়ে কর্মজীবনে ঢুকে কী করবে তা সহজেই অনুমেয়।
ছাত্ররা দাবি জানাবে শিক্ষা সামগ্রীর দাম কমানোর, বেতন কমানোর, আবাসিক পরিবেশের মান বাড়ানোর, ভালোমানের শিক্ষক নিয়োগের, লাইব্রেরি উন্নত মানের করার, ক্যাফেটেরিয়ার মান বাড়ানোর ইত্যাদি।
ছাত্রাবস্থা থেকেই যদি দলান্ধ রাজনীতিতে হাতেখড়ি ঘটে এর মানে সেই ছাত্র চিন্তায় অন্ধ হয়ে বড় হবে। ছাত্রাবস্থায় সব রাজনৈতিক মত জানবে (অবশ্যই দেশদ্রোহী জামায়াতে ইসলামের আদর্শ ব্যতীত), পড়বে, দেখবে এবং শিখবে।
ছাত্ররা দাবি জানাবে শিক্ষা সামগ্রীর দাম কমানোর, বেতন কমানোর, আবাসিক পরিবেশের মান বাড়ানোর, ভালোমানের শিক্ষক নিয়োগের.....
আমাদের ব্রেইন বড় সাংঘাতিক। এটি যখনই একটা লুপে পড়ে যায় সেইখান থেকে বের হয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। ছোটবেলাতে এমন লুপে ফেলে দিয়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি অসম্ভব অন্যায় করছি।
এমন যদি হতো যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষা, গবেষণা ও শিক্ষকদের জন্য যা কল্যাণকর সেই রাজনীতি করে তাহলে কল্যাণকর হতো। শিক্ষক সমিতি কেবল শিক্ষা, গবেষণা ও শিক্ষকদের স্বার্থ নিয়ে প্রশাসন ও সরকারের সাথে দেনদরবার করে।
যারা শিক্ষক হবে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত অন্য কোথাও পার্ট টাইম পড়াবে না। শিক্ষকরা ছাত্রদের সময় দেবে। একসাথে শিক্ষার্থীদের নিয়ে দুপুরে খাবারের ছলে নানা বিষয়ে আলোচনা করবে। শিক্ষকরা গবেষণার পরিবেশ বৃদ্ধির দাবি জানাবে। শিক্ষকদের চিন্তা এবং চেতনা থাকবে উন্মুক্ত। শিক্ষক হয়ে যখন লুপে আটকে যায় তারা কীভাবে ছাত্রদের দিকে দৃষ্টি দেবে বা বাড়াবে?
আরও পড়ুন >>> সৃজনশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কেন জরুরি?
তবে রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে শিক্ষকতা পেশায় কেউ বড়লোক হতে আসে না। এইটা এমন একটি পেশা যে পেশার মাধ্যমে সর্বদা নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা ইনবিল্ট থাকে। অর্থাৎ আমি জ্ঞানের ফ্লোতে থাকব, আমি উন্নত হবো আবার তার জন্য বেতন পাব। এই বোধটা প্রতি শিক্ষকের মধ্যে থাকতে হবে। তবে এইখানে সমাজ এবং রাষ্ট্রেরও কর্তব্য আছে।
রাষ্ট্রকে শিক্ষকদের জন্য এমন বেতন ব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে যেন শিক্ষকরা কোনো অসৎ বা বাজে কাজে জড়িত না হয় কারণ তাতে রাষ্ট্র ও সমাজেরই ক্ষতি বেশি। শিক্ষক হলো মানুষ গড়ার কারিগর। কারিগর নষ্ট হয়ে গেলে কেমন দেশ হয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ বর্তমান বাংলাদেশ।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়