ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত কি গুরুত্বপূর্ণ?
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শুরু করে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে হত্যা, লুট ও ধর্ষণের অংশগ্রহণকারীদের মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার। স্বাভাবিকভাবেই খড়্গ নেমে আসে জামায়াতে ইসলামীর ওপর। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় বেশ কয়েকজন নেতার ফাঁসি হয়, আমৃত্যু সাজা হয়।
আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি এই বিচারিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সারাদেশে আন্দোলনে নামে জামাত-শিবির কর্মীরা। খুব দ্রুতই এই আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। পুলিশের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণ হারান বহু পুলিশ সদস্যও। হামলার শিকার হয় সরকারি স্থাপনা। একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে দীর্ঘ সময়। সরকারও চড়াও হয় জামায়াতের ওপর। কোথাও মিছিল, মিটিং তো দূরের কথা, জমায়েতও হতে পারছিল না দল এবং এর সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
প্রকাশ্যে সংগঠনটি বড় ধরনের সভা-সমাবেশ করতে পারেনি সেই থেকে। তবে দলের নেতা-কর্মীরা গোপনে যে ঠিকই তৎপর ছিল সেটা সবারই জানা। সম্প্রতি দলটির নেতা-কর্মীদের তৎপরতা বেড়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলটির নেতারা এবার প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছেন।
আরও পড়ুন >>> জোশের লাগাম টানতে হবে
১০ জুন ২০২৩, প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় পর ঢাকায় সমাবেশ করেছিল জামায়াতে ইসলামী এবং সেইখানে নেতারা দলের নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলে। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্ট।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মিলে হত্যা, লুট, ধর্ষণ এবং রাহাজানিতে অংশ নেওয়ায় একে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে অবৈধ ঘোষণা করে আদালত। ২০১৮ সালে ৮ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। ফলে এরপর থেকে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী।
বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক দলগুলো, বিশেষ করে সাংগঠনিক দক্ষতা সম্পন্ন স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামী বরাবরই বিএনপির পছন্দের দল। একসাথে জোট করে আন্দোলন করেছিল ২০০১ সালে...
এক সময় বিএনপির সাথে একীভূত হয়ে রাজনীতি ও আন্দোলন করা জামায়াতে ইসলামী এইবার পৃথকভাবে নেমেছে। আগামী ১ আগস্ট আবার ঢাকায় সমাবেশের ডাক দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনাসহ কয়েকটি দাবিতে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি।
একদিকে বিএনপির নেতৃত্বে সমমনা দলগুলোর আন্দোলন এবং তাকে কেন্দ্র করে রাজপথে সংঘাত ও সহিংসতার মধ্যে আলাদা করে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে জামায়াতে ইসলামী। নানা সময় চোরাগোপ্তা ঝটিকা মিছিল করলেও ১০ জুন ২০২৩-এর সমাবেশটি ছিল উল্লেখযোগ্য। পুলিশকে জানিয়ে, মৌখিক অনুমতি নিয়েছে এবং যে পুলিশ হত্যাও করা হয়েছিল সেই পুলিশকেই ফুল দিয়ে সমাবেশ করেছে এই দল।
আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?
একটা সময় ঘরে সভা করতে গিয়েও গ্রেপ্তার হতে হয়েছে দলটির নেতা-কর্মীদের। দলটির আমির শফিকুর রহমান এবং সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া মো. গোলাম পরওয়ারও এখন বন্দি। সেই দলটির প্রতি কি তাহলে সরকার এখন কিছুটা নমনীয়? এমন প্রশ্ন উঠছে পর্যবেক্ষক মহলে। জাতীয় নির্বাচনের এক বছরেরও আগে জামায়াতের কর্মসূচি পালনে অঙ্গনে নানা কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে।
তিনটি প্রশ্ন এখন সবার সামনে—১. ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই কি জামায়াতকে মাঠে নামতে দিল? ২. নাকি বিএনপি নিজেদের ঘাড় থেকে জামায়াতকে নামিয়ে আলাদা করে আন্দোলনের মাঠে পাঠালো একটি কৌশলে হিসেবে? ৩. নাকি জামায়াত নিজেই সুযোগ বোঝে নেমে পড়ল?
বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক দলগুলো, বিশেষ করে সাংগঠনিক দক্ষতা সম্পন্ন স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামী বরাবরই বিএনপির পছন্দের দল। একসাথে জোট করে আন্দোলন করেছিল ২০০১ সালে। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার জামায়াতের দুই জন নেতাকে মন্ত্রীও করেছিল যাদের পরবর্তীতে বর্তমান সরকারের আমলে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছিল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে।
জামায়াত এখন বিএনপির জোটে নেই। সেই বিবেচনায় হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠায় কয়েকটি বিষয় সামনে এসেছে। জাতীয় নির্বাচনকে লক্ষ্য করে মার্কিন ভিসা নীতির সুবিধা পাচ্ছে দলটি, এমনটা মনে করছেন অনেকে। আবার অনেকের ধারণা নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে পর্দার আড়ালে নানা যোগাযোগের প্রতিফলন ঘটেছে জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশের মাধ্যমে।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের চির বৈরিতা জামায়াতে ইসলামীর সাথে। সারাদেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইসলামী ছাত্র শিবির ও ছাত্রলীগের যে কত খুনোখুনি হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। প্রায় প্রতিটি জনপদে আওয়ামী লীগ জামায়াতের সংঘর্ষ হয়েছে।
আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি কোথায়?
সেই জামায়াতে ইসলামীকে যদি নির্বাচনী সমীকরণে কোনো সুযোগ দেয় সরকার তাহলে দল হিসেবে নিজের কর্মী সমর্থক এবং সাধারণ মানুষের কাছে এর ব্যাখ্যা কী হবে? অবশ্য প্রচণ্ড গোঁড়া ও সাম্প্রদায়িক হেফাজতে ইসলামীর সাথেও আওয়ামী লীগের সখ্যতা নিয়ে রাজনীতির মাঠে আলোচনা আছে।
সরকার একটা রাজনৈতিক সমীকরণের জায়গা থেকে জামায়াতকে দেখছে বলেই সাধারণ ধারণা। জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠলে বিএনপিই লাভবান হতে পারে বেশি, কারণ বহুদিন ধরে জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধভাবে রাজনীতি করেছে বিএনপি। তাছাড়া উভয় দলের দাবিও এক যে, আগামী নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় তত্বধায়ক সরকারের অধীনে।
এই দেশে রাজনীতি মানেই ক্ষমতা। বড় প্রবণতা হলো, ক্ষমতায় আসতে গেলে বা থাকতে গেলে নীতি-আদর্শের চেয়েও মৌলবাদই অধিক গ্রহণযোগ্য এবং অবশ্যই তা ধর্মীয় মৌলবাদ।
অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের চাওয়া জামায়াত যেন বিএনপির সঙ্গে না থাকে। তারা জামায়াতকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় নিজেদের সঙ্গে না এনে।
জামায়াতের এককভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই তাকে বিএনপির সাথেই থাকতে হয়েছিল এবং আদর্শগত মিলটাও বিএনপির সাথেই। তবে ১৯৯১ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সঙ্গে থাকার জন্য ভোটের ব্যবধানটা বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের সাথে না হলেও অন্তত বিএনপি থেকে দলটিকে দূরে রাখতে চায়।
আরও পড়ুন >>> ধর্মের রাজনীতি নাকি রাজনীতির ধর্ম
এই দেশে রাজনীতি মানেই ক্ষমতা। বড় প্রবণতা হলো, ক্ষমতায় আসতে গেলে বা থাকতে গেলে নীতি-আদর্শের চেয়েও মৌলবাদই অধিক গ্রহণযোগ্য এবং অবশ্যই তা ধর্মীয় মৌলবাদ।
মানুষও জানে যে, রাজনীতিতে ক্ষমতার স্বাদ একবার যারা পায়, তাদের কাছে নীতি-আদর্শ তুচ্ছ। দীর্ঘকাল ধরে এই দিশাহারা কাজে ডুবে এবং মজে আছে আমাদের বড় দলগুলো। এই বিবেচনাহীন কাণ্ডের যে সম পরিমাণের বিপরীত প্রতিক্রিয়া কোনো না কোনোদিন আসবে, সেই কথা ভাবছে না কেউ।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন